লাউয়াছড়ার জঙ্গলে একদিন।
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ০৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০৪:০৪:২২ বিকাল
মাধবপুর লেক হতে ফিরতি পথে আমরা আগের রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তা যেখানে দু'ভাগ হয়ে বামের রাস্তা শহরের দিকে আর ডানের রাস্তা লাউয়াছড়া জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। আমরা ডান দিকের জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম। ছায়ঢাকা রহস্যময় বুনোপথের একটা আকর্ষণ আছে। মনে হবে আবছা আলো আধো অন্ধকারে ঢাকা কি যেন এক অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। কোন বন্য প্রাণী লুকিয়ে দুচোখে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে।
পিচ ঢালা রাস্তার ছবি সংগৃহীত।
দুপাশে অন্ধকার ঘন গহীন জঙ্গল। মাঝ দিয়ে পিচ ঢালা এই রাস্তা।যারা এই পথে গিয়েছেন নিশ্চয় দেখেছেন রাস্তায় গাড়ী না থাকলে ছায়াঢাকা কেমন শান্ত নিরিবিলি এই পথ। মাঝে মাঝে সতর্কবা্ণী লেখা ধীরে চলুন; সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০ কি: মি:; বন্য প্রানী পারাপারের জায়গা; সাবধানে চলুন ইত্যাদি। কিন্তু ঐ নির্দেশ লেখা পর্যন্তই! কোন গাড়িই এই নির্দেশ মানছে না! যখন গাড়ীগুলো আসে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে কতোটা তুমুল গতিতে গাড়ীগুলো সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে! যেন এই এলাকায় আসার পর গাড়ীর গতি আরে বেড়ে যাচ্ছে!!
বনের রেষ্ট হাউস।
আমি দুপাশে অবাক বিস্ময়ে দেখছি বাইকের পিছনে বসে বসে। বাইক চালাচ্ছেন শাহেদ ভাই।আমি মুখে কিছু বলছি না, যেখানে নিয়ে যাক কোন সমস্যা নাই, শুধু এই জঙ্গল হতে আমাকে যেন বের না করে! এমনটা ভাবছি ভাব সাগরে নিমজ্জিত হয়ে আর মনের গহীনে আশা জাগছে জঙ্গলের আরো গভীরে যেতে। এক সময় এক জায়গায় অনেকগুলো গাড়ী দেখে তার পাশে শাহেদ ভাই বাইক থামিয়ে দিলেন। এক পাশে পার্ক করে স্লিপ নিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। এবার পায়ে হাটা।
জঙ্গল ভেদ করে চলে গেছে রেল রাস্তা।
সোজা হাটতে হাটতে সামেন রেল রাস্তা পেরিয়ে আরো ভিতরে চলতে থাকলাম। রেল রাস্তা পেরিয়ে আরো ভিতরে গেলে পেলাম লাউয়াছড়া বন মসজিদ। মসজিদে পেরিয়ে গেলেই হাতের ডানে পাহাড়ের উপর রেষ্ট হাউস। এসব ফেলে আমরা আরো সামনে যেতে থাকলাম।এর পর মাটির রাস্তা শুরু। সামনে রাস্তাটা দুইভাগ হয়ে গেছে। সেখানে তিন মাথায় দুইটা বানর জঙ্গলের ভিতর থেকে নেমে এসেছে। অনেক দর্শনার্থী তাকে ঘিরে রেখেছে। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে অনুরোধ করে বানরটাকে জঙ্গলের ভিতরে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। এরপর হাতের ডানের রাস্তা ধরে হাটা দিলাম।
আড়াআড়ি গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ।
কিছুদূর সামনে দেখলাম পাহাড়ের ঢালুতে রাস্তার উপর মোটা এক গাছ পড়ে রাস্তাটাকে প্রায় বন্ধ করে রেখেছে। তবে পায়ে হাটা লোকদের জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করছে না। বরং এটা অসুবিধা সৃষ্টি করছে গাছ চোরদের জন্য। বনের ভিতর খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন মোটা মোটা গাছ কেটে ফেলার চিহ্ন। আমি শাহেদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এই যে এভাবে গাছগুলো রাতের আধাঁরে চুরি করে কেটে ফেলছে, এক সময়তো এই বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে! এতো গাছ চুরি হয় তাহলে বিট অফিসারদের কাজ কি? উনি বললেন, যারা চুরি রোধ করবে তারাই বড় চোর!!!
চলছি এই পথে শাহেদ ভাই রাস্তা চেনেন!
আমরা কথা বলছি আর হাটছি। এভাবে হাটতে হাটতে সামনে গিয়ে আর কোন লোকজনের দেখা পাচ্ছি না। তার মানে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। লোকজনের কোন সাড়া-শব্দ নাই। একেবারে নি:শ্চুপ-নিঝুম বনের পরিবেশ! মাঝে মাঝে ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। শাহেদ ভাই বললেন এই রাস্তা তিনি চিনেন এটা এক ঘন্টার একটা ট্রেইল। এই পথে গেলেই আমরা বের হতে পারব। তার কথায় ভরসা পেয়ে হাটতে থাকলাম জঙ্গলের পথে। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে থাকল সুর্যের আলো খুব বেশি এখানে পড়ছে না। গাছের পাতার ফাঁকে ফিল্টার করে সুর্যের আলো যতটুকু রাস্তায় পড়ছে তাতে রাস্তা পরিস্কার হলেও বনের ভিতরটা অন্ধকার।
ছবি বেশি উঠানো হয় নি।শুধু হেটেছি।
রাস্তার উপর সম্ভবত এই মাত্র বন্য কোন ছাগল পায়খানা করে গেছে। শাহেদ ভাইকে ডেকে দেখালাম। তিনি দেখে বললেন ছাগলের নয় হরিণের পায়খানা। হয়তো এই মাত্র কোন বন্য হরিণ রাস্তাটা পার হয়ে চলে গেছে এক পাশের জঙ্গল হতে অন্য পাশের জঙ্গলের ভিতর। এই গা ছমছম করা পরিবেশে খালি হাতে হাটা কেমন যেন লাগে! মনে হয় যদি হাতে একটা লাঠি বা কিছু থাকত। যতই সামনে যাচ্ছি রাস্তা ততই সরু হয়ে আসছে। জঙ্গলের ভিতর পথ করে চলতে হচ্ছে। হঠাৎ বিশাল সাইজের এক মইসা জোঁক দেখে আমার শরীরে কাঁপন ধরে গেল! শাহেদ ভাইকে বললাম, এত বড় জোঁক আমি জীবনে দেখিনি!
মাঝে মাঝে কিছু বিচিত্র জীব-জন্তুর ডাক এখন শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমরা অনেক গভীরে চলে এসেছি। তাছাড়া এমন ডান শুনতে পাওয়ার কথা না। যতই এগুচ্ছি আর আমার সন্দেহ বাড়ছে, আমরা কি ঠিক পথে এগুচ্ছি! আমার সন্দেহের কথা শাহেদ ভাইকে জানালাম। যদিও তার উপর ভরসা আছে তিনি এখানকার স্থানীয় মানুষ। কিন্তু তার মুখেও দেখলাম চিন্তার ছাপ। তিনিও বললেন আমরা হয়তো পথ হারিয়েছি। এই পথটা আর চেনা লাগছে না!! আমি এমনিতেই ভীতু মানুষ! তার কথা শুনে ঘামতে থাকলাম। এই অচেনা জঙ্গলে যদি পথ হারাই মরণ ছাড়া গতি কি! সাথে শুধু কয়েকটি চকলেট-বিস্কুট আর এক বোতল পানি ছাড়া কোন খাবার নাই!
শাহেদ ভাইকে বললাম আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমার দরকার নাই। আমারে বাইর করেন তাড়াতাড়ি। উনি ফিরতি পথ খুঁজতে থাকলেন। আমরা পিছন ফিরে পথ খুঁজতে থাকলাম। আর সামনের দিকে যাব না। মনে মনে ভাবছি এডভেঞ্চার এর খেতা পুরি। যেই পরিমাণ জোঁক আর শাহেদ ভাই দেখালেন সাপের ভয়। গাছের সাথে নাকি প্যাচ দিয়ে থাকে সবুজ ভাইপার! আগে বের হয়ে নিই। ভয়ে আমার হাত-পা-বুকে কাঁপন ধরে গেল! ঘুরতে গিয়ে এত ভয় আমি জীবনে পাইনি! আমরা আগের রাস্তায় আসার চেষ্টা করছি এই অন্ধকার পথ ছেড়ে আগে আলোতে বের হয়ে নেই। তারপর অন্য চিন্তা। এমন ভাবছি আর চলছি হঠাৎ বিকটভাবে কিছু ডেকে উঠল। আমদের পিলে চমকানোর মতো অবস্থা!!
পরে জানলাম এই জঙ্গলে অনেকগুলো উল্লুক এক সাথে ডেকে উঠলে এমন ভয়ংকর শব্দ হয়। মনে হবে যেন ভয়ংকর অনেকগুলো জন্তু আপনার দিকে ধেয়ে আসছে। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কিন্তু যারা নতুন যাবে তাদের পিলে চমকানোর জন্য যথেষ্ট যদি হয় দলটা আমাদের মতো দু'জনের আর এমন গভীর জঙ্গলে। যাই হোক কোন রকমে আমরা ফিরতি পথের দেখা পেলাম। আগের রাস্তায় এসে দম ফেললাম।আরো অনেক দূর হেটে আসার পর মানুষের সাড়া শব্দ পেলাম। দ্রুত এগিয়ে চলতে থাকলাম। লোকজনের সংস্পর্শে আসার পর হার্টবিট ঠিক হল যেন। গাইড ছাড়া এই জঙ্গলে এডভেঞ্চার এর স্বাদ নিতে আসা বোকামী। বিপদে পড়তে পরেন যে কেউ!
এতক্ষণ ভয়ে ছবি তোলার কথা ভুলে গেছিলাম। মোবাইল বের করা হয় নি। আসার সময় যা ছবি তুলেছিলাম সেগুলোই আছে। বের হয়ে হাটতে হাটতে বের হওয়ার পথের দিকে এগুচ্ছিলাম আর এই বনের কাহিনী শুনছিলাম শাহেদ ভাইয়ের কাছে। এই বনের সাথে একজন ব্যাক্তির নাম ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি হলেন, এখানকার সীতেশ বাবু। এই বনের জীব জন্তুগুলোকে যেন উনি নিজ সন্তানের মতো দেখেন। যতোগুলো প্রাণী টিকে আছে চোরা শীকারীদের হাত থেকে তাতে এই লোকের অবদান বিশাল। বনে কোন প্রানীকে অসুস্থ দেখা গেলে বা ধরা পড়লে সীতেশ বাবু তার নিজের বন্য প্রাণী সেবাশ্রমে(লোকজনের ভাষায় তার চিড়িয়া খানা) নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে আবার এই বনে ছেড়ে দিয়ে যান।
সীতেশ বাবুর সাথে তার অফিসে।
এই লোকের কথা গল্প শুনতে শুনতে তাকে দেখার ইচ্ছা হল। শাহেদ ভাইকে বললাম। আমরা বন থেকে বের হয়ে বাইক নিয়ে আবার শহরের পথ ধরলাম সেই ছায়া ঢাকা পিচ ঢালা পথে। সোজা চলে গেলাম হোটেলে খাবার খেয়ে এবার আমরা গেলাম সীতেশ বাবুর বাসা কাম অফিসে। তার সাথে দেখা করে চলে গেলাম তার বন্য প্রানী সেবাশ্রমে। ছোট্ট একটা চিড়িয়াখানার মতোই তার এই সেবাশ্রম। দশ টাকা টিকিট। তবে শাহেদ ভাইয়ের পরিচিত হওয়ার কারণে আমাদের টিকিট লাগল না।
সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা।
ওখান থেকে বের হয়ে দেখতে চাইলাম হাইল হাওড়। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে ফিরে এলাম শহরে।আমার জন্য বরাদ্দ শাহেদ ভাইয়ের বোনের বাসায় গিয়ে অজু করে আসর সালাত আদায় করে চললাম রেল ষ্টেশনের উদ্দেশ্য। গিয়ে টিকেট করে শাহেদ ভাই আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। বিদায় শাহেদ ভাই, আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সিতেশ বাবুর চেহারা এরকম কেন ?
ট্রেইল ধরে হাটলেই অন্য রাস্তা দিয়ে বের হতে পারতেন তবে তখন পার্কিং এ যেতে মনে হয় অনেক সময় লাগত। লাউয়া ছড়া জঙ্গল এর ভিতর দিয়ে যাওয়া রেললাইন এর ধারে অপটিক্যাল ফাইবার এর অনেক কাজ করেছি একসময়। লাউয়াছড়ার এক প্রান্তে সেই মাগুড়ছড়া গ্যাসফিল্ড এর কাছাকাছি জায়গায় আমার জিবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কাজের সময় পায়ের ইঞ্চিখানেক দুর দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি গোল্ডেন কোবরা!!!
উল্লুক এর ডাক শুনে ভয় আমিও পেয়েছিলাম। হরিন চোখে দেখার অভিজ্ঞতা আছে একবার মাত্র যদিও ৬-৭ মাস সময় এর মধ্যে ১০-১২ বার গিয়েছি সেখানে। সিতেশ বাবু একসময় নামকরা শিকারি ছিলেন। পশু-পাখি সম্পর্কে খুব উচ্চ জ্ঞান রাখেন তিনি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন