ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব-০৩

লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৮ অক্টোবর, ২০১৪, ০৯:৫৫:৪৭ সকাল

পরিচয় :

১৭০৩ খৃষ্টাব্দে আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রভূমি নাজদ অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা যুগসংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)। আরবের বুকে দীর্ঘকালব্যাপী জেঁকে বসা শিরক ও বিদ‘আতের বিপুল আস্ফালনকে রুখে দিয়ে অমাবস্যা রাতে ধূমকেতুর মতই চমক জাগিয়ে তিনি যে দুঃসাহসী আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আরবের বুকে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফে ছালেহীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের ভিত্তিতে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া নির্ভেজাল ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটান এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাদান। স্মর্তব্য যে, এটি আকস্মিক আবির্ভূত কোন আন্দোলন ছিল না; বরং ইসলামের ইতিহাসে অনুরূপ আন্দোলনের দৃষ্টান্ত অনেক। ইরাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (৭৮০-৮৫৫ খৃঃ), সিরিয়াতে ইমাম আহমাদ ইবনে তায়মিয়া (১২৬৩-১৩২৮ খৃঃ), মিসরে ইয্ বিন আব্দুস সালাম (১১৮১-১২৬১ খৃঃ), মরক্কো ও স্পেনে ইমাম শাত্বেবী (১৩৮৮ খৃঃ), ইয়ামনে ইমাম ছান‘আনী (১৬৮৮-১৭৬৮ খৃঃ) প্রমুখ মহান যুগসংস্কারকবৃন্দ প্রত্যেকেই হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরূপ আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং খারেজী, মু‘তাযিলীসহ পথভ্রষ্ট আক্বীদাসমূহের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

মুসলিম বিশ্বে যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তারের কারণে এ আন্দোলন বিশ্ববাসীর নযরে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে জ্ঞানী মহল এ আন্দোলনের উপর বিশেষ গবেষণা চালিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হ’ল, সংস্কারধর্মী ও বিশুদ্ধবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে এ আন্দোলনের উপর পাশ্চাত্যের সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যত গবেষণা হয়েছে, সম্ভবতঃ মুসলিম বিশ্বের ইসলামী কেন্দ্রগুলোতেও তত হয়নি। নিম্নে এ আন্দোলনের পরিচয় সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিতের বক্তব্য তুলে ধরা হ’ল-

১- মিসরীয় পন্ডিত ড. ত্বহা হুসাইন (১৮৮৯-১৯৭৩ খৃঃ) বলেন, ‘এই নতুন মাযহাবটি বাহ্যত নতুন মনে হ’লেও মর্মগতভাবে এটি সনাতনই। অর্থাৎ সমকালীন পেক্ষাপটে নবীন হ’লেও মৌলিকত্বের দিক থেকে এটি প্রাচীন। কেননা এ দাওয়াত ছিল বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র এবং শিরক ও পৌত্তলিকতামুক্ত আদি ইসলামের দিকে ফিরে যাওয়ার এক শক্তিশালী দাওয়াত। ... এটি ছিল স্বয়ং ইসলামের দিকেই দাওয়াত, যে দাওয়াত নিয়ে নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে শীর উঁচু করে থাকা যাবতীয় তথাকথিত মাধ্যমসমূহ উচ্ছেদের লক্ষ্যে। এ দাওয়াত পরিচালিত হয়েছিল আরবীয় ইসলামকে পুনরুজ্জীবন দান এবং অজ্ঞতা-মূর্খতা ও অনারব সংস্পর্শের প্রভাবজাত সৃষ্ট যাবতীয় ময়লা-আবর্জনাকে পরিশোধনের জন্য’।১৪

২- লেবাননী লেখক আমীর শাকীব আরসালান (১৮৬৯-১৯৪৬ খৃঃ) বলেন, ‘এই আন্দোলন ছিল সঠিক আক্বীদা, সালাফে ছালেহীনের নীতিমালা এবং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবাদের পদাংক অনুসরণের দিকে প্রত্যাবর্তনে আহবানকারী একটি আন্দোলন। যা কুসংস্কার, বিদ‘আত, গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা বা আনুগত্য প্রকাশ, কবরের প্রতি শ্রদ্ধা দেখান, আওলিয়ায়ে কেরামের অবস্থানস্থলে ইবাদত করা ইত্যাকার কার্যকলাপকে সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করে।১৫

৩- আমেরিকান পন্ডিত লোথ্রোব স্টোডার্ড (১৮৮৩-১৯৫০ খৃঃ) চমৎকারভাবে এর পরিচয় দিয়েছেন, ‘ওয়াহ্হাবী দাওয়াত একটি বিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারবাদী দাওয়াত। যার উদ্দেশ্য ছিল অলৌকিকতার ধারণাকে পরিশুদ্ধ করা, যাবতীয় অস্পষ্টতা, সন্দেহ ও কুসংস্কারের অবসান ঘটান। মধ্যযুগে ইসলামের মধ্যে তথাকথিত মুসলিম পন্ডিতরা যেসব বৈপরিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পরস্পর বিরোধী সংযোজন ঘটিয়েছিলেন তা নাকচ করা এবং যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড ও ওলী-আওলিয়ার উপাসনাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা। সর্বোপরি ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং আদি ও মৌলিক উৎসগুলোর মাধ্যমে ইসলামকে ধারণ করার আহবানই ছিল ওয়াহ্হাবী দাওয়াতের সারনির্যাস।

৪. ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর প্রথম তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনাদাতা সুইস পর্যটক জন লুইস বারখাডট (John Lewis Burkhardt) তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, ‘ওয়াহ্হাবীদের ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহ নব্য কোন ধর্মবিশ্বাস ছিল না।...তাদের এবং সুন্নী তুর্কীদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, ওয়াহ্হাবীরা শরী‘আতকে কঠোরভাবে অনুসরণ করত, যখন অন্যরা তা অবহেলা করত অথবা পূর্ণাঙ্গভাবে তা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকত’।১৬

মোটকথা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সর্বত্র একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, ওয়াহ্হাবী আন্দোলন মূলতঃ এমন একটি সংস্কারপন্থী ও বিশুদ্ধবাদী আন্দোলন, যা শিরককে সর্বতোভাবে বর্জনের মাধ্যমে নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতিষ্ঠাদানে সফল সংগ্রাম চালিয়েছিল এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছভিত্তিক প্রকৃত ইসলামী শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও নামধারী আলেম-ওলামা এবং বিদ্বেষী মহল প্রথম থেকেই হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ আনেদালনের বিরূদ্ধে কদর্যপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তবুও এ আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীকে তারা বিন্দুমাত্র প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। বরং এ আন্দোলন বিগত তিন শতকে ইসলামকে শিরক ও বিদ‘আতের অশুভ ছায়া থেকে উদ্ধার এবং আদি ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষাকে পুনরায় বিশ্বের বুকে জাগ্রত করার এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের বুকে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে নির্ভেজাল তাওহীদ তথা অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনাবিল সুবাতাস। বাতিলের কোটি কণ্ঠের সমবেত গর্জন, শত বাধার বিন্ধ্যচল এর অগ্রযাত্রায় যে কোনরূপ বাধা হ’তে পারেনি সেটাই সতত দৃশ্যমান।

১৪. ত্বহা হুসাইন, আল-হায়াতুল আরাবিয়্যাহ ফি জাযীরাতিল আরাব (দামেশক : ১ম প্রকাশ, ১৯৩৫ খৃঃ), পৃঃ ১৩। গৃহীত : প্রবন্ধ ‘‘হাক্বীকাতুশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব’’, ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ (রিয়াদ : ১৪০৮ হিঃ, ২১ তম সংখ্যা), পৃঃ ১২৭।

১৫. হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, আরবী অনুবাদ : উজাজ নুয়াইহিয, সম্পাদনা : আমীর শাকীব আরসালান, মূল ইংরেজী : Lothrob Stoddard, The New World of Islam (P.1921) (বৈরূত : দারুল ফিকর, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ইং), ১/২৬৪ পৃঃ।

১৬. John Lewis Burckhardt, Notes on the Bedouins and Wahabys, (London : 282 Henry Colburn and Richard Bentley, 1830), P.275. গৃহীত : ‘আশ-শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতাহু ফির রু’য়াতিল ইসতিশরাক্বিয়া, নাছের বিন ইবরাহীম আত-তাওভীম (রিয়াদ : ১ম প্রকাশ, ২০০২ খৃঃ), পৃঃ ২৬।

(আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব)

সূত্র- আতত্বাহরীক

বিষয়: বিবিধ

১৪৯৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

278854
২৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১০:৪৮
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : হাজী শরীয়তউল্যাহ এ উপমহাদেশে ফরায়েজী আন্দোলন নামে এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ অনেক বছর মক্কা মদীনায় অবস্থান করেছিলেন এবং মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (রহ) এর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছিলেন।
278861
২৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১১:২৪
ফখরুল লিখেছেন : বিষয় গুল সবার জানা থাকা দরকার। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটা বিষয় নিয়ে আসার জন্য।
চালিয়ে যান। Rose Rose
278935
২৮ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০৩:১৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
279327
২৯ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:০২
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : মুহতারাম আপনার সাথে একমত। তবে আমি মনে করি আপনি আমার দেশের এবং বর্তমান সালাফিদের অবস্থা তুলনামুলক আলোচনা করবেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File