অকৃত্রিম মায়া

লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ০২ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:৪৩:২৮ রাত



বেলা ১টা বাজতে চলল,অথচ এখনো একটা তরকারীও রান্না হয়নি!সকালে আনা সবজি গুলোও সেভাবেই পড়ে আছে!এটাকে কি সংসার বলে??!খিটমিট করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকলেন রাশেদা বেগম। চূলোয় ভাত বসিয়ে দিয়ে,ফ্রিজ খুললেন,মাসের আজকে ৫তারিখ চলে যাচ্ছে অথচ এখনো বাজার করা হয়নি!ফ্রিজটা একদম খালি হয়ে আছে যেনো!গোশত খুঁজলেন,পেলেন না,শেষে এক প্যাকেট কই মাছ পেলেন,তাও কুটে রাখা হয়নি কিন্তু কি আর করা?সেগুলোই নামালেন। পানিতে ডুবিয়ে সবজি গুলো কাটার জন্য বসার চেষ্টা করতেই কোমরের ব্যাথাটা আবারো নড়েচড়ে উঠলো যেনো!কিছুক্ষন ব্যাথাটা সহ্য করার চেষ্টা করলেন। না পেরে শাঁক গুলো হাতে নিয়েই বড় ছেলের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন,মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা।

বড় ছেলের দুই বছর বয়সের মেয়েটার জ্বর গতকাল থেকে,কিছুই খাচ্ছে না,এক মুহুর্তের জন্যেও মা কাছ ছাড়া হতে পারছে না,ওদিকে মেজো বউ এর বোনের বিয়ে তিনদিন হলো ভাইয়ের বাড়ি গেছে। ছোট ছেলের নতুন চাকরী,সেই সকালে যায় রাতে আসে,ছেলেদের বাবা ব্যাবসায়ী মানুষ,সেও সকালে যায় ফিরার ঠিক ঠিকানা নেই। বড় দুই ছেলে বিয়ে করিয়ে রাশেদা বেগম ভেবেছিলেন সংসার থেকে বুঝি এবার একটু রেহাই মিলল!কিন্তু নাহ... অতো সহজ না। ্রাশেদা বেগম খেয়াল করেছেন,যতোদিন উনি সূস্থ থেকে সংসারে কি হচ্ছে না হচ্ছে খেয়াল করেন,ততোদিন কোন কাজই পড়ে থাকে না,বউদেরও তাড়া দিতে হয় না,কিন্তু যেই না,উনি একটু অসূস্থ হয়ে সংসারের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন ওমনি মনে হয় ঘর একদম মানুষ শূন্য হয়ে যায়!!

-আমার কুটিটার জ্বর কি কমেছেরে?'' বলতে বলতে ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেন,বউমা মেয়ের জ্বর মাপছে। রাশেদা ঘরের দিকে চোখ বুলালেন একবার!মনে হয় টর্নেডো হয়েছে!মনে মনে একটু রাগও লাগল তার,'বউটা যে কি,গেলে একদিকেই খালি যায়,আশে-পাশে আর কোন খবর নেই যেনো!ছেলে-মেয়ে তো আমরাও মানুষ করেছি,একটুতেই এতো খাপছাড়া হলে চলে?আর আমার ছেলেটাও হয়েছে,দেখছে মেয়েটার অসুখ,সে কি পারেনা একটু রুমটা,কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখতে?!সব খালি বউয়ের উপর দিয়ে রাখবে!!''

-না আম্মা,জ্বর কমেনি,বিকেলে আপনার ছেলে আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো ভাবছি।

-হুম,তাই করো,আচ্ছা ,বউমা সবজি পিলার আর চাকুটা কই রাখছো পাচ্ছিনা,আমি তো নিচে বসতে পারিনা,তাই দাঁড়িয়ে কাটবো!

-ওগুলা তো আম্মা ফ্রিজের উপরে ঝুড়িতে রাখা আছে,আপনি কাটবেন যে?হানিফের মা আসেনি আজকে?

-নারে মা,আসলে তো হইতোই,তুমি কি পারভিনকে কোথাও পাঠিয়েছো?

-হুম,আপনার নাতিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে।

-ওহ!' রাশেদা আস্তে আস্তে নেমে দোতালায় আসলেন। ছুটা বুয়াটা আজও আসেনি,কাজের মেয়েটাও বাইরে গেছে কতোক্ষনে এতো কাজ শেষ করবেন বুঝতে পারছেন না!ওদিকে মিরাজ সাহেব দুপুরে বাসায় এসে টাইম মতো খাবার না পেলে রেগে যাবেন। দ্রুত হাতে কাজ করার চেষ্টা করতে লাগলেন রাশেদা বেগম। এমন সময় পারভিন আসলো নাতিটাকে নিয়ে,ওকে দেখে বললেন,

-তাড়াতাড়ি নাফিসকে নাশতা খেতে দিয়ে,কাজে নেমে পর,আজ হানিফের মা আসেনি,তুই কাপড় ভিজিয়ে ঘর পরিস্কার করা শুরু কর।

চূলোয় তরকারী বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ফল বের করে কেটে উপরে নিয়ে গেলেন,নাতনিটা কমলা খুব পছন্দ করে,একটু যদি খায় এখন!ওর মায়ের হাতে বক্সটা দিয়ে বললেন,

-বউমা,আজ মাসের ক'তারিখ মনে আছে?

মুনা আমতা আমতা করে বলল,

-৫তারিখ মনে হয়!

-হ্যাঁ,৫তারিখই আজ,কিন্তু এখনো বাজার করা হয়নি,জানোই তো,তোমার জামাই-শ্বশুড় হাতে লিষ্ট ধরিয়ে তাগাদা না দিলে বাযার করবে না জীবনেও!ফ্রিজ একদম খালি,পারলে আজকেই লিষ্ট বানিয়ে ফেলো...

-সরি মা,ভুলেই গিয়েছিলাম!

-হুম,এতো সহজে ভুললে কি আর চলবেরে মা?সংসার ভুলার জায়গা না,যতো কিছুই হোক গিন্নীকে ঠিকই সব মাথায় রাখতে হয়... ''বলতে বলতে নীচে নেমে আসলেন।

কিচেনে ঢুকে আরেকবার মেজাজ খারাপ হলো রাশেদা বেগমের!নাহ,বউরা যে কোন জিনিস এখন কোথায় রাখে,কিচ্ছু খুঁজে পাওয়া যায় না...জিরার বয়াম কোথায় রেখেছে কে জানে?!'বয়াম খুঁজে দেখেন জিরা একদমই শেষ!!পারভিনকে ডাকলেন,কিন্তু ও মনে হয় কাপড় ধুচ্ছে পানির আওয়াজে তার ডাক শুনতে পাচ্ছে না! নিজের ঘরে এসে টিএন্ডটি থেকে মিরাজ সাহেবের দোকানে ফোন দিলেন,

-এইযে শুনেন,বাসায় জিরা মনে হয় শেষ,আসার সময় নিয়ে আইসেন

-জিরার কেজি এখন কতো জানো?৪০০টাকা। গত মাসে দু'বার জিরা কেনা হয়েছে,যেমন তুমি তেমন তোমার বউয়েরা!কোন কিছুর প্রতি মায়া নাই!!

রাশেদা বেগমের মেজাজ আরেকবার চড়ে গেলো!

-সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়েছেন এখন ছেলের বউদের সাথে শুরু করেছেন!গত মাসে দু'বার জিরা কিনেছেন সেটা মনে আছে,গত মাসে যে মেহমানের বহর গেলো সেইটা মনে নাই?রান্না করলে কি খালি আমরাই খাই?

-হুম,এখনতো মেহমানের দোষ!তোমরা নিজেরা সংসার চালাবা না,দুই-চারটা কাজের লোক ছাড়া তোমাদের চলে না সেইটা বলো!সংসারটার প্রতি কোন মনোযোগই তোমাদের নাই!

-ঠিক আছে,বাজার করা লাগবে না আপনার,করলাম না রান্না,লাগবেনা আপনার বাসায় খাওয়া...যত্তোসব!!'বলে ফোনের রিসিভারটা রেখে দিলেন রাশেদা। রাগে ঘামছেন তিনি! কিছুক্ষন বসে থেকে আস্তে আস্তে উঠলেন,টাকা বের করে পারভিনকে দোকানে পাঠালেন জিরা আনার জন্য। ছোট ছেলের ঘরে এসে গোছাতে গোছাতে ভাবলেন, ''হায়রে সংসার!আজ ৩৫বছরের ও বেশি হলো অথচ মানুষটা যদি একটু বদলাতো?,সংসারে জিনিসপত্র কেনা,ছেলেদের খরচ নিয়ে খিটমিট করার স্বভাব আজো বদলালো না!আমি মরে গেলে এই লোকটা যে কিভাবে ছেলের বউদের সাথে মিলে-মিশে থাকবে কে জানে!!অন্যদিকে ছেলের বউরা... এতোদিন হয়ে গেলো এ সংসারে এসেছে,এখনো পর্যন্ত সংসারটাকে গুছিয়ে চালানো শিখলো না!কি যে করবে এরা আমি না থাকলে কে জানে...!''

মুনা মেয়েটাকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ছেলেকে গোসল করিয়ে নিচে নিয়ে আসলো,এসে দেখে শ্বাশুড়ি দেবরের রুম গোছাচ্ছে,কাজের মেয়েটা কাপড় ধুচ্ছে। চূলো থেকে খাবার নামিয়ে টেবিল সাজাতে সাজাতে ভাবল,

'এই হলো মা...নিজে অসূস্থ,ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না,নিচে বসতে পারেন না কিন্তু তারপরেও টাইম মতো সবার খাবার ঠিকই রান্না করেছেন,অথচ পারতেন সব এভাবেই ফেলে রাখতে,কিন্তু করেননি। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে তেমন কিছুই বলেননি,কতো মায়া-ভালোবাসাই না সবার জন্য আল্লাহ দিয়ে রেখেছেন উনার মনে!!আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়াহ যে এখনো শ্বাশুড়ি বেঁচে আছেন না হলে এতো বড় সংসার,এত গুলো মানুষের যে কি হতো কে জানে!!''

আস্তে আস্তে দেবরের রুমে গেলো,বলল,

-আম্মা,আপনি এখন যান,নামাজ পড়ে খেয়ে নিন,অনেক কাজ করেছেন আজকে,এবার আমি সামলাই,আব্বা আসলে আমিই খাবার দিবো,আপনি যান,আমি করছি।

রাশেদা বেগম হাসলেন। আস্তে আস্তে হেঁটে নিজের ঘরে আসলেন। নামাজ শেষ করে মুনাজাতে বললেন,

'হে আল্লাহ,কতো মায়া দিয়ে রেখেছেন এই সংসারের প্রতি,অথচ আপনি ডাক দিলেই চলে যেতে হবে সব ফেলে!এতোদিন ধরে এই সংসারে যা যা করেছি তার কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না সাথে,তারপরেও কতো চিন্তা লাগে! আল্লাহ গো,আমার জামাই-সন্তানদের উপর আপনি রহম করেন,তাদরকে ভালো রাখুন,আপনার পথেই রাখবেন,আমীন।'

শ্বাশুড়িকে খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিলো,দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলো উনার মুনাজাত। মুনার মনে হলো জায়নামাযে বসা শ্বাশুড়ির জায়গাটাতে সে বসে আছে... একটা সময় হয়তো এটাই হবে,তাই আপনাতেই সেও বলল,'আমীন'

বিষয়: Contest_mother

১৫৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File