ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব-০১

লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৬ অক্টোবর, ২০১৪, ০৩:৩৭:৪৪ দুপুর

মধ্য আরবের প্রাচীন উচ্চভূমি অঞ্চল ‘নাজদ’। অষ্টাদশ শতকে এ ভূখন্ডে ঘটে যায় এক অসাধারণ ইসলামী বিপ্লব। ইসলাম আগমনের পূর্বে অজ্ঞতার তিমির প্রহেলিকা আরবজাতিকে যেমন আচ্ছাদিত করে রেখেছিল, ঠিক তেমনি আববাসীয় শাসনামলের পতনের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি পুনরায় খোদ ‘অহি-র অবতরণস্থল’ আরবের বুকে ধীরে ধীরে জমাট বেঁধেছিল জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিস্রা। শিরক-বিদ‘আতের ভয়াবহ আগ্রাসনে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছিল ইসলামের ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির আদিকাঠামো। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে বলা যায় ইসলামের পুনর্জন্মবার্তা নিয়েই ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ তথা ইসলামের বিশুদ্ধ রূপের দিকে প্রত্যাবর্তনবাদী ও সংস্কার-অনুবর্তী এই আন্দোলনের জন্ম হয়। বৈশিষ্ট্যগত কারণে এ আন্দোলনকে সালাফী আন্দোলন বা মুওয়াহ্হিদীন আন্দোলন বলে আখ্যা দেয়া হয়। এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খৃঃ) রাহিমাহুল্লাহ। অহী নাযিলের পবিত্র ভূমি আরবের বুকে এই মহান যুগসংস্কারক কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনই ঘটাননি; বরং নাজদ থেকে এমন এক ইসলামী সমাজের উত্থান ঘটান যা খুলাফায়ে রাশেদীনের পর অহি-র প্রাণকেন্দ্রে পুনরায় তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল একটি বৃহত্তর আরব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছিল। যার বিকীর্ণ আলোকচ্ছটা আরব মরুর দিকচক্রবাল পেরিয়ে পরবর্তীতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

এ আন্দোলন ছিল মুসলিম বিশ্বে শিরক, বিদ‘আত অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নবসৃষ্ট বিধি-বিধান, বিজাতীয় সংস্পর্শ থেকে আগত যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি সংগঠিত ও সফল আন্দোলন, যা মধ্যযুগীয় অবক্ষয়কালীন দুর্যোগ কাটিয়ে ইসলামের নবতর বিকাশের জন্য এক যুগান্তকারী মাইলফলকে পরিণত হয়। আধুনিক যুগের সকল ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের আদর্শিক প্রেরণা এই আন্দোলন। সৈয়দ আব্দুল কুদ্দূস যথার্থই বলেন, ‘আধুনিক যুগে ইসলামী রেঁনেসার উৎপত্তি মূলতঃ অষ্টাদশ শতকের ‘ওয়াহ্হাবী’ আন্দোলন থেকে। দার্শনিক ও আদর্শগত দিক থেকে এই রেঁনেসার ইতিহাস মূলতঃ ওয়াহ্হাবী আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা’।১

মহাকবি ইকবাল এই আন্দোলনকে আখ্যা দিয়েছেন- ‘‘The first throb of life in modern Islam" অর্থাৎ ‘আধুনিক ইসলামের প্রথম হৃদস্পন্দন’ হিসাবে।২

আল্লামা যিরিকলী বলেন, ‘এই দাওয়াত ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আধুনিক নবজাগরণে সর্বপ্রথম বিচ্ছুরিত আলোকধারা। যার প্রভাবে ভারত, মিসর, ইরাক ও সিরিয়ার সংস্কারবাদীগণ উদ্বুদ্ধ হন’।৩

মুহাম্মাদ যিয়াউদ্দীন আর-রীস বলেন, ‘এ আন্দোলন এমন দু’টি মূলনীতিকে ধারণ করেছিল, মুসলিম বিশ্বের অগ্রযাত্রায় যার প্রভাব সর্বাধিক। এক. পবিত্র কুরআন ও হাদীছ- এই দু’টি মূলসূত্রের উপর নির্ভরতা এবং সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত নীতিমালার দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান ও দুই. ইজতিহাদের নীতি প্রবর্তন। এই দু’টি নীতি হ’ল মুসলিম সমাজে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক জাগরণের ভিত্তি। বলা বাহুল্য, এই দু’টি নীতি অবধারণের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হওয়া প্রাচ্যের সকল সংস্কারবাদী আন্দোলনই ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের কাছে সর্বৈব ঋণী। এ আন্দোলনের সাথে অন্যান্য সব আন্দোলন দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত, হয় সরাসরি গ্রহণের মাধ্যমে অথবা অনুসরণের মাধ্যমে, নতুবা অন্ততঃ প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে।৪

মুসলিম সমাজে এ আন্দোলনের প্রভাব কিরূপ ছিল সে সম্পর্কে মরক্কোর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা প্রখ্যাত শল্যবিদ ও দার্শনিক আব্দুল করীম আল-খাত্বীব (১৯২১-২০০৮ খৃঃ) বলেন,والذي لا شك فيه، أن الدعوة الوهابية كانت أشبه بالقذيفة الصارخة، تنفجر في جوف الليل والناس نيام- كانت صوتا قويا رائدا أيقظ المجتمع الإسلامي كله، وأزعج طائر النوم المحوم علي أوطانهم منذ أمد بعيد- ‘নিঃসন্দেহে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন ছিল এক প্রচন্ড নিনাদসম্পন্ন মিসাইলের মত; যা বিস্ফোরিত হয়েছিল এক গভীর রাতের অমানিশার মাঝে, যখন মানুষ ছিল নিদ্রামগ্ন। এর আওয়াজ ছিল এমনই তীব্র ও সুদূরপ্রসারী যে তা সমগ্র মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং তা যেন সুদীর্ঘকাল পর নিদ্রাচ্ছন্ন বুভুক্ষ পাখীকে আপন বাসস্থানে চঞ্চল করে তুলেছিল’।৫

ড. আমীনুল ইসলাম বলেন, এ আন্দোলন আরবদের শুধু আত্মসমালোচনা ও আত্মানুসন্ধানের জন্যই সজাগ করে দেয়নি, একই সঙ্গে তাদের জাগিয়ে দিয়েছে সেই মোহনিদ্রা থেকে, যা কিনা নিহিত ছিল তাদের অবক্ষয়ের মূলে। এ আন্দোলন তাদের মনে যে শক্তি ও গতি সঞ্চার করে, সেটিই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একাধিক সংস্কারধর্মী কর্মসূচি গ্রহণে।’৬

ইয়াহইয়া আরমাযানী বলেন, ‘উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার দিক থেকে এ আন্দোলন ৭ম শতাব্দীতে পরিচালিত নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আন্দোলনের সাথে এমনই সাদৃশ্যপূর্ণ যে, কেউ কেউ একে ইসলামের দ্বিতীয় আবির্ভাব বলে বিবেচনা করে থাকেন।৭

এ আন্দোলনের যুগান্তকারী প্রভাবকে খৃষ্টসমাজের প্রটেস্ট্যান্টদের৮

উত্থানের সাথে তুলনা করে T.P.Huges বলেন, ‘ওয়াহ্হাবীজমকে কখনও কখনও ইসলামের প্রটেস্ট্যানিজম বলা হয়; আর বাস্তবিকই তাই, যদিও এখানে বড় পার্থক্য হ’ল খৃষ্টান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলোকে যথাযথ সম্মান করলেও প্রথাগত ধর্মীয় রীতিনীতিকে স্বীকার করে না। আর ওয়াহ্হাবীজম পবিত্র কুরআনের সাথে হাদীছের শিক্ষাকেও দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’।৯

১. Syed Abdul Quddus, The Challenge of Islamic Renaissance, (Dehli : Adam Publishers, 1990), P. 17.

২. প্রাগুক্ত, ১৭ পৃঃ।

৩. খায়রুদ্দীন আয-যিরিকলী, আল-আ‘লাম (বৈরূত : দারুল ইলম লিল মালায়ীন, ১৫তম প্রকাশ : ২০০২ খৃঃ), ৬/২৫৭ পৃঃ।

৪. আহমাদ বিন হাজার আলে বুত্বামী, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, আক্বীদাতুহুস সালাফিয়্যাহ ওয়া দা‘ওয়াতুহুল ইছলাহিয়্যাহ ওয়া ছানাউল উলামা আলাইহে (কুয়েত : আদ-দারুস সালাফিয়্যাহ, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৮৩ খৃঃ), পৃঃ ১৩৫।

৫. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৫।

৬. ড. আমীনুল ইসলাম, ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম দর্শন (ঢাকা : উত্তরণ, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ ইং) পৃঃ ২৩০।

৭. ইয়াহইয়া আরমাজানী, মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান, মূল : Middle East past and present, মুহাম্মাদ ইনাম-আল-হক অনূদিত (ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০০), পৃঃ ২৬০।

৮. প্রটেস্টানিজম হ’ল ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় খৃষ্টসমাজে পরিচালিত একটি বিখ্যাত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, যা খ্যাতনামা সংস্কারক মার্টিন লুথার কিং তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চের পোপদের দুর্নীতি ও তাদের প্রবর্তিত ভ্রান্ত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন। ১৫১৭ সালে শুরু হয়ে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপ জুড়ে ছিল এ আন্দোলনের ব্যাপ্তি, যাতে এক বিরাট ধর্মীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

৯. Thomas Patric Huges, Dictionary of Islam (Delhi : Rupa & Co. 1988), P. 661.

(আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব)

সূত্র- আতত্বাহরীক

বিষয়: বিবিধ

১৮২৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

278335
২৬ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৪
আনিসুর রহমান লিখেছেন : Great initative. Thanks
278345
২৬ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : অনেক জানতে পারলাম । শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ অষ্টাদশ শতাব্দীর আব্দুল ওয়াহ্হাবের অনেক আগের আর একজন আব্দুল ওয়াহ্হাব ছিলেন আর সেই পুরাতন ওয়াহ্হাবের দোষগুলি নজদের আব্দুল ওয়াহ্হাবের উপর চাপিয়ে দেওয়া চেষ্টা করা হচ্ছে । ঠিক যেমন দেলোয়ার হোসেন সাঈদিকে
দেলু সিকদার বানিয়ে বিচারকেরা রায় দিয়েছেন।
যদি পারেন এই দুই ওয়াহাবের প্রার্থক্য নিয়ে একটা পোস্ট লিখুন। জাযাকাল্লাহ খায়ের

278366
২৬ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ সুন্দর ও জরুরি এই পোষ্টটির জন্য।
তবে আমি ওয়াহাবি শব্দটি ব্যবহার ব্রাকেট এ করার জন্য বলব। কারন প্রকৃতপক্ষে এই নামটি ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদিদের দেওয়া। এমনকি এই আন্দোলনকারিরা যে তুর্কি দের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিল তারাও এভাবে বলেন না।
278513
২৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০১:৫৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো লিখাটি ভাইয়া।
278538
২৭ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৬:০১
চলাচল লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো

278573
২৭ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১০:২৮
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : জাযাকুল্লাহ খায়ের।
একদম গোড়াতে হাত দিয়েছেন। চালিয়ে যান।

মুসলমানদের মাঝে মহামারি ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়া শিরক বিদআত আর কুসংস্কারকে উপড়ে ফেলতেই মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব এর সুযোগ্যে নেতৃত্বে এ আন্দোলন শুরু হয়। ইংরেজদের যোগসাজসে আমাদের দেশে ভাড়াটিয়া কিছু আলেম অপউদ্দেশ্যে ‍ওয়াহ্হাব শব্দটিকে বিকৃত করে শিরক বিদআত বিরোধী বিশুদ্ধ আকীদার মুসলমানদের 'ওহাবী' বলে প্রচার চালায়।
279321
২৯ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৬
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : সুন্দর আয়োজন। প্রথম পর্ব বেশ হয়েছে। শাইখ আব্দুল ওয়াহাব (রঃ) সম্পর্কে আমার দেশে সেই গোলামী আমল থেকে চরম নিন্দাসুচক বক্তব্য রয়েছে। আগামী পর্বে সে বিষয়গুলো আলোচিত হবে।
আমি আপনার সাথে আছি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File