১৪ এপ্রিল টাইটানিক ডুবে যাওয়ার দিন।
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:২৯:২৫ সকাল
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আটলান্টিক মহাসাগরের অতল গহ্বরে আশ্রয় নিল টাইটানিক। তৈরী হল করুণ ইতিহাস। গবেষক পেলেন গবেষণার নতুন বিষয়। টাইটানিক উত্তর যুগে বিশ্ব তাকে জানল বড় জ্যাক রোজের হাত ধরে। ১০০ বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। কল্পনার মিশেলে নিত্যই বদলে যাচ্ছে টাইটানিকের ইতিহাস।
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রোববারের শান্ত বিকেলে পরিস্কার আকাশের নিচে মৃদু-মন্দ কনকনে শীতল বায়ু বয়ে যাওয়া শান্ত সমুদ্রে যে মর্মান্তিক ইতিহাস রচিত হয় তা কি আসলেই সামান্য ঘটনার ফসল? নাকি বিশ্ববাসী এতদিন যা জেনে আসছে তা ভুল? উত্তর মেলেনি এসব প্রশ্নের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সর্বাধুনিক কারিগরি দক্ষতা এবং সরঞ্জাম নিয়ে তৈরী হওয়া বিশাল আকৃতির টাইটানিক জাহাজটি যাত্রার চতুর্থদিনের মাথায় কিভাবে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল , সে রহস্য এখনও আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। যদিও টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে একেক সময় একেক তথ্য জানিয়েছেন, কিন্তু তারা কেউই এ জাহাজডুবির কারণ সম্পর্কে একমত হতে পারেন নি।
'টাইটান' ছিল গ্রীক পুরাণের সৃষ্টি দেবতা। এ টাইটানের নাম অনুসারেই জাহাজটির নাম রাখা হয়েছিল টাইটানিক। আরএমএস এর টাইটানিকের পূর্ণ রূপ হচ্ছে রয়্যাল মেল শিপ টাইটানিক।
টাইটানিক ছিল সে যুগের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও নিখুঁতভাবে নির্মিত জাহাজ। জাহাজের মালিকেরা গর্ব করে বলতেন টাইটানিক ডুবতে পারে না। ১৬ তলা জাহাজের প্রতিটি তলা জল নিরোধোক করে তৈরী। অথচ এ গর্বকে খর্ব করে জাহাজটির প্রথম যাত্রা পরিণত হয় শেষ যাত্রায়। টাইটানিক আশ্রয় নেয় আটলান্টিকের নীল জল রাশির গভীর তলদেশে: কিন্তু কেন ঘটেছিল এমনটি? সমুদ্র যাত্রার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক জাহাজ দূর্ঘটনা টাইটানিক ডুবে যাওয়া নিয়ে ডুবে যাওয়া নিয়ে এপর্যন্ত অসংখ্য কাহিনী রচিত হয়েছে, লেখা হয়েছে শত শত বই। উত্তর আটলান্টিকের শীতল জলে বিশালয়তন বরফের ভাসমান পাহাড়ের ধাক্কায় ডুবে যায় টাইটানিক। যদিও টাইটানিক ডোবার কারণ হিসেবে বরফ খন্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগাকে কেউ অস্বীকার করেন না, কিন্তু এই ধাক্কার ফলে টাইটানিক কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। আজও গবেষকরা এ রহস্যের কিণারা করতে পারেন নি।
বৃহৎ আকার এ জাহাজের রাডারটি ছিল ১০১টন ওজনের, যা ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের জাহাজ সান্তা মারিয়ার পুরো ওজনের চেয়েও ভারী। জাহাজটিতে যাত্রী ছিল ২ হাজার ২২৪ জন। প্রথম শ্রেনীর প্রতিটি টিকেটের মূল্য যা ছিল তার বর্তমান মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ২৪ হাজার ডলার। যাত্রীদের খাদ্য হিসেবে প্রায় এক লাখ পাউন্ড মাংস ছিল। জাহাজটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২৩ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৪৩ কিলোমিটার)। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে জাহাজটি যখন উম্মুক্ত করা হয় তখন এক দূর্ঘটনা দিয়ে জাহাজটির যাত্রা শুরু হয়। এ দূর্ঘটনায় একজন শিপইয়ার্ড শ্রমিক মারা যান।
১৯১২ সালের ১১ এপ্রিল টাইটানিক নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর ত্যাগ করে। ১৪ এপ্রিল জাহাজটি গন্তব্যে পৌছার কথা। বিলাসবহুল এ জাহাজে ছিল জিমনেসিয়াম, ক্যাফে, স্কোয়াশ খেলার কোর্ট, গরম পানির সুইমিংপুল, টার্কিশ বাথ, চুল কাটার সেলুন, এবং তিনটি লাইব্রেরী। যা ঐ সময়ের কোন যাত্রীবাহী জাহাজে ছিল না। ভার্সাই প্রাসাদের আদলে তৈরী করা হয় টাইটানিকের প্রথম শ্রেনীর লাউঞ্জগুলো। এ জাহাজটি একই সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৪৭ জন যাত্রী ও ক্রু বহন করতে পারত। টাইটানিকের ফার্ষ্টক্লাসের যাত্রীদের জন্য বিলাসবহুল ডাইনিংয়ের ব্যাবস্থা ছিল। সেখানে একই সঙ্গে ৫৫০জন খেতে পারত। তখনকার সব আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছিল এ জাহাজে। এর বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থাও ছিল খুব উন্নত ধরণের। এ জাহাজে ফার্ষ্টক্লাসের জন তিনটি এবং সেকেন্ড ক্লাসের জন্য একটি সহ মোট চারটি লিফটের ব্যাবস্থা ছিল।
জাহাজের ফার্ষ্টক্লাসের যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে ব্যায়বহুল প্যাকেজটিতে আটলান্টিক একবার অতিক্রম করতেই ব্যয় করতে হতো তখনকার প্রায় ৪হাজার ৩৫০ ডলার। (যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৯৫ হাজার ৮৬০ ডলার)। টাইটানিক প্রায় ৬৪টি লাইফবোট বহন করতে সক্ষম ছিল, যা প্রায় ৪ হাজার লোক ধারণ করতে পারত। কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ নীতমালা অনুসারে ১০ হাজার টনের চেয়ে ভারী জাহাজকে ১৬ টি লাইফবোট নিতে দেওয়া হতো। তাই টাইটানিক আইনগত ভাবে যত লাইফবোট নেওয়া দরকার তার চেয়ে ২০টি বেশি লাইফবোট নিয়ে যাত্রা করেছিল, যা টাইটানিকের মোট যাত্রীর ৩৩ শতাংশ বা ১হাজার ১৭৮ জন যাত্রী বহন করতে পারত।
টাইটানিকের ক্যাপ্টেন ছিলেন বিখ্যাত রাজকীয় কমান্ডার অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথ। এ যাত্রা শেষে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। তবে যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই আটলান্টিকে তার সলিল সমাধি ঘটে।
টাইটানিক যখন ডুবে যায় তখন অনেক যাত্রী এ কথা বিশ্বাসই করতে চাননি যে, টাইটানিক সত্যি সত্যি ডুবে যাচ্ছে। টাইটানিক যখন আইসবার্গে আঘাত হানে তখন অনেক যাত্রী ডেক বা পাটাতনের উপর বরফ নিয়ে খেলা করছিলেন। জাহাজটি সম্পূর্ণ ডোবার আগে দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। জাহাজটি যখন ডুবে যাচ্ছিল তখন একট রহস্যময় জাহাজকে টাইটানিকের খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছিল। টাইটানিক বিপদ সংকেত দিলেও তারা সাড়া দেয়নি। টাইটানিক যখন ডুবছিল তখন জাহাজটি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যায়। টাইটানিক থেকে বিপদ সংকেত শুনে কার্পেথিয়া নামের একটি সমুদ্রগামী জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা টাইটানিক ডোবার দু'ঘন্টা পর।
যদিও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল লাইফবোটগুলোতে শিশু এবং নারীদের নেওয়া হবে। তারপরও জাহাজে অনেক নারী ও শিশু নিহত হয়, তাদের মধ্যে অধিকাংশই জাহাজটির তৃতীয় শ্রেনীর যাত্রী। লাইফবোটগুলোতে প্রথম শ্রেনীর যাত্রীরাই বেশি উঠেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
টাইটানিক দূর্ঘটনায চাঁদের প্রভাব!
অভজ্ঞ স্মিথ এ পথে অসংখ্যবার জাহাজ চালিয়েছেন। কোনোদিন বিন্দু পরিমাণ ঝামেলার মুখ দেখেননি। তাই তিনি শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন টাইটনিকের চলার পথে কোন বাধা নেই। পর্বত সমান আইসবার্গের কথা তি্নি কল্পনাতেও আনতে পারেন নি। ওই অঞ্চলে বড় আইসবার্গ থাকার কথা নয়। তাহলে ওই আইসবার্গ আসলে কোথায় তৈরী হয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাব নিয়ে এসেছেন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদরা। তারা বলেছেন, যে পর্বতসম আইসবার্গ দাক্কা খেয়ে টাইটানিকের সলিল সমাধি হয়েছিল সেই আইসবার্গ জন্ম নিয়েছিল গ্রীনল্যান্ডে! গ্রীনল্যান্ডে জন্ম নেওয়া আইসবার্গগুলো সাধারণত ল্যাব্রাডার এবং নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের অদূরে অপেক্ষাকৃত অগভীর পানি অঞ্চলে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থিরভাবে দলবেধে ভাসতে থাকে। এখান থেকে বড় আকারের আইনবার্গ বিচ্ছিন্ন হয়না। এ আইসবার্গ বিচ্ছিন্না করতে গেলে যে পরিমাণ স্রোতের প্রয়োজন তা ঐ এলাকায় ছিলনা। কিন্তু সেই স্রোত একদিন সেখানে তৈরী হয়েছিল। সেই দিনটি ছিল ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারী। সেদিন চাঁদ এবং সূর্য এমন অবস্থানে এসেছিল, যে অবস্থানে সর্বোচ্চ মাত্রার মাধ্যাকষর্ণ শক্তি তৈরী হয়। সেদিন চাঁদ পৃথিবীর এতকাছে চলে এসেছিল, প্রতি ১৪০০ বছরে মাত্র একবার ঘটে! ঠিক তার আগের দিন অর্থাৎ তিন জানুয়ারী পৃথিবী সূর্যের এতকাছে অবস্থান করছিল, তার প্রতি ১৪০০ বছরে মাত্র একবার ঘটে। হয়তো একেই বলে মহাজাগতিক রহস্য। যা ১৪০০ বছরে একবার ঘটে সে ঘটনা চাঁদ-সূর্যের বেলায় ঘটে গেল পর পর দু'দিন। এজন্য এ দু'দিন তৈরী হয়েছিল ১৪০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার জোয়ার। জোয়ার-ভাটায় চাঁদ ও সূর্যের প্রবল প্রভাবের ফলে এমন শক্তির স্রোত তৈরী হয়েছিল , যা ল্যাব্রাডার এবং নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের 'বরফ মহাদেশ' থেকে পর্বত আকারের বহু সংখ্যক আইসবার্গকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। সেই জোয়ারের তোড়েই মুক্ত আইসবার্গগুলো ভাসতে ভাসতে হাজির হয়েছিল দক্ষিণ আটলান্টিকের জাহাজ চ্যানেলে টাইটানিকের চলার পথে। সেই আইসবার্গের ধাক্কাতেই ১৪ এপ্রিল রাতে লেখা হয়ে যায় টাইটানিক নামক উপাখ্যানের শেষ অধ্যায়।
(লেখা ও ছবি সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
৪৭১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন