মেধাবী প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ‘দাওয়াত’ কর্মসূচি
লিখেছেন লিখেছেন কাবজাব ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:৩৬:৩৩ সন্ধ্যা
পাঁচ দফা কর্মসূচি সামনে রেখে ছাত্রদের দলে টানার কাজ করে ইসলামী ছাত্র শিবির। মেধাবী, বুদ্ধিমান, কর্মঠ, চরিত্রবান, নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী ছাত্রদের ‘টার্গেট’ করে শিবির। কর্মী, সাথী ও সদস্য এ তিনটি ধাপে থাকা ছাত্ররা মূলত শিবিরের সব কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তবে সদস্যদেরকে শিবিরের আসল প্রতিনিধি হিসেবে মনে করা হয়।
টার্গেটকৃত ছাত্রদের মন মগজে আখিরাত তথা পরকাল সম্পর্কে ধারনা দেয়া, রাসুল (সা.)-এর বিপ্লবী জীবন, সাহাবায়ে কেরামদের সংগ্রামী জীবনের ঘটনার উদাহরণ দিয়ে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বুঝানো, অমায়িক ব্যবহার, ছাত্রদের মগজে পুঞ্জীভূত আবর্জনা পরিস্কার করে তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য বুঝে শুনে জামায়াতি ঘরনার লেখকদের পুস্তক পড়তে দেয়া, দলীয় উদ্যোগে সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, চা-চক্র, বনভোজন, নবাগত ছাত্রদের সম্বর্ধনা, বিতর্ক সভা, রচনা, বক্তব্য প্রতিযোগিতা, সাধারন জ্ঞানের আসর, পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, লজিং যোগাড় করে দেয়া শববেদারি বা নৈশ এবাদতসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে একজন ছাত্রকে শিবিরের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে এসব ছাত্রদের বিস্ফোরক বহন, সহিংসতার ঘটনার ককটেল ছুড়ে মারা কিংবা যানবাহন ভাংচুর, গাড়িতে আগুন দেয়ার মতো ঘটনায় ব্যবহার করছে শিবির।
গত শনিবার চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে ১২টি অত্যাধুনিক এমকে-৩ প্যারাসুট রকেট ফ্লেয়ার ও তিনটি হ্যান্ড গ্রেনেড সদৃশ বোমাসহ ফরিদ উদ্দিনকে আটক করে পুলিশ। ভোলার দৌলতখান উপজেলার আবদুর মান্নানের ছেলে ফরিদ চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সম্মান শ্রেণীর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সদর ঘাট থানার ওসি প্রণব কুমার চৌধুরী জানান, ফরিদ জানিয়েছে সে শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। সে সদরঘাট কামাল গেট এলাকায় কামাল ম্যানসনের চতুর্থ তলায় একটি ব্যাচেলর কক্ষে ভাড়া থাকে
একজন ছাত্রকে রাজনীতির সাথে জড়িত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে শিবির। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিবিরের সাবেক এক ছাত্রনেতা জানান, দেশের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মতো শিবির দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। দলীয় সংবিধানের বাইরেও রয়েছে ‘কর্মপদ্ধতি’ নামের নির্দেশনামূলক বই। ৪৪ পৃষ্ঠার একটি বইতে লিখা রয়েছে মেধাবী ছাত্রদের শিবিরের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করার নানা কৌশল ।
কর্মপদ্ধতিতে বলা হয়েছে, দাওয়াতের মাধ্যমে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদেরকে শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয় শিবির। তা হলো- তরুন ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহবান পৌঁছে দেয়া, ছাত্রদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের দায়িত্ব জাগ্রত করা ও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার জন্য ছাত্রদের মধ্যে দায়িত্বানুভুতি জাগ্রত করা। এ তিনটি বিষয়ে কাজ হলেই বুঝতে হবে প্রথম দফার কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে। সংক্ষেপে এ দফাকে ‘দাওয়াত’ বলা হয়। একজন ছাত্রকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে শিবির।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, গ্রাম ও মহল্লার মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে এ পন্থায় কাজ করতে হবে। এরই নাম ‘টার্গেট’ নির্ধারণ। ছাত্রদের টার্গেট করার সময় শিবির নেতারা ৫টি বিষয়ের ওপর নজর দিয়ে থাকে। তা হলো- মেধাবী, বুদ্ধিমান ও কর্মঠ, চরিত্রবান, নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন ও সমাজে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী।
শিবিরের সাবেক এ ছাত্রনেতা বলেন, টার্গেটকৃত ছাত্রকে অগ্রসর করে নেয়ার জন্য একটি বাস্তব পরিকল্পনা থাকা চাই। তা প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অথবা দীর্ঘ সময়ের জন্য হতে পারে। অনেকগুলো ছাত্রকে একসাথে টার্গেটের আওতায় এনে সুযোগ এবং সামর্থ অনুযায়ী কমসংখ্যক ছাত্রের ওপর অত্যন্ত ধৈর্য ও আন্তরিকতার সাথে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যে ছাত্রের কাছে সাংগঠনিক দাওয়াত পৌঁছাতে হবে তার সাথে পূর্বেই সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এমন এক আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে যেন সে সাক্ষাতকারীকে তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিশ্বাস করতে পারে।
তিনি বলেন, প্রথম সাক্ষাতেই কোন ছাত্রকে শিবিরের রাজনীতির কথা বলা হয়না। প্রথমে টার্গেটকৃত ছাত্রের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করা হয়। যাতে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়। এক অন্যের কল্যাণকামী হয়। পরের ধাপে টার্গেটকৃত ছাত্রের মন মগজে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বুদ্ধিমত্তার সাথে তুলে ধরতে হবে। আখেরাতে তথা পরকাল সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারনা দিতে হবে এবং যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। ধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে। ছাত্রদেরকে ইসলামের অনুশাসনগুলির (ইবাদত) প্রতি পরোক্ষ এবং কোন কোন সময় প্রত্যক্ষভাবে সজাগ করতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের ও সাংগঠনিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করাতে হবে। রাসুলাল্লাহ (স,)-এর বিপ্লবী জীবন, সাহাবায়ে কেরামদের জীবনীর উদাহরণ দিয়ে আন্দোলন ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ছাত্রদের বোঝাতে হবে। এ পর্যন্ত কৃতকার্য হলে পরবর্তী পর্যায়ে একজন ছাত্রকে শিবিরের রাজনীতির সাথে অংশগ্রহন করার আহবান জানাতে হবে।
একজন ছাত্রের কাছে যিনি শিবিরের রাজনীতির দাওয়াত নিয়ে যাবেন তারও কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। যেমন - তিনি কম কথা বলবেন। অত্যধিক ধৈর্যের পরিচয় দেবেন। বেশি কথার পরিবর্তে চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে প্রভাব সৃষ্টি করবেন। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারনা রাখবেন। কোন ছাত্রের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে ব্যক্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে সময় নেবেন। গোজামিলের আশ্রয় নেবেন না। যার সাথে সাক্ষাত করা হচ্ছে তার মন মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যোগাযোগকৃত ছাত্রের রোগ দূর করার জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করবেন। ব্যবহারে অমায়িক হবেন। মনকে অহেতুক ধারনা থেকে মুক্ত রাখবেন। সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে ভ্রমণ, একত্রে নাস্তা করা, খাওয়া, নিজ বাসায় নিয়ে আসা, তার বাসায় যাওয়া, উপহার দেওয়া ইত্যাদি উপায় অবলম্বন করতে হবে।
একজন ছাত্রকে শুধু আন্দোলন ও সংগঠনের দাওয়াত দিলেই চলবে না। তাকে ক্রমান্বয়ে কর্মী পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সংগঠনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য চাই কাজ-প্রয়োজন কর্মীর। একজন সমর্থককে কর্মীরূপে গড়তে হলে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছাড়াও সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আগ্রহী করতে হবে। সময় সময় মন মানসিকতা বুঝে তাকে ছোটখাট দলীয় কাজ দিতে হবে। এছাড়াও মসজিদে, কেন্টিনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা, সাহিত্যসভা, বিতর্কসভা ইত্যাদি সমাবেশে ছাত্রদের মধ্যে দাওয়াতি সুযোগের সদ্ববহার করতে। অর্থাৎ দলের কাজ করার কথা কখনো সরাসরি আবার কখনোও বলা হবে পরোক্ষভাবে। এসব বিষয়ে জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে কর্মপদ্ধতিতে।
দাওয়াতি কাজের জন্য একটি আকর্ষণীয় প্রোগ্রাম হচ্ছে চা-চক্র। অনুষ্ঠানের বৈচিত্র ও আনন্দঘন পরিবেশে ছাত্র সমাজের কাছে আন্দোলনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়। টার্গেটকৃত ছাত্রদের এতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রত্যেক কর্মীকে চা-চক্রের খরচ নির্বাহের জন্য নির্ধারিত চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়াও পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, পরিচিতি ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাময়ীকি বিতরণ করতে হবে। দ্বিতীয় দফা কর্মসূচিকে বলা হয় ‘সংগঠন’। যেসব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্ত্তুত তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা। ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর যে সব ছাত্র শিবিরের কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রস্ত্তুত তাদেরকে সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এভাবেই একজন ছাত্রকে ক্রমান্বয়ে শিবিরের কর্মীতে রূপান্তর করা হয়।শিবিরের সংবিধান অনুযায়ী ‘সদস্য’ ও ‘সাথী’ এ দু’স্তরের কর্মী রয়েছে। তবে সাথী হওয়ার পূর্বে একজন ছাত্রকে আরও দুটি পর্যায় অতিক্রম করে আসতে হয়। তা হলো সমর্থক এবং কর্মী।
কর্মী : যে সমর্থক সক্রিয়ভাবে দাওয়াতী কাজ করেন, কর্মী সভায় নিয়মিতভাবে যোগদান করের, বায়তুল মাল (মাসিক চাঁদা) প্রদান করেন তাকে শিবিরের ভাষায় কর্মী বলা হয়।
সাথী : শিবিরের সংবিধানের ৯ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন শিক্ষার্থী সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন, এ সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে সচেতনভাবে একমত হন, ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন করেন এবং সংগঠনের সামগ্রিক তৎপরতায় পূর্ণভাবে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে তিনি এ সংগঠনের সাথী হতে পারেন।
‘সাথী’রা হচ্ছেন সংগঠনের একটি পরিপূরক শক্তি। নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে সংগঠনের প্রথম সারিতে পৌঁছা একজন সাথীর নৈতিক দায়িত্ব। সাথী হতে হলে ‘সাথী’ হওয়ার জন্য আবেদন করতে হয় এবং তা কেন্দ্রীয় সভাপতি অথবা তার নিযুক্ত প্রতিনিধির নিকট পাঠাতে হয়।
সূত্র: দৈনিক পূর্বকোন
বিষয়: বিবিধ
২৫৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন