আমার আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ১০:৪৬:৫৬ সকাল
''ভাবি,আর তো দেরি করা যায় না এবার মেয়েকে বিদায় দিন''সালাম সাহেবের কোথায় সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরে,তানিয়ার বাবা-মাকে খোঁজা শুরু হয়...একে তো এ বাড়ির প্রথম বিয়ে তার উপর বড় মেয়ের বিয়ে সে জন্য খুবই অস্তির অবস্থায় আছেন তানিয়ার পরিবার।কিছু যেন বাদ না পরে যায়...তানিয়ার মা ইচ্ছে করেই তানিয়ার সামনে আসছেন না,মেয়ের সামনে গেলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না তাই সারা অনুষ্ঠানে তানিয়া হাজার খুঁজেও মাকে কাছে পায়নি।ছোট বোনকে দিয়ে অনেক খূঁজিয়েছে মায়ের সাথে একটা ছবি তোলার জন্য কিন্তু দেখাই পেল না।
তানিয়া এ বছরই মাস্টার্স শেষ করছে এপ্লাইড ফিজিক্সে,পাশাপাশি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পার্ট টাইম টিচার হিসেবে জয়েন করেছে ভালো রেজাল্টের সুবাদে,ইচ্ছে আছে মাস্টার্স শেষ করে দেশের বাইরে পিএইচডি করতে যাবার। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবার বড় মেয়ে তানিয়া,সরকারী চাকুরীজীবি বাবার সংসারের অনেক কিছুর অভাব সে দেখেছে,সব থেকে বড় কথা হলো মেধা থাকা সত্তেও অর্থের অভাবে অনেক পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও না পাওয়ার কষ্ট সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ওর আছে।শুন্য থেকে সবকিছু পূর্ণ হতেও দেখেছে সে।তানিয়ার মা একজন পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা গৃহীনি। যোগ্যতা আর স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও অনেক স্বপ্নকে চাপা দিয়ে সন্তান আর সংসারের মাঝেই নিজের দুনিয়া তৈ্রী করে নিয়েছেন তিনি।
মায়ের বড় মেয়ে তানিয়া,মায়ের ভেতরে পুষে থাকা ডানা কাটা সেই পাখির আর্তনাদ তানিয়া খুব ভালো ভাবেই শুনতে পায়।
অনেক বার তানিয়া আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছে,কেন তিনি তার বান্ধবিদের সাথে যোগাযোগ করেন না?কেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তনদের কোন অনুষ্ঠানে কখনো যান না?মা হাজার অজুহাত দেখিয়ে তা এড়িয়ে যান,কিন্তু তানিয়া জানে আম্মু সেসব এড়িয়ে চলেন।আম্মুর বান্ধবীরা সবাই যে যার মত ভালো প্রফেশনে প্রতিষ্ঠিত,আর অন্যদিকে আম্মু শুধু মাত্র গৃহীনি।তানিয়া অনেকবার আম্মুর বান্ধবীদের মুখে শুনেছে আম্মু ছিল তাদের ব্যাচের সেরা ছাত্রীদের মধ্যে একজন কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ আম্মু শুধু মাত্র তার সংসারের দিকে তাকিয়ে সব ছেড়ে দিয়ে জীবন পাড় করছেন।অনার্সে ভর্তির সময় আম্মু বলছিলেন,ভার্সিটির ইংলিশের টিচার হবার অনেক স্বপ্ন ছিল তার,খুব শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে না হলেও আম্মু নাকি ইংলিশে সব সময় মার্ক করা রেজাল্ট করতেন। দিন যতই যায় তানিয়াকে আম্মুর এই কষ্টগুলো অনেক বেশি নাড়া দেয়।অনেকবার আম্মুকে বলেছে,''আম্মু তুমিতো চাইলেই শিক্ষকতা পেশাটা বেছে নিতে পারতে,তোমার যোগ্যতা ছিল তুমিতো তোমার তিন সন্তানের সাথে আরও অনেকের সন্তানকে মানুষ করতে পারতে...''কিন্তু আম্মু সেসব প্রশ্ন বেশিরভাগ সময় এড়িয়েই গেছেন।আর তাই তো নিজেকে মেয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রান চেষ্টা ওর।যদিও আম্মু এখন সংসারের মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে রাখতে অনেকটাই অভ্যস্থ হয়ে গেছেন,এখন আর নিজের স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট কোনভাবেই প্রকাশ করেন না তারপরেও তানিয়া বুঝে সবই।আব্বু কখনো বাধা দেননি ঠিকই কিন্তু উপযুক্ত সমর্থন ও করতে পারেন নি,কারন দাদা-দাদী অথবা নানা-নানী কেউই মেয়ে বা বউ চাকরী করুক তা চায়নি,লেখা পড়া শিখেছে এখন সন্তান-সংসারের দেখাশুনা করবে,এর বেশি কিছু করার ব্যাপারের কখনোই তাদের কোন সাপোর্ট আম্মু পায়নি। তানিয়া দেখেছে শহরে থাকলেও আম্মুদের বাড়ির সবার ধ্যান ধারনা অনেক পুরোনো,মেয়েরা লেখা পড়া শিখতে পারে কিন্তু চাকরী করার কোন মানে নেই,যত শিক্ষিতই হোক না কেন মেয়েদের আসল জায়গা রান্না ঘরে...এ নিয়ে আম্মু কম যুদ্ধ করেন নি তাদের সাথে কিন্তু সংসারের কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে আম্মু আর পারেননি।
তানিয়া ইন্টারে উঠার পর থেকেই আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বেশ তাড়া আসতে থাকে তানিয়ার আম্মুর কাছে,''মেয়ে বড় হয়েছে এখন থেকেই ভালো ছেলে খুঁজতে থাকেন,পরে কিন্তু ভাল ছেলে পাবেন না...মেয়েরা তো কুঁড়িতেই বুড়ি,শেষে যেমন তেমন ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে হবে...ওমুকের মেয়েকেও তো পড়াশুনা শেষ না করে বিয়ে দিতে চায়নি শেষ পর্যন্ত মেয়েকে নিয়ে কি ভোগান্তিটাই না পোহাল...ইত্যাদি অজস্র কথার বানে অস্থির থাকেন তানিয়ার মা।অনেক বার বাধ্য হয়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করেছেন কিন্তু মেয়েকে রাজী করাতে পারেননি কোন ভাবেই,বাধ্য হয়ে মেয়ে এখন আত্নীয়-স্বজনদের বাসায় যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছে,ওর শুধু একটাই স্বপ্ন নিজের একটা পরিচয় তৈ্রী করা,যে পরিচয়ে ওর বাবা-মা পরিচিত হতে গর্ববোধ করবেন,যে পরিচয় ওর আলোকিত ভবিষতের নিশ্চয়তা দিবে...
দূর থেকে তানিয়ার খুশী ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মা।কতোদিন গেছে মেয়ের বিয়ের চিন্তায় রাতের ঘুম বাদ দিয়ে আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করতেন।অনার্সের পর বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রোপজাল তানিয়া ফিরিয়ে দিয়েছিল ওর চাকুরী করাকে সাপোর্ট দিবে না সে জন্যে।একবার তো মহা কান্ডই হয়ে গিয়েছিল একটা প্রোপজ নিয়ে,ছেলে ব্যাবসায়ী ছিল,ঢাকায় প্রতিষ্ঠীত বাবা-মায়ের উচ্চ শিক্ষিত ছেলে তানিয়া বা ওর পরিবারের কারোরই না করার কোন কারন নেই।দু'পরিবারের মধ্যে কথা বলা যায় সে জন্য পাকা হয়ে আছে,এর মধ্যে একদিন সবার সম্মতি নিয়ে তানিয়া ছেলের সাথে কথা বলতে যায়।কথা বলে এসে তানিয়া মাকে জানিয়ে দেয় এই ছেলে সে বিয়ে করবে নাম,শুনে তো সবার মাথায় হাত...কারন হল,তানিয়া যখন ছেলে কে বলল,তার স্বপ্ন আছে সংসারের পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হবার তখন নাকি ছেলে বলেছে,হুম অনেক ভালো স্বপ্ন আপনার তবে আমাদের সমাজে মেয়েরা অমন স্বপ্ন দেখে ঠিকই কিন্তু সংসারের যেয়ে সেটা আর পূরন করতে পারেনা,আমার এ নিয়ে আপত্তি নেই তবে আপনি হয়তো শুনেছেন আমার বড় ভাই-ভাবি কানাডা থাকেন আমি একমাত্র আব্বা-আম্মার সাথে আছি,সুতরাং আমার যে বউ হবে সে পুরো সংসার দেখাশুনা করবে এটাই সবাই আশা করছে আর আমি তো ব্যাবসায়ী মানুষ অনির্ধারিত সময় আমাকে বাইরে থাকতে হয় সুতরাং সব কিছু সামলে আপনি আপনার স্বপ্ন পূরন করতে পারলে তো ভালোই আমার তরফ থেকে কোন আপত্তি নেই...''ব্যাস এসব শুনে তানিয়া বুঝে গেছে এই পরিবার থেকে তার হেল্প আশা করা অর্থহীন।বিয়ের পরে পড়া শুনা করার সাপোর্ট হয়তো অনেক ছেলেই দেয় কিন্তু বউকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সাপোর্ট সবাই দেয় না।সব শুনে তানিয়ার মামাদের সে কি রাগারাগী,মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে আপা,মুরুব্বীদের পছন্দের কোন তোয়াক্কাই করেনা মেয়েটা...আরো কত কথা,কিন্তু তানিয়া অটল এই ছেলে সে বিয়ে করবে না।
তানিয়ার বাবা আর ছেলের বাবা দু'জনেই একসাথে এসে মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দিলেন,অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকে রাখতে পারলেন না তানিয়ার বাবা...মুখে সাপোর্ট না দিলেও মনে মনে ঠিকই চাইতেন মেয়েটা প্রতিষ্ঠিত হোক,ওর যোগ্যতার সঠিক ব্যাবহার ও করুক,কিন্তু ভয়ও পেতেন মধ্যবিত্তদের তো জ্বালা কম না,তার উপর মেয়ে মানুষ কিছু না হলেও অনেক কিছুই হয়ে যায়।
তবে খুশির কথা তানিয়া ওর যোগ্যতা অনুযায়ী এবং চাওয়া অনুযায়ী বর পেয়েছে,আল্লাহ তাদের সবার দোয়াই শুনেছেন। আত্নীয়-স্বজনরাতো এখন খুবই খুশী আবার কেউ কেউ জেলাস ও করছে...
সবার কাছ থেকে অনেক কষ্টে বিদায় নিচ্ছে তানিয়া।খুব কষ্ট হচ্ছে ওর,এতদিনের এই পরিচিত মানুষদের ছেড়ে এই আপনজন দের ছেড়ে কিভাবে থাকবে ও...এতদিন তো আর কেউ না হোক ওর বাবা-মা সাথে ছিল আর এখন তো অনিশ্চিত একাকীত্ব বলা যায়। তবুও মনকে শক্ত করে মায়ের কাছে যায়।অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলে,
--আসি আম্মু,আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,অনেক পেরেশান করেছি তোমাকে...বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল তানিয়া।
কিছুক্ষন পর তানিয়া ওর আম্মুর অন্যরকম কন্ঠ শুনতে পেল...
--কাঁদবে না মা'মনি,তুই আমাকে কষ্ট দিসনি তুই তো আমার গর্ব,আমার স্বপ্ন...আয়নায় তুই তো আমার প্রতিবিম্ব।একটা কথা মনে রাখিস তোকে অনেক ধৈর্য ধরে সব কিছু সামলাতে হবে সব কিছু...কখনো কোন কিছুকে অবহেলা করবিনা,না সংসার না ক্যারিয়ার।যে যাই বলুক,তোকে প্রমান করতে হবে সংসার আর সন্তান পালন ছাড়াও আরও সব ক্ষেত্রে মেয়েরা সফল,আমি যেন বলতে পারি আমার শুধু সাকসেসফুল প্রফেশনাল ই না সাকসেসফুল গৃহীনিও।শুধু কন্যা হিসেবেই না জায়া এবং জননী হিসেবেও আমরা মেয়েরা সফল এটা প্রমান করবি। একটু কষ্ট হবে তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে,নিজের ভেতরের আত্নবিশ্বাস কখনো হারাবি না।কারন তোর সন্তানের চোখেও স্বপ্ন তোকেই একে দিতে হবে তাই না?
সুন্দর পরিবার গড়ার,সমাজ গড়ার তোর সন্তানরা তোকে দেখেই দেখতে শিখবে...ঠিক আছে?আর কখনো কোন সাহায্য লাগলে নির্দ্বিধায় চলে আসবি...কোন দ্বিধা বোধ করবিনা...তোর আম্মুর দোয়া আর সাপোর্ট সব সময় তোর সাথেই আছে...''বলতে বলতে এবার তানিয়ার আম্মুও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
গাড়িতে স্বামীর পাশে বসে তানিয়ার শুধু আম্মুর কথাগুলোই কানে বাজতে লাগল...আমার আয়নায় তুই আমার প্রতিবিম্ব,আমি আয়নায় দাড়ালে আমার বিপরীতে তোকেই দেখতে পাই এবং দেখতে চাই ও সব সময়...
[উৎসর্গ-আমার আম্মু। ]
বিষয়: সাহিত্য
১৩৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন