ভ্রমণ বিরম্বনা কাকে বলে!!!
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৩:০৬:১৯ দুপুর
অনেক দিনের প্লান ছিল রাঙ্গামাটি ঘুরতে যাব বউ নিয়ে। আমি ব্যাচেলর থাকা অবস্থায় কয়েকবার গেছি। কিন্তু আমার বউ কখনও রাঙ্গামাটি যায় নি। মূলত তার জন্যই এই ভ্রমণের প্লান।আমার এক পাড়াত ভাতিজা সেনা সদস্য, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আরণ্যক ইকো কটেজ এর দায়িত্বে আছে।সে বার বার দাওয়াত দিয়েছে কিন্তু এবার আর মিস করলাম না! বেশ কয়েকদিন আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম ডিসেম্বর এর শেষ দিকে যাব।পর্যটন মৌসুম অনেক মজাই হবে।
হোটেল হিল ভিউ এর দোতলা থেকে
দিন তারিখ ঠিক করে, টিকেট এর চিন্তা করছি। আমি ব্যস্ত থাকায় আমাদের অফিসের এডমিন অফিসার আরিফ সাহেব টিকেট করে এনে দিলেন। কনফার্ম হওয়ার জন্য কাউন্টারে গিয়ে আবার ফোন দিলেন, ভাই রাঙ্গামাটির টিকেট তো? আমি বললাম, জি রাঙ্গামাটি যাব। আরিফ সাহেব টিকেট নিয়ে এল, আমি চেক না করেই ড্রয়ারে রেখে দিলাম।
নির্ধারিত দিনে কাউন্টারে গিয়ে টিকেট বের করে দেখি আরিফ সাহেব টিকেট কেটেছেন বান্দরবানের! মাথায় হাত! আমার বউ আমার উপর রেগে চুপচাপ বসে থাকলেন!
আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম বান্দরবান হয়ে রাঙ্গামাটি যাব। এক ঢিলে দুই পাখি! খারাপ কি!
বান্দরবানের অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্য!
কি আর করা অবশেষে গাড়িতে উঠে দিলাম ঘুম। খুব ভোরবেলা গিয়ে নামলাম বান্দরবান শহরে।গাড়ী থেকে নেমেই বমি ননষ্টপ বমি করা শুরু করলেন তিনি! উপায় ভেবে সেখানে থেকে রিক্সা নিয়ে হোটেল হিল ভিউতে গিয়ে ম্যানেজারকে অনুরোধ করে কিছু সময়ের জন্য একটা রুম চেয়ে নিলাম। অজু করে ফজরের সালাত আদায় করে, বের হইলাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে।
লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম রাঙ্গামাটি যেতে হলে, শহর থেকে রোয়াংছড়ি যেতে হবে। তারপর ওখান থেকে রাঙ্গামাটির বাস।ভাগ্য আর কাকে বলে! রোয়াংছড়ি গিয়ে শুনলাম বাস কিছুক্ষণ আগে ছেড়ে গেছে। আজ আর কোন গাড়ি যাবে না!!!
তবে একটা গাড়ি যাবে একটা জায়গার নাম বলল সেখান পর্যন্ত। অন্যকোন উপায় না পেয়ে টিকেট কেটে সেই গাড়ীতেই উঠে বসলাম, প্রায় একঘন্টা পর গাড়ী ছাড়ল! পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে গাড়ী চলতে লাগল! কখনও দু্ইপাশে সবুজ পাহাড় কখনওবা একপাশে খাড়া পাহাড় অপর পাশে গভীর গীরিখাদ।মাঝে মাঝে দেখা যায় পাহাড়ের ঢালুতে জুম ঘর। কখনওবা কোন পাহাড়ী পাড়ার পাশ দিয়ে রাস্তা! বর্ণনাতীত সে সৌন্দর্য! এভাবেই একসময় পৌছে গেলাম নির্ধারিত বাসষ্ট্যান্ডে!
বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করতে থাকলাম(জায়গাটার নাম ভুলে গেছি)। সেখানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর জানতে পারলাম সেই বাস কখন আসবে কেউ জানে না! আজ নাও আসতে পারে! পাহাড়ী এলাকা বাঙ্গালী খুব একটা দেখা চোখে পড়ে না! সাথে মেয়ে মানুষ তাই চিন্তায় পড়ে গেলাম! যদি রাত হয়ে যায় কি করব! এদিকে আজ কটেজে বুকিং দেয়া! কয়েকজন পরামর্শ দিল এখান থেকে সিএনজি নিয়ে কর্ণফুলির ঘাটে যান। সেখান থেকে সাম্পানে নদী পার হয়ে ওপারে আবার সিএনজি পেতে পারেন লিচু বাগান পর্যন্ত। অনন্যপায় এছাড়া আর কোন গতি নাই! সিএনজি নিয়ে চলতে থাকলাম একটু একটু ভয় ভয় লাগছে! তবে রাস্তার দুপাশের ভয়ংকর সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে দিচ্ছে।
অপরূপা সৌন্দর্য দর্শন করতে করতে এক সময় পৌছে গেলাম কর্ণফুলির ঘাটে(যদিও মনের মাঝে ভয়)। ঘাটে গিয়ে পেলাম ছোট একটা ফেরি (গাড়ী পারাপার হয়)। ফেরিতে ওপারে গিয়ে একটু হেঁটে সিএনজিতে করে লিচু বাগান গেলাম। সেখানে থেকে আবার সিএনজি বদল করে, আবার চলা শুরু রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। অবশ্য সকাল থেকেই একটু পর পর আনোয়ার(পাড়াত ভাতিজা) সেনাবাহিনীর কর্পোরাল বার বার
খোঁজ নিচ্ছে কখন কোথায় আছি। সেই কারণে ভয়ের মাঝে কিছুটা সাহস সঞ্চয় হচ্ছে।
দুপুরের দিকে সিএনজি আমাদের নামিয়ে দিল তিন পাহাড় ঘেরা আধো অন্ধকার আধো আলো মতো একটা জায়গায়। গা ছম ছম করা একটা পরিবেশ! ভয়ে ভয়ে সিএনজি থেকে নেমে দেখি তিন দিকে তিনটা রাস্তা চলে গেছে। পুরারাস্তাসহ জায়গাটা স্যাতসেতে শ্যওলাপড়া! এক পাহাড়ী লোক কয়েকটি আখ নিয়ে বসে আছে। আর দাড়ানো আছে দুই/তিনটি সিএনজি! আর সিএনজি চালক ছাড়া লোকজন বলতে তেমন কেউ নেই!! আমি দ্রুত একটা সিএনজি ঠিক করে নিয়ে এবার ডাইরেক্ট রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে চললাম। আর নামানামি নাই!
রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে!
রাঙ্গামাটির চোখ জুড়ানো বেসম্ভব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অবশেষে এক সময় পৌছে গেলাম রাঙ্গামাটির সেনা চেকপোষ্ট, যেখানে আমাদের নামার কথ। নামতে দেখি একজন সেনা সদস্য এগিয়ে এল। আনোয়ার কটেজের গাড়ী পাঠিয়েছে। তিনি আমাদের নিয়ে কটেজে গেলেন।
গিয়ে পৌছালাম তিনটার দিকে, রুমে গিয়ে অজু করে জোহরের সালাত আদায় করে নিলাম। তারপর সোজা ডাইনিংয়ের দিকে! কাপ্তাই লেকের তাজা মাছ, মুরগী, ডাল, সবজি, ডিম দিয়ে সেরে নিলাম দুপুরের খাবার।
কটেজ ডাইনিং এ খাওয়ার ব্যাপক আনন্দ লাগছে!
লাঞ্চ সেরে আশ-পাশটা ঘুরে দেখে নিলাম। অনুমতি নিয়ে কটেজ এর সামনে আমলকি গাছ থেকে কিছু আমলকি পেড়ে নিলাম।
আরণ্যক ইকো কটেজ।
সেনাবাহিনী কত সুন্দর করে লেকের মাঝের এই পাহাড়টাতে সাজিয়েছে। এখান থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায় লেকের সবুজ পানি। দূরের-কাছের পাহাড়গুলো! এত সৌন্দর্য সহ্য করা কঠিন। এটা লেখে বুঝানো সম্ভব নারে ভাই!
সেদিন যেটুকু সময় হাতে ছিল আশ-পাশে ঘুরে দেখে কাটালাম। পরদিন যাওয়ার কথা শুবলং।সেনাবাহিনীর একটা স্পীডবোট যাবে! কিন্তু দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে না যাওয়াতে গেলাম ঝুলন্ত সেতু দেখতে। সেদিন রাঙ্গামাটি শহর আর সেতুর আশ-পাশ দেখে শেষ করলাম।
আগের দিন না হওয়ায় পরদিন সেনাবাহিনীর একটা স্পীডবোটে আমাদের শুবলং যাওয়ার কথা। কিন্তু একেই বলে ভাগ্য সেদিনও স্পীডবোট গেল না! তাই দুপুর থেকে আমরা আমরা আবার শহর দেখা শুরু করলাম।রাজবিহার রাজবাড়ী দেখে শহরের বস্ত্রমেলা থেকে কিছু কাপড় কিনলাম।
রাজবন বিহার রাঙ্গামাটি।
আর কতো অপেক্ষা করা যায় সেদিনই আমাদের কক্সবাজার চলে যাওয়ার কথা কিন্তু তিনি শুবলং না দেখে যাবেন না! অগত্য পরদিন নিজেরাই একাট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে রওয়ানা করলাম শুবলংয়ের উদ্দেশ্যে।
শুবলংয়ের পথে।
চলছি তো চলছি যেন এই পথ আর সৌন্দর্যের কোন শেষ নাই! সুবহান আল্লাহ! আল্লাহু আকবার! মহান আল্লাহ তা'আলা এসব কি তৈরী করে রেখেছেন! আমাদের দেশটা এত সুন্দর ক্যারে!
রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলা!
রাঙ্গামাটি থেকে শুবলং যাওয়ার পথে যে অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-বিছিয়ে আছে, কার সাধ্য আছে লিখে তার বর্ণনা দেয়। যাওয়ার পথে কয়েক জায়গাল নামলাম। তার মাঝে একটা হল পেদাটিং টিং রেষ্টুরেন্ট।
পেদাটিং টিং রেষ্টুরেন্ট। আসার পথে এখানে লাঞ্চ করা যায়। তবে যাওয়ার পথে অর্ডার দিয়ে যেতে হয়। এই সব সৌন্দর্য গিলতে গিলতে পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্য শুবলং ঝরণা!
নৌকা থেকে নামার আগেই এই ছবিটা তুললাম। নেমে টিকেট কেটে কিছু সময় সেখানে ঘুরে দেখে কিছু ছবি তুলে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। সন্ধ্যার পর ঢাকায় যাওয়ার জন্য টিকেট কাটা আছে। গাড়ী ধরতে হবে।
একটা ছবি তোলার পোজ দিলাম।
বিকেল বেলা আমাদের নৌকা আমাদের নামিয়ে দিল ঝুলন্ত সেতুর কাছে সেখান থেকে সিএনজিতে করে আমাদের হোটেলে। আসরের সালাত আদায় বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। মাগরিবের সময় উঠে সালাত আদায় করে, রেডি হয়ে হোটেল ছেড়ে। খাবার একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে সোজা গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম।গন্তব্য ঢাকা! কক্সবাজার এবার যাওয়া হল না রাঙ্গামাটিতে দুইদিন বেশি থাকায়। পরেরবার ইনশা আল্লাহ কক্সবাজার। এবারের মতো বিদায়।
আরণ্যক ইকো কটেজ।
-
(বি: দ্র:- এ কাহিনী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের!)
বিষয়: বিবিধ
২৯৩৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি সিএ পড়াকালীন পিডিবির আওতাধীন কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র অডিট করেছিলাম। দুই মাস ছিলাম কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। তখন কাপ্তাই হতে নৌকাযোগে গিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি। পরবর্তীতে একই পথে আরো কয়েকবার গিয়েছিলাম। বউকে নিয়েও গিয়েছিলাম পরে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। সত্যিই অনিন্দ্যসুন্দর সব দৃশ্য। চট্টগ্রাম হতে কাপ্তাই যেতে রাউজান রাঙ্গুনিয়ার পর হতে কাপ্তাই পর্যন্ত দৃশ্য খুব চমৎকার। উঁচু পাহাড় হতে দেখা নিচে লেকের স্বচ্ছ পানিতে উড়ছে পাখির ঝাঁক। ছবিটি ২০০৩ সালের তোলা-
সত্য বলেছেন, অসাধারণ সে দৃশ্য! ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।
হাহাহাহা.....তবে কাহিনীটা বেশ...খাবার দাবারও আছে। বেশ লাগল আমি এসব স্থানে বেশ কয়েকবার গেছি,তবে শুভলং যাওয়া হয়নি
জি ইনশা আল্লাহ একবার শুভলং(ওরা লেখে সুবলং) দেখে আসার চেষ্টা করবেন দেশে আসলে। অসাধারণ সুন্দর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন