হাদীস পরিচিতি ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পরিভাষা!

লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৯ মে, ২০১৬, ১২:১০:৫৫ দুপুর

হাদীস এর সংজ্ঞা:

হাদীস এর শাব্দিক অর্থ: উক্তি, নতুন।

ইসলামের পরিভাষায়: হযরত রাসূল স. এর সকল কথা, কাজ, অনুমোদন এবং তাঁর যাবতীয় গুণবলীর বিবরণকে হাদীস বলে।

সনদ: রাসূলুল্লাহ স. থেকে শুরু করে সর্বশেষ হাদীস বর্ণনাকারী পর্যন্ত বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতাকে সনদ বলে।

মাতনঃ হাদীসের মূল শব্দাবলী ও বাক্যকে মাতন বলে ।

মুহাদ্দীসঃ যিনি হাদীস চর্চা (বর্ণনা ও গবেষণা) করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ, মতন ও হাদীস বর্ণনাকারীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকে মুহাদ্দীস বলে ।

সুন্নাহ: সুন্নাহ শব্দের অর্থ হল, কর্মনীতি ও পদ্ধতি। হাদীস এর অপর নাম সুন্নাহ হলেও উভয়ের মাঝে সামান্য পার্থক্য বিদ্যমান।

হাদীস ও সুন্নাহ এর মাঝে পার্থক্য: সুন্নাহ হল রাসূল স. এর কর্মনীতি আর হাদীস বলতে, রাসূল স. এর কর্ম ছাড়াও তাঁর কথা, অনুমোদন ও গুণাবলীকে বুঝায়।

হাদীস এর প্রকারভেদ:

সামগ্রিক বিবেচনায় হাদীসকে প্রথমত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

সহীহ্ হাদীসঃ যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উদ্ধৃত প্রত্যেক বর্ণনাকারীই নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এবং হাদীসটি সকল ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত, তাকে সহীহ হাদীস বলে ।

হাসান হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর স্মৃতি শক্তি কিছুটা দুর্বল বলে প্রমাণিত তার বর্ণিত হাদীসকে হাসান হাদীস বলে ।

যায়ীফ হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী কোন হাসান বর্ণনাকারীর গুণ সম্পন্ন নয় তার বর্ণিত হাদীসকে যায়ীফ হাদীস বলে ।

বর্ণনাকারী হিসেবে হাদীস ৩ প্রকার।

১. মারফু হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনা পরাম্পরা রসূল স. থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলন কারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান দিয়ে কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ যায়নি তাকে মারফু হাদীস বলে ।

২. মাওকুফ হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র সাহাবী রা. পর্যন্তু পৌছে হাদীসে মওকুফ বলে।

৩. মাকতু হাদীসঃ যে সকল হাদীসের বর্ণনা পরাম্পরা কোন তাবীঈ পর্যন্তু পৌছে তাকে হাদীসে মাকতু বলে ।

বর্ণনা কারীর সংখ্যা হিসেবে হাদীসকে নিম্নোক্ত ভাগে বিন্যাস করা হয়েছে:

মুতাওয়াতির হাদীসঃ যে সব হাদীসের সনদে বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত অধিক যে তাদের সম্মিলিতভাবে মিথ্যার উপর ঐক্যবদ্ধ হাওয়া অসম্ভব, আর এই সংখ্যাধিক্য যদি সর্বস্তরে থাকে তবে তাকে মুতওয়াতির হাদীস বলে।

আহাদ হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা মুতওয়াতিরের সংখ্যা পর্যন্ত পৌছায়নি তাদের আহাদ হাদীস বলে ।

মাশহুর হাদীসঃ যে সব হাদীসের বর্ণনাকারী তিন বা তিনের অধিক হবে কিন্তু মুতওয়াতির পর্যন্তু পৌছাবেনা,এমন হাদীসকে মাশহুর হাদীস বলে ।

আযীয হাদীসঃ যে সহীহ হাদীস প্রতিস্তরে কমপক্ষে দুজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে আযীয হাদীস বলে ।

গরীব হাদীসঃ যে সহীহ হাদীসের কোন স্তরে মাত্র একজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে গরীব হাদীস বলে।

শায হাদীসঃ যে হাদীস কোন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী একাকী বর্ণনা করেছেন এবং তার সমর্থনে অন্য কোন হাদীস পাওয়া যায়না তাকে শায হাদীস বলে ।

এ ছাড়াও হাদীসের বিভিন্ন দিকে লক্ষ রেখে হাদীসের প্রকারভেদের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেছেন। হাদীস বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করার ক্ষেত্রে এ সব পরিভাষা সবিশেষ জানা থাকা প্রয়োজন হয়।

১. মুত্তাসিল হাদীসঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর ধেকে নীচ পর্যন্তু পূর্ণরূপে রক্ষিত রয়েছে এবং কোন স্তরেই রাবীর নাম বাদ পরেনি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে ।

২. মুনকাতে হাদীসঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানের কোন এক স্তরের কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতে হাদীস বলে ।

৩. মুরছাল হাদীসঃ সনদের মদ্ধে তাবীঈ এর পর কোন বর্ণনা কারীর নাম বাদ পরলে তাকে মুরছার হাদীস বলে ।

৪. মু‘দাল হাদীসঃ যে হাদীসের সনদের মধ্য ধেকে পর্যায়ক্রমে দুই জন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পরেছে তাকে মু,দাল হাদীস বলে ।

৫. মুদাল্লাছ হাদীসঃ যে সব হাদীসে রাবী উদ্ধতন রাবীর সন্দেহ মুক্ত শব্দ প্রয়োগে উল্লেখ করেছেন, তাকে মুদাল্লাছ হাদীস বলে ।

৬. মুআল্লাল হাদীসঃ যে হাদীসের সনদে বিশ্বস্ততার বিপরীত কার্যাবলী গোপনভাবে নিহিত থাকে ,তাকে মুআল্লাল হাদীস বলে ।

৭. মুআল্লাক হাদীসঃ যে হাদীসে সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পরেছে ,তাকে মুআল্লাক হাদীস বলে ।

৮. মুযতারিব হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী মতন ও সনদকে বিভিন্ন প্রকার এলোমেলো করে বর্ণনা করেছেন ,তাকে মুযতারিব হাদীস বলে ।

৯. মুদরাজ হাদীসঃ যে হাদীসের মধ্যে বর্ণনাকারী তার নিজের বা কোন সাহাবী বা তাবিঈর উক্তি সংযোজন করেছেন তাকে মুদরাজ হাদীস বলে ।

১০. মুসনাদ হাদীসঃ যে মারফু হাদীসেব সনদ সম্পুর্ণরূপে মুত্তাসিল তাকে মুসনাদ হাদীস বলে ।

১১. মুনকার হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী দুর্বল ( হাদীস বর্ণনা করার যাবতীয় গুণাবলী যার মাঝে পাওয়া যায়নি) এবং তার বর্ণিত হাদীস যদি অপর দূর্বল হাদীস বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থি হয়, তবে তাকে মুনকার হাদীস বলে ।

১২. মাতরুক হাদীসঃ হাদীসের বর্ণনাকারী যদি হাদীসের ব্যাপারে মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে কথায় মিথ্যা প্রমাণিত হয় ,তবে তার বর্ণিত হাদীসকে মাতরুক হাদীস বলে ।

১৩. মাওযু হাদীসঃ বর্ণনাকারী যদি সমালোচিত ব্যাক্তি হন আর যদি তিনি হাদীস বর্ণনায় মিথ্যাবাদী হন তবে তার বর্ণিত হাদীসকে মাওযু বা বানানো হাদীস বলে ।

১৪. মুরহাম হাদীসঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না যার ভিত্তিতে তার দোষ গুণ বিচার করা যেতে পারে এ রূপ বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদিসকে মুরহাম হাদীস বলে ।

১৫. মারফু হাদীসঃ কোন দূর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস যদি অপর কোন দূর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হয় তবে অপেক্ষাকৃত কম দূর্বল বর্ণনাকারীর হাদীসকে মারফু হাদীস বলে ।

১৬. মুতাবি হাদীসঃ এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি আপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবির হাদীসকে প্রথম রাবির হাদিসের মুতাবি বলে ।

হাদীস সংক্রান্ত আরো কিছু পরিভাষা:

১. মুত্তাফাকুন আলায়হিঃ যে হাদীস ইমাম বুখারী র. ও ইমাম মুসলিম র. স্ব স্ব গ্রন্থে সংকলন করেছেন। এরূপ হাদীসকে মুত্তাফাকুন আলায়হি বলে ।

২. আদালাতঃ বর্ণনাকারী মুসলিম, প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞানী, ফিসকের উপায় উপকরণ থেকে মুক্ত এবং মানবতা ও শিষ্টাচার বিরোধী কর্মকান্ড থেকে দুরে থাকাকে আদালাত বলে ।

৩. যাবতঃ কোন হাদীস বর্ণনাকারীর নিকট থেকে শ্রুত বিষয়কে জড়তা এবং বিনষ্টের হাত থেকে এমনভাবে সংরক্ষণ করা যেন তা যথাযথ ভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হয় । এই গুণাবলীকে যাবত গুণ বলে ।

৪. ছিকাহ সাবিতঃ যে বর্ণনাকারীর মধ্যে আদালাত ও যাবত পূর্ণ ভাবে বিদ্যমান থাকে তাকে ছিকাহ সাবিত বলে।

৫. শায়খঃ হাদীসের শিক্ষাদানকারী বর্ণনাকারীকে শায়খ বলে ।

৬. শায়খাইনঃ সম্মানিত মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী র. ও মুসলিম র. কে শায়খাইন বলে ।

৭. হাফিজঃ যিনি হাদীসের সনদ ও মাতনের সমস্ত বৃত্তান্ত সহ এক লাক হাদীস মুথস্ত করেছেন তাকে হাফিজ বলে ।

৮. হুজ্জাতঃ যিনি তিন লাখ হাদীস মুখস্থ বা আয়ত্ব করেছেন তাকে হুজ্জাত বলে ।

৯. হাকিমঃ যিনি সমস্ত হাদীস সনদ মাতন সহ মুখস্ত করেছেন তাকে হাকিম বলে ।

১০. রিজালঃ হাদীসের বর্ণনাকারীর সমুষ্টিকে রিজাল বলে ।

১১. রেওয়ায়েতঃ হাদীস বর্ণনা করাকে রেওয়ায়েত বলে ।

১২. সিহাহ সিত্তাহঃ হাদীস শাস্ত্রের প্রধান ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের সমষ্টিকে সিহাহ সিত্তাহ বলে ।

১৩. হাদীসে কুদসীঃ যে হাদীসের ভাব ও অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে আর ভাষা রাসূল স. এর পক্ষ থেকে। এসব হাদীসকে হাদীসে কুদসী বলে।

১৪. সহীহাইনঃ বুখারী ও মুসলিম শরীফকে একসাথে সহীহাইন বলে ।

১৫. রাবীঃ হাদীস বর্ণনাকারীদের বলা হয় রাবী ।

১৬. সিকাহ রাবীঃ যে হাদীস বর্ণনাকারীর মাঝে আদালাত ও যাবত গুণাবলী পূর্ণ মাত্রায় আছে তাকে সিকাহ রাবী বলে।

১৭. আছারঃ সাহাবায়ে কেরামদের কথা ও কাজকে আছার বলে।

উল্লেখ্য: উল্লেখিত এ সব পরিভাষার মধ্যে এমন অনেক শব্দ রয়েছে যেসব শব্দ অন্যত্র ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। হাদীস শাস্ত্রের ক্ষেত্রে কেবল এমন অর্থ প্রকাশ করে থাকে। যেমন, হাফিজ এর অর্থ এখানে এক রকম হলেও অন্যত্র এর ভিন্ন সকলের জানা।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৯ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370401
২৯ মে ২০১৬ দুপুর ০৩:১৭
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ماشاءالله جزاكالله خيرا খুবই তাৎর্পয্য পূর্ণ লেখা অনেক ভালো লাগলো অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
০৪ জুন ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩
307796
নেহায়েৎ লিখেছেন : জাঝাকাল্লাহু খাইরান। অনেক ধন্যবাদ।
370423
২৯ মে ২০১৬ রাত ০৮:১২
শেখের পোলা লিখেছেন : এতো দেেখি রীতিমত ধাঁধার বিষয়। ধন্যবাদ।
০৪ জুন ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩
307797
নেহায়েৎ লিখেছেন : আসলে বুঝতে সমস্যা হলে ধাঁধার মতো। কনস্পেট দরতে পারলে সহজ।
370430
২৯ মে ২০১৬ রাত ০৮:৪০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৪ জুন ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩
307798
নেহায়েৎ লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
370455
৩০ মে ২০১৬ রাত ০৩:২৭
ধ্রুব নীল লিখেছেন : এত্তগুলা? বর্ণনাকারী পর্যন্ত জানি।
ভাইয়া, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের "হাদিসের নামে জালিয়াতি" বইটি আছে আপনার কাছে?
370535
৩১ মে ২০১৬ দুপুর ০২:৩৪
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইরান।

হাসান হাদীসের মর্যাদা সহীহ হাদীসের কাছাকাছি এবং এটি গ্রহণযোগ্য। এর সংজ্ঞাটি আবার একটু চেক করবেন প্লিজ। আপনি অবশ্য সংক্ষেপে অনেকগুলি টার্ম আলোচনা করেছেন। বিস্তারিত বোঝার জন্য সংজ্ঞাগুলি আরো বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
০৪ জুন ২০১৬ দুপুর ১২:৩৪
307800
নেহায়েৎ লিখেছেন : জি ভাই হাসান হাদীস গ্রহণ যোগ্য। মানে সহীহ হাদীসের কাছাকাছি। বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File