খৈয়াছড়া এডভেঞ্চার।(Khoia chora Adventure)
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:২৫:০০ দুপুর
বেশকিছুদিন যাবৎ প্লান করছি আমরা কয়েকজন খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাব। কিন্তু প্লান করেও কাজ হচ্ছিল না। দুইজন ফাইনাল করে তো চারজন সমস্যা দেখায়!
টিম লিডারের নির্দেশ এ যাত্রা শুরু!
অবশেষে সিদ্ধান্ত হল আমি, ওহিদ ভাই, খান ভাই তিন জনই যাব। আর দেরী করব ন। এবারের ১৫ই আগষ্টের সরকারী ছুটিতে। আমরা মোট তিন জন ফাইনাল করলাম। শেষে এসে আতাউল্লাহ ভাই আর সজিব ভাই যোগ দিলেন। মোট পাঁচ জনে মিলে যাত্রা শুরু করলাম।
চলছি আমরা ক'জন।
নির্ধারিত রাতে(১৪ই আগষ্ট,২০১৬) হানিফ পরিবহন কাউন্টারে সবাই একসাথে হইলাম। বাস ছাড়ল প্রায় রাত একটায়। গাড়ীর উল্টপাল্টা গতিতে সবাই ভয়ে অস্তির! এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। কুমিল্লায় হোটেলে বাস থামলে ঘুম শেষ। ওহিদ ভাই অজু করে বাসে উঠেছিলেন। তিনি সময় মতো ফজর সালাত আদায় করলেন।
যাওয়ার পথের সৌন্দর্যের কথা আর কিতা কইতাম!
ভোর সাড়ে পাঁচটায় নামলাম বড়তাকিয়া বাজরের কাছাকাছি। সামান্য উত্তরে হেটে এসে একটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সা নিয়ে, আমাদের নির্ধারিত গাইড ফখরুল সাহেব এর বাসার উদ্দেশ্যে চললাম।কিছুদূর যাওয়ার পর অটোরিক্সা আর চলে না! বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ! অগত্য নেমে পুরা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দিলাম হাঁটা।
পাহাড়ি এই রাস্তায় একখান বাড়ি কত্তাম চাই!
ফখরুল ভাইয়ের ঘরোয়া টাইপ হোটেলে ব্যাগ রেখে পাশেই ছড়ার ওপারে পাহাড়ের উপর গেলাম ছোট একটা মসজিদে ফজর সালাত আদায় করতে।
সালাত আদায় করে এসে সকালের নাস্তা সেরে আমরা দেরী না করে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রওয়ানা করলাম খৈয়াছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। সাথে গাইড হিসেবে দিলেন ফখরুল ভাইয়ের ভাগিনা তারেককে।সবার হাতে একটি করে লাঠি।
পাহাড়ি রাস্তায় চলতে বিশ্রাম প্রয়োজন।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম খৈয়াছড়া যেতে লাঠি কতোটা কাজে দেয়! পাহাড়ী ভয়ংকর উচুনিচু রাস্তায় তারেক যেভাবে চলতে লাগল, সেটা দেখে খান ভাই ওর নাম দিলেন শাখা মৃগ! ছেলেটিকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। সে গাইড হিসেবে পারফেক্ট। পাহাড়ি পাথুরে-পাখিডাকা-ছায়া সুনিবিড় রাস্তা দিয়ে চলার সময় মন হারিয়ে যাবে কোথায় খুঁজে পাবেন না!
মাঝে মাঝে গাইড ছেলেটি হারিয়ে যায়!
সুবহান আল্লাহ! সুবহান আল্লাহ! চলছি আর দেখছি! দেখছি আর চলছি! মহান আল্লাহ তা'আলা প্রকৃতিকে কতো সুন্দর করে সাজিয়েছেন। সেই অদেখা সৌন্দর্য দেখে আমি বিমোহিত হয়ে যাই! অভিভূত হয়ে যাই! মন চায় এখানে ফিরে আসি বার বার। বিশাল বিশাল সবুজবৃক্ষে ঢাকা পাহাড়গুলো যেন সেই আমন্ত্রণ জানায় তার অপরূপ সৌন্দর্যে ঢাকা শরীর দিয়ে। চলছি কখনও উচু পাহাড়ের উপর দিয়ে, কখন পাহাড়ের নিচের রাস্তা দিয়ে, কখনও ঢালু সমতলে, কখনওবা পাহাড়ী ছড়া(ঝর্ণা) ধরে।
একা চলায় ভয় আছে!
কিছু কিছু রাস্তা পাড়ি দিতে হয়েছে ভয়ংকর। গাছের শিকড় ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে। পিচ্ছিল খাড়া-ঢালু রাস্তাগুলো বৃষ্টিতে মারাত্বক হয়ে আছে! কিন্তু আমাদের গাইড তারেক লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে সবার আগে আগে। তার কাছে এসব যেন কোন ব্যাপারই না! তবে আমাদের কষ্ট হলেও যা উপভোগ করছি সেই অবারিত সৌন্দর্য ঘরে বসে থেকে আমরা কোথায় পাব!
দেহেন উপ্রে উঠে কেমনে!
প্রকৃতির দুহাতে ঢেলে দেয়া অপার সৌন্দর্য এভাবে গিলতে গিলতে একসময় আরো বিশাল এক সৌন্দর্যের দেখা পেলাম! ভাবলাম এটাই বোধ হয় শেষ! পরে আর কিছু নাই! কিন্তু আমাদের গাইড বলল, এখনও শুরুই হয়নি ঝর্ণা! এটা মাত্র আগের দেখা ওই ছড়া গুলোর উপরের দিক! মূল ঝর্ণায় যেতে আরো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে!
এরা সাক্ষী দেয় তাওহীদের।
ওদের কাছে সামান্য এই সৌন্দর্যে আমি বেকুব হয়ে ঝিরি ধরে চলতে চলতে এক সময় উপরে উঠলাম। কানে এল উপর থেকে পানি পড়ার মনোমুগ্ধকর সংগীত। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যখন সাদা ফেনার মতো জলরাশির কিছু অংশ পড়া দেখলাম, মনে হচ্ছিল পুরা দেখলে, আমি সেই সৌন্দর্যে জ্ঞান হারাব! মরেই যাব!! বাঁচাতে পারবে না কেউ!!!
বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ অনুভূতি নিয়ে যখন তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম মনে হচ্ছিল এই সৌন্দর্য এত দিন আমরই জন্য অপেক্ষায় ছিল! আমকে পেয়ে সে যেন আরো উজাড় করে মেলে ধরল তার লুকায়িত রূপযৌবন। আমি অপেক্ষা না করে ঝাপিয়ে পড়লাম তার কোলে!
দীর্ঘ সময় তার সাথে জলকেলি করে উঠে আসলাম। এবার আরো উপরে উঠব পরের ঝর্ণাগুলো দেখার জন্য। উপরে নাকি আরো আটটি ঝর্ণা আছে ধাপে ধাপে। কিন্তু খাড়া পাহাড় ধরে চিকন একটা দড়ি বেয়ে কিছুদূর উঠে সাহস হারিয়ে ফেললাম! ভাবলাম জীবনে আরো অনেক দেখতে হবে। এই বয়সে আর প্রাণটা খোয়াতে চাইনা।বাকীদের সৌন্দর্য আর উপভোগ করা হলো নাগো সখী! পরে এক সময় আসমুনে ইনশা আল্লাহ। এই বলে সোবহান আল্লাহ বলতে বলতে নামতে থাকলাম বহু কষ্টে। উঠার চেয়ে নাম যেন আরো বেশি কঠিন হয়ে গেল!
আমিও যেখানে যাই বলি তাওহীদের কথা।
নিচে নেমে একটু বিশ্রাম নিয়ে চকলেট-ওয়েফার কিছু খেয়ে। আমি শুরু করলাম ঝর্ণার পানিতে-আশপাশে পর্যটকদের ফেলা ময়লা কুড়ানো। কুড়িয়ে সব এক জায়গায় করলাম। অনেক হল। তারপরও সব শেষ করতে পারলাম না! আপনারা ঘুরতে যান ভাল কথা, কিন্তু আপনার পরেও আরো অনেকেই যাবে, অন্তত তাদের জন্য পারিবেশটা সুন্দর রেখে আসুন।
চলতে পথে একটা থামিলাম।
এক সময় ফেরার তাগিদ অনুভব করলাম। কিন্তু আমাদের দু'জন উপরে উঠে গেছে রিস্ক নিয়ে। তাদের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে ফিরতি পথ ধরলাম। তখন অলরেডি সকাল নয়টা বেজে গেছে! ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের যে আবার নাপিত্তাছড়ার পথ ধরতে হবে। সময় বড় কম! তাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সেই আগের সৌন্দর্যময় পথ ধরে চলে এলাম ফখরুল ভাইয়ের ঘরোয়া হোটেলে। ঠিক দুপুর দশটায় লাঞ্চ সেরে আমরা রওয়ানা করলাম নাপিত্তাছড়ার উদ্দেশ্যে।
যেভাবে যাবেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে উঠে নামতে হবে বড়তাকিয়া বাজার। সেখান থেকে মেইন রোড ধরে সামান্য উত্তরে হেটে এসে দেখবেন রাস্তা নির্দেশ করে সাইনবোর্ড দেয়া আছে খৈয়াছড়া ঝর্ণা।সোজা চলে যাবেন রেল রাস্তা পার হয়ে। গাইড নিতে চাইলে সেখানকার স্থানীয় গাইড ফখরুল(০১৮৩০৬৬২১৮২) ভাই খুব হেল্পফুল। অথবা তার ভাগিনা তারেক-০১৮৭৪২৩৪৭৮৬)
আমাদের গাইড তারেক।
অপচনশীল ময়লা আবর্জনা (স্যালাইনের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট, চকলেটের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিন, ব্যাটারী, পানির বোতল, সিগারেটের ফিল্টার) ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই যেখানে-সেখানে ফেলবেন না। সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন এবং নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন।অসচেতন পর্যটকদের ময়লা ফেলা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগল!
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময়ও আমাদের সতর্ক হতে হবে। মলমূত্র ত্যাগ করতে হবে পানির প্রবাহ আছে এমন যায়গা থেকে দূরে, যাতে এর মাধ্যমে পানি বাহিত রোগ না ছড়ায়। কোন কোন পর্যটক পাথরের চিপায়চাপায় প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে দূর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে!
প্রয়োজনীয় তথ্য
খৈয়াছড়া জলপ্রপাতের পুরো এলাকাটিই বেশ পিচ্ছিল। এ ভ্রমণে ট্র্যাকিং স্যান্ডেল ব্যবহার করা উচিৎ। যাদের পাহাড়ে উঠার অভ্যাস নেই তাদের উপরের ধাপগুলোতে না যাওয়াই ভালো। এছাড়া পিচ্ছিল বলে ধাপগুলোর পাশে যাওয়াও ঠিক হবে না।
সবগুলো ধাপ দেখতে চাইলে সঙ্গে শক্ত রশি নেওয়া উচিত। ওঠা কিংবা নামার সময় রশির সাহায্য নিয়ে কষ্ট কম হবে।
তাড়াহুড়া করে ওঠা কিংবা নামা উচিৎ হবে না। সঙ্গে ওয়াকিং স্টিক নিলে ভালো হয়। বৃষ্টি থাকলে এ পথে কিছুটা জোঁকের উপদ্রব থাকে। তখন পায়ে মোজা পরে নিলে সুফল পাওয়া যাবে।
খৈয়াছড়া বেড়ানোর জন্য স্থানীয় গাইডের সহায়তা নিলে ভ্রমণটি সহজ হবে। খুব বৃষ্টি হলে সাবধান থাকতে হবে। এ সময়ে পাহাড় থেকে বড় ধরনের ঢল নামে।
আর নাপিত্তাছড়ার গল্প অন্যদিন।
-
পিছে পড়েন কেন ভাইয়েরা? একটা পা চালান।
যাবতীয় খরচের হিসাবটা আমাকেই রাখতে হয়েছে।
ঝর্ণার জলের শীতল পরশ গরমে আরাম দেয়।
চলতে পথে ফাঁকে ফাঁকে ছবি তোলা।
মানুষের কান্ডজ্ঞান নাই! যেখানে খায় সেখানে হাগে!
হালকা বিশ্রামে দুই ভাই।
Live Like a Traveler in Dunya.
বিষয়: বিবিধ
২০৮৭ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুধু রাস্তা নয় ভাই। অসচেতন পর্যটকরা পাথরের ফাঁকেফুকে যেখানে সেখানে হেগে দূর্গন্দময় করে রেখে আসে।
আমাদেরও দেখানোর জন্য শুকরিয়া, জাযাকুমুল্লাহ
বারাকাল্লাহুমা ফিকুম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন