“অন্ধকারের বনলতা সেন ও আলোকিত সুলতা”

লিখেছেন লিখেছেন এস ইসলাম ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:১৮:৫৩ সকাল



“অন্ধকারের বনলতা সেন ও আলোকিত সুলতা”

–ডঃ সৈয়দ এস আর কাশফি



বাংলা সাহিত্যে কবি জীবননান্দ দাশের কাব্যনায়িকা বনলতা সেন। তাকে নিয়ে অতীতে অনেক মাতামাতি হলে ও বিষয়টি এখন থিতিয়ে পড়েছে। প্রাচীন যুগের আবহে যে বনলতাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন সে পরিবেশ আজ আর নেই। আজ আর কেউ অন্ধকারে দয়িতার সাথে সাক্ষাৎ করতে যায় না। প্রেম আজ আর কোন গোপনীয়তার ধার ধারে না। তরুণ-তরুণীর প্রেম আজ প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষা করতে হয় না। তাই আজ আধুনিক যুগের কাব্য নায়িকা সুলতার জয়জয়কার সর্বত্র।

কবি শফিকুল ইসলামের “তবুও বৃষ্টি আসুক” অনন্য সুন্দর কাব্যগ্রন্থে ‘সুলতা প্রসঙ্গ’ অনন্য কাব্যরস সৃষ্টি করেছে। কবির ব্যাকুল মন সুলতার মাঝেই অন্তহীন প্রেম খুঁজে বেড়িয়েছে ও আশা নিরাশার দ্বন্ধে আন্দোলিত হয়েছে । এখানে কবির কাব্য প্রেয়সী সুলতা এক অনিন্দ্য মাধুরীময় নারী। প্রেমিক যখন হৃদয়ভরা প্রেম নিয়ে তার প্রেমাস্পদকে খোঁজেন তখন ঐ অপরূপা তুলনাহীনার জন্য তার মনে জন্ম নেয় হাজারো আশা নিরাশার গুঞ্জরণ। তেমনি “তবুও বৃষ্টি আসুক” কাব্যে কবির মনে সুলতার জন্যে জন্ম নিয়েছে আশা নিরাশার দ্বন্ধ এবং তাকে পাওয়ার ব্যাকুল আগ্রহ। যেমন তিনি গভীর দরদমাখা বাক্যে বলেছেনঃ–

“সুলতা তুমি এসে আমাকে

মুক্ত করে আলোতে নিয়ে যাও

অনন্তকাল আমি তোমারই প্রতীক্ষায় আছি”।

(সুলতা, আজ তুমি কোথায় জানি না)

কবি জীবনানন্দ দাশের মনে যেমন আঁচল ফেলেছিল একজন বনলতা সেন,কবি ফখরুখ আহমেদের মনে যেমন ঠাঁই নিয়েছিল একজন দিলরুবা । কবি র‌্যাবোর মনে যেমন প্রেমের জোয়ার এনেছিল একজন আফেলিয়া এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে যেমন ঝংকার তুলেছিল একজন নীরা তেমনি কবি শফিকুল ইসলামের মনে কবিতার ডানা মেলে উড়ে চলেছে একজন সুলতা। হৃদয়ের একান্ত আপন সুলতা । ভালবাসার একান্ত আপন সুলতা। কবি জীবননন্দ দাশ যেমন বলেছেনঃ–

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে

সিংহল সমূদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি,আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন

আমারে দূ-দন্ড শাস্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন”।

তেমনি কবি শফিকুল ইসলাম বলেছেনঃ–

“সুলতা বহুদিন পর আজ

তোমার উদ্বেগভরা কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম।

আমার তপ্ত ললাটে কোমল হাত ছুয়ে

তুমি পরখ করে নিলে আমার জ্বরের মাত্রা।

আর তোমার যাদু-স্পর্শে আমি যেন তখন থেকেই

একটু একটু করে আরোগ্য হয়ে উঠলাম।”

(সুলতা, বহুদিন পর আজ)

দিলরুবার প্রতি কবি ফখরুখ আহমেদ যেমন বিমোহিত এবং তার ব্যাকুল মনের সুরঃ–

“বল কোন শাহবাদে অপরূপ সওদাগরজাদী

গোলাপ কুড়িঁর মতন মেলেছে রূপের মুক্তাদল

অমা অন্ধকার যার কেশপাশে রয়েছে বিবাদী”।

তেমনি সুলতার জন্য কবি শফিকুল ইসলামের মানসপটে ও আঁখির আঙিনায় এমনি এক অপরূপ আদল জন্ম নিয়েছে যা এ পৃথিবীর হাজারো মুখ দেখেও বিস্মৃত হয়না, হবার নয় এবং একজন একান্ত সুলতাই অন্তরে জাগ্রত থাকে এবং বারবার তাকেই ফিরে পেতে চায়। এমনি এক অপরূপা তুলনাহীনা সে । তাইতো কবি ব্যাকুল উচ্চারনঃ–

“ভালবাসা চিরদিনই অপরাজেয়”

এই ধ্রুব সত্যের সত্যতা রক্ষার জন্য

না হয় তুমি ফিরে এসো।

সুন্দর একটি পৃথিবীর নামে

আমি তোমাকে আহ্বান করছি-

একটি মুমূর্ষু হৃদয়কে বাঁচানোর নামে

আমি তোমাকে আহ্বান করছি,

একটি সুন্দর আগামীর নামে

আমি তোমাকে আহ্বান করছি,

তুমি ফিরে এসো-

আর কোন দ্বিধা নয়

চলে এসো তুমি

এই ভালবাসাকে ভালোবেসে”

(সুলতা, এখনও সময় আছে)

কবি র‌্যাবো ,একজন অফেলিয়া যিনি তার কাব্য প্রেয়সী তারই প্রেমে হয়েছিলেন আকুল। মানসপটে অহরহ দেখতে পেতেন শান্ত আর কালো কালো ঢেউয়ের ওপরে নত্রেরা যেখানে ঘুমায়,সেখানে বিশাল কুমুদীর মতো সাদা অফেলিয়া ভাসে ,ভেসে চলে খুব ধীরে ধীরে ,শুয়ে তার দীর্ঘ ওড়নায় । তেমনি কবি শফিকুল ইসলামের মনের গভীরেও সুলতার প্রতিচছবি যা ভোলা যায়না । তিনি ভোলেন না । বিস্মৃতির আচড় থেকে সুলতা বহু বহু দুরেই থেকেই যায় । তাইতো কবির উচ্চারনঃ–

“সুলতা তোমার কাছে

আমার অনেক অপরিশোধিত ঋণ

তোমার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো আমার

জীবনে অমূল্য সম্পদ”।

(সুলতা তোমার কাছে)

“তবুও বৃষ্টি আসুক” কাব্যে সুলতা এমন এক অপরূপা নারী যা কবি শফিকুল ইসলামের সমগ্র কাব্যমন জুড়ে জড়িয়ে আছে । জড়িয়ে আছে কবির চোখের কার্নিশ, জুড়িয়ে আছে কবির মনের প্রান্তর । আঁখির আঙিনা থেকে মনের উঠান সর্বত্র শুধূ সুলতার আদল কবিকে করেছে মুগ্ধ । তাই কবির মননে মগজে একমাত্র সুলতা। শুধুই সুলতা ,হৃদয়ের ভাজে ভাজে কেবলই সুলতা।তাই কবির সহজ উচ্চারনঃ–

“আমার দুচোখ জুড়ে সারাক্ষণ

তোমারই মুখচছবি ভাসে

আমার বুক জুড়ে তুমি শুধু তুমি”

(প্রিয়তমা বল কি করে)

কবি জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের সৌন্দর্য বর্ননায় বলেছিলেনঃ–

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা

মুখ তার শ্রাবন্তির কারুকার্য”…

(বনলতা সেন)

এখানে জীবনান্দ দাশ বনলতা সেনের চুলে ও মুখে সৌন্দর্য খুঁজে বেড়িয়েছেন এবং উপমায় তা প্রকাশ করেছেন । অন্যদিকে কবি শফিকুল ইসলাম সুলতার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেনঃ–

“তোমার দেহের প্রতিটি বাঁক

অঙ্গের ভাজে জমে থাকা এতটুকু মেদ

সবই আমার মুখস্থ

সারাক্ষণ তোমার সৌন্দর্য আমি আবৃত্তি করি”।

(প্রিয়তমা বল কি করে)

অন্য এক জায়গায় তিনি আরো বলেনঃ–

“এখনও মনে পড়ে যেন

অবিকল তার চেহারা,

সেই হুবহু মুখের আদল

ভ্রু-ভঙ্গিমা ,পটল চোরা চোখ

গোলাপ পাপড়ির মত

রাঙা ঔষ্ঠরেখা,

শাওন -মেঘ কালো চুলের বন্যা,

সবই মনে পড়ে

দাড়ি-কমা ,সেমিকোন

প্রতিটি যতিচিহ্ন সহ।

তার প্রতিটি কথা যেন

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতার

এক একটি পংক্তি,

তার কন্ঠস্বরের উত্থান পতন

যেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত,

তার যৌবনভরা সুগঠিত দেহ

যেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য”।

(আকাশের মেঘও এক সময়)

এখানে কবির হৃদয়ে এমনি এক প্রেমিক পুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় যিনি সুলতার সৌন্দর্যের দরিয়ায় আকন্ঠ ডুবে । সুলতার সৌন্দর্য আঁখির পেয়ালা ভরে পান করেছেন । একজন কবি হাফিজ যিনি তার প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য সমরকন্দ কিংবা বোখারা অনায়াসে বিলিয়ে দিতে পারেন । সেই প্রিয়ার বিরহে কবির হাল কতটা বেহাল হয়ে পড়েছিল সে উচ্চারন আমরা জোরালোভাবে পাইনা কিন্তু “তবুও বৃষ্টি আসুক” কাব্যে ঠিকই খুঁজে পাওয়া যায় । একজন সুলতাকে না পাওয়ায় কবির ব্যাকুল হৃদয় কতটা বিদগ্ধ কতটা বিহ্বল । তাইতো তার অন্য রকম উচ্চারনঃ–

“তুমি তো জাননা

তুমিহীন সুস্থ্য জীবনে আমি কতটা অসুস্থ

তুমি জাননা

তোমার সান্নিধ্য সুখের অভাবে

আমি কতটা অসুখী

তুমিহীন আমার জীবনে

নেমে আসে মৃত্যুহীন মৃত্যু।”

(সুলতা, বহুদিন পর আজ)

তিনি আরো বলেছেনঃ–

“সুলতা যে দিন তুমি

আমায় ছেড়ে চলে গেলে

তখন থেকে এ ঘর

আমার কাছে কারাগার

আমার সমস্ত দিন

কখন নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার রাতে

পর্যবসিত হয়ে যায়

তুমিহীনতায়”

(সুলতা তোমার মত)

কবি শফিকুল ইসলামের উপরের কাব্যাংশ পারস্যের বিখ্যাত কবি মাওলানা রুমীর কয়েকটি পংক্তিকে মনে করিয়ে দেয়। সেগুলোঃ–

(১) প্রেম মহব্বতে ব্যথা কষ্ট কেশ দূর হয়। প্রেম মহব্বতে অসুখ সুখ হয় ।

(২) প্রেম মহব্বতে জেলখানা ফুলবাগান মনে হয়। মহব্বতের অভাবে ফুল বাগানও কন্টকময় জঙ্গল বলে মনে হয় ।

(৩) প্রেম মহব্বতে অসুস্থ সুস্থ হয় । প্রেম মহব্বতে আজাব রহমত হয়।

সুলতার প্রতি কবি শফিকুল ইসলামের ভালবাসা অন্তিমে আধ্যাত্মিক প্রেমের মূল উপকরণে বিলীন হওয়াকে মনে করিয়ে দেয়। যে প্রেমে সুফীগণ খোদার সঙ্গে আপন সত্তায় মিলন ঘটান অনেকটা সেরকম প্রেমের ঝংকার কবি শফিকুল ইসলামের কবিতায় পাওয়া যায় । যেমনঃ–

“তুমি বিশাল আকাশ হয়ে

আমার পৃথিবী ঘিরে আছ,

তুমি নদীর স্রোতধারার মতো অবিচেছদ্য

ঢেউয়ের মতো অবিভাজ্য আমার জীবনে,

আমার জীবন আর তুমি

নদীর জল আর তীরের মতো

এক হয়ে মিশে আছ।

আমার প্রেম আর কবিতার মতো

এক হয়ে মিশে আছো তুমি

আমার চিত্তে”।

( প্রিয়তমা, যখন দেখি তুমি নেই)

সর্বদিক থেকে সুলতা একটি সার্থক কাব্য চরিত্র যা কালোত্তীর্ণ ও কাব্য মধুর।

আরো জানতে ভিজিট করুনঃ–


http://www.somewhereinblog.net/blog/sfk505

বিষয়: সাহিত্য

১২২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File