ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (দ্বিতীয় অধ্যায়)-০১
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ৩০ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:১৪:০৭ সকাল
নাজদের অবস্থা :
ভৌগলিকভাবে জাযীরাতুল আরবের এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও নাজদের রাজনৈতিক ইতিহাস অতীতে তেমন সমৃদ্ধ ছিল না। হিজরী তৃতীয় শতকে আববাসীয় আমলে সর্বপ্রথম নাজদ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৫৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ আল-উখায়যির এ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তখন একে ‘দাওলাতুল উখায়যিরিয়াহ’ নামে অভিহিত করা হ’ত। কিন্তু হিজরী পঞ্চম শতকের মাঝামাঝিতে নাজদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পুনরায় অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং তা পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহের অংশবিশেষে পরিণত হয়। ওছমানীয় শাসনামলে পর্বতময় নজদ অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে আরো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সেখানকার অধিবাসীরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্ষমতা দখলের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে বিশৃংখল নাজদ অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে বাইরের দুনিয়ার সাথে তাদের তেমন সম্পর্ক ছিল না।১
সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে সেখানকার ধর্মীয় আচার-আচরণেও নেমে এসেছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শিরক ও বিদ‘আতের নোংরা আবর্জনায় হারিয়ে গিয়েছিল তাওহীদ ও সুন্নাতের মর্মবাণী। বিভ্রান্ত ছূফীবাদীদের আধিপত্যে আদি ইসলামের দিশা পাওয়া ছিল নিতান্ত ভাগ্যের ব্যাপার। মানুষ আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে কবর, খানক্বাহ, গাছ, পাথর, ওলী নামধারী মুর্খ পাগল-ফকীরের ইবাদতে লিপ্ত ছিল। তারা তাদের নামে পশু কুরবানী করত ও নযর-নেয়াজ পাঠাত। সমাজে গণক ঠাকুর ও জাদুকররা লাভ করেছিল বিশেষ কদর। মানুষ তাদের কথা নির্বিবাদে বিশ্বাস করত। জ্বিনের পূজায় তারা বিশেষ অর্ঘ্য নিবেদন করত এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য নানা শিরকী উপায়-উপকরণের আশ্রয় নিত। যদিও ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতের মত মৌলিক ইবাদত তারা পুরোপুরি ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু তাদের জীবনাচরণ একজন আল্লাহবিমুখ দুনিয়াপূজারী লম্পটের চেয়ে ভিন্নতর ছিল না।২
তাদের অবস্থা ছিল প্রায় জাহেলী যুগের মুশরিকদের মতই। অজ্ঞতার নিকষ কালো আঁধার তাদের অন্তর থেকে হেদায়াতের নূর নিভিয়ে দিয়েছিল। পথভ্রষ্ট, আর খেয়াল-খুশীর অনুসারী লোকেরা ছিল তাদের নেতৃত্বে। তারা আল্লাহর কিতাব, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ধার ধারত না। পূর্বপুরুষদের বিদ‘আতী আচার-অনুষ্ঠানকেই তারা ইবাদত মনে করত এবং তাদেরকেই সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী বিবেচনা করত।৩
ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ হুসাইন বিন গান্নামের (মৃ: ১৮১১ খৃঃ) বর্ণনায় দেখা যায় যে, নজদের শহরাঞ্চলের মানুষ কবরপূজা (যেমন যিরার ইবনুল আযওয়ারের কবর), গাছপূজা (যীব ও ফুহ্হাল গাছের পূজা), পাথরপূজা (বিনতে উমায়ের পাহাড়ের পূজা), পীরপূজা (তাজুল আ‘মার পূজা)- প্রভৃতিতে লিপ্ত ছিল।৪
‘জুবাইলা’তে যায়েদ বিন খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর কবর ছিল। যেখানে লোকেরা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় প্রার্থনার জন্য যেত এবং তাদের প্রয়োজন পূরণার্থে ফরিয়াদ জানাতো। ‘দিরঈইয়া’তেও অনেক ছাহাবীর নাম সংযুক্ত কবর ছিল। যেখানে মানুষ হাজত পূরণের উদ্দেশ্যে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে যেত। সেখানে একটি গুহা ছিল যেখানে তারা নিজেদের মনষ্কামনা পূরণের জন্য গমন করত এবং খাদ্য-দ্রব্য দান করত। তাদের ধারণা ছিল, কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পালিয়ে আসা জনৈক বাদশাহর মেয়ে বিনতে উমায়ের এ গুহার নিকট আশ্রয় পেয়েছিল।৫
ইবনে বিশর বলেন, কার্যত: নাজদের প্রতিটি গোত্রে কিংবা উপত্যকায় গাছ বা কবর ইত্যাদি ছিল, যেখানে মানুষ আশীর্বাদ লাভের আশায় পড়ে থাকত। সরাসরি মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হলেও কবরপূজাকে তারা মূর্তিপূজার মতই করে ফেলেছিল। সার্বিক পরিস্থিতির চিত্রায়ন করতে যেয়ে হুসাইন বিন গান্নাম তাই যথার্থই লিখেছেন- ‘নজদবাসীদের অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, তারা আল্লাহর চেয়ে কবরবাসীদেরকেই অধিক ভয় পেত, তাই তাদের নৈকট্য লাভের আশায় তারা ব্যতিব্যস্ত থাকত, এমনকি তাদেরকেই আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রয়োজন পূরণকারী মনে করত।’৬
আর গ্রামাঞ্চলের বেদুঈনদের অবস্থা তো ছিল অবর্ণনীয়। মরুভূমির বিজন শুষ্ক বালুকাময় প্রান্তরে অজ্ঞতার নিকষ কালো অাঁধার তাদেরকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে ধরেছিল। এমত পরিস্থিতি চলে আসছিল অব্যাহতভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; যতদিন না নব উষার শুভবার্তা নিয়ে এই নজদেরই সন্তান মুজাদ্দিদে যামান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব তাঁর বিপ্লবী সমাজ সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আবির্ভূত হন।৭
১. ড. মুনীর আল-আজলানী, তারীখুল আরাবিয়াহ আস-সঊদিইয়াহ (বৈরূত : দারুল কিতাব আল আরাবী, তাবি) পৃ: ১/২৮-৩৬; ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রাগুক্ত, ১২১ পৃঃ।
২. শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দিল্লাহ বিন বায, আল ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহ্হাব : দাওয়াতুহু ও সীরাতুহু (রিয়ায : ইদারাতুল বুহূছ আল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা ওয়াদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, ২য় প্রকাশ : ১৪১১ হিঃ), ২৩ পৃঃ।
৩. হুসাইন বিন গান্নাম, রাওযাতুল আফকার ওয়াল আফহাম, তাহক্বীক: ড. নাছেরুদ্দীন আল আসাদ (বৈরূত : দারুশ শুরূক্ব, ৪র্থ প্রকাশ : ১৯৯৪ খৃঃ) ১৩ পৃঃ।
৪. হুসাইন বিন গান্নাম, প্রাগুক্ত, ১৫-১৭ পৃঃ।
৫. নূরুল ইসলাম, প্রবন্ধ : বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (রঃ), মাসিক আত-তাহরীক, ৬ষ্ঠ বর্ষ ৮ম সংখ্যা, মে ২০০৩ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ২৩ পৃঃ।
৬. হুসাইন বিন গান্নাম, প্রাগুক্ত, ১৪ পৃঃ। এই অবস্থা কেবল নজদে নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই বিরাজ করছিল। স্বয়ং মক্কায় বিভিন্ন ছাহাবীদের কবরকে কেন্দ্র করে যেমন মাযার গড়ে উঠেছিল, তেমনি খোদ রাসূল (ছাঃ)-এর কবরকেও মানুষ তীর্থস্থান বানিয়ে নিয়েছিল। এমনকি অনেকে হজ্জের চেয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারতকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করত (ইবনে গান্নাম, প্রাগুক্ত, ৫৭)।
৭. ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রাগুক্ত, ১২১ পৃঃ।
(আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব)
সূত্র- আতত্বাহরীক
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন