সূচনায় সমাপ্তি অতঃপর..

লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ১৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৪৮:১৪ বিকাল



রোজ সকালে উঠা,তারপর সবার জন্য নাস্তা বানানো,নিজে নাস্তা করে দুপরের খাবার ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বের হওয়া,তারপর অফিস,শেষ বি্কেলে আবার সেই একই পথে বাসায় ফেরা,রোজ এই একই রুটিন তোর ভালো লাগে?রুটিনটা বদলাতে ইচ্ছা করেনা?''প্রশ্নটা শুনে ঠোটের কোনে বরাবরের মতোই হাসি ফুটে উঠল মনিজার।এই প্রশ্নটা নতুন না ওর জন্য,এর আগেও নায়লা ওকে এই প্রশ্ন করেছে অনেকবার মাথা না তুলে জবাব দিল তাই,

;একই প্রশ্ন আর কতোবার করবিরে নিলু?তুই খুব ভালো করেই এর উত্তর জানিস।

;করি এই জন্যই কারন মনে হয় নতুন কোন জবাব পাবো তাই

;এই প্রসঙ্গ আর টানিস না,আমি এটা নিয়ে আর কথা বলতে চাইনা।

ব্যাস...এটাই শেষ উত্তর।নায়লা জানত,মনিজা যতবারই এ প্রসঙ্গে কথা উঠেছে এই কথা বলেই তার ইতি টেনেছে।মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়লা,আর কিছু না বলে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল,ওর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল মনিজা বেশ সুখেই আছে নায়লা,স্বামী সংসার আর ছেলেকে নিয়ে মনিজার সব বান্ধবীরাই বলতে গেলে এখন সংসার নিয়ে ব্যাস্ত সে নিজেও ব্যাস্ত তবে স্বামীর সংসার নিয়ে না,বৃদ্ধ মা,নিজের চাকরী আর সিলেটের এই সুন্দর ছোট্ট বাসায় তৈরী নিজের দুনিয়াকে নিয়ে।চায়ের কাপে চিনি মিশাতে মিশাতে ভাবে,ভালোইতো আছি এভাবে,মাকে নিয়ে,চাকুরি নিয়ে...এই জীবনটা কিন্তু খুব খারাপ না,মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগলে ঢাকায় বোনের বাসায় ওর বাচ্চাদের সাথে,অথবা ভাইয়ের বাসায় অথবা পুরোনো বান্ধবীদের সাজানো সংসার দেখি, কখনো এই পাহাড় আর প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাই...হ্যাঁ এটা ঠিক,কখনো কখনো খুব একা লাগে,অন্যদের সুখের সংসার দেখে কিছুটা আফসোস লাগে কিন্তুটা যখন এটা ভাবি, সবার ভাগ্যে সব কিছু থাকেনা তখন আর খুব কষ্ট লাগেনা কারন নিজেকে না পাওয়া মানুষের মাঝে ভাবতে ভাবতে এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছি যে......

কইরে,আর কতোক্ষন...?জলদি কর আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে ওর অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেল''নায়লার ডাকে আপন জগত থেকে বাস্তবে ফিরে মনিজা।

মুখে বরাবরের মতো হাসি ফুটিয়ে নাস্তার ট্রে নিয়ে নিজের রুমে যায়,চা খেতে খেতে আবার ও বলে নায়লা,

;তোর হাতের চা এর মতো স্বাদ আর কারো হাতে পাই না,সত্যিরে তুই হলি আসল বঙ্গ নারী যার রান্নায় আছে স্বাদের যাদু!!কিন্তু আফসোস এই স্বাদ নেবার মতো সৌভাগ্যবান মানুষ এখনো কেউ হলো না।

মনিজা আগের মতোই হেসে জবাব দিল,

;কেউ না হলে তাহলে তুই কি?

;আর এ আমি আমার কথা বলছিনা,আমি কার কথা বলছি তুই ভালো করেই জানিস,মনি,

জীবনটা এতো সোজা নারে যতটা তুই ভাবছিস,তাইতো বার বার বলি,জীবনটাকে অন্যভাবে ভাব...

কাপটা পিরিচে রাখতে রাখতে মনিজা বলল,

;আমিতো জীবনকে অন্যভাবেই ভেবেছি,আর দশজনের মত করেতো ভাবিনি,আর সে জন্যইতো ইন্টারের পর থেকে যখন কাজিন আর বান্ধবিরা একে একে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে আমি তখন বাবার অনুপ্রেরনায় নিজের স্বপ্ন পূরনের যুদ্ধ করেছি একা একা এই শাহজালাল ভার্সিটির হলে থেকে।একে একে জয়ী হয়েছি সব গুলো যুদ্ধে সফলভাবে এটাইবা কম কোথায় বল?কয়টা মেয়ে পারে এভাবে নিজের স্বপ্ন পূরন করতে?তোরা কেউ পেরেছিস?

;আমরা কেউ তোর মত পুরোপুরি না পারলেও কিছুটা পেরেছি,তবে তোকে নিয়ে আমরাও অনেক গর্ববোধ করি,এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধে তুই সফল যোদ্ধা,কিন্তু কষ্ট লাগে যখন তোকে একা দেখি,তোর একাকিত্ব দেখি,আর ভাবি এমনতো হবার কথা ছিল না,কিন্তু কেন এমন হলো?

পাশের জানালাটা দিয়ে নিজের দৃষ্টি দূর দীগিন্তে ছুড়ে দেয় মনিজা,অনেকটা আনমনে হয়েই বলে,

;এমনতো হওয়ার কথা ছিলনা সেটা আমিও জানি,এবং না কথা থাকলেও এখন হয়েছে তাই মেনেও নিয়েছি...যে আমি নিজের ভাগ্য নিজে গড়ায় বিশ্বাসি ছিলাম সেই আমি এখন আমার বাকী জীবনকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে্ছি...

আনমনা মনিজার মুখের দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে নায়লা,মাগরিবের আযানের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে দুজনের।

রাতে মাকে মেডিসিন খাইয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে নিজের রুমে আসে মনিজা, কিছুক্ষন হাঁটাহাটি করে ব্যালকনিতে একা একা,তারপর ইজি চেয়ারে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারও আনমনা হয়ে যায়...পড়াশুনা শেষ করে এই চারবছরের চাকুরীজীবনে সফল নারী হিসেবে যেমন অনেক সম্মান পেয়েছে তেমনি নিজের এই একাকি জীবনের জন্য অনেকবার নিজেকে ব্যার্থ ও মনে হয়েছে...কিন্তু সব কিছুর শেষেও ফলাফলটা শূন্যই রয়েগেছে।তবুওতো নিজের জীবনের কোন অস্তিত্ব সে খুজে পায় কোথাও না কোথাও সেটাই বা কম কিসে?জাভেদ তো তাও খুজে পাবেনা কখোনো...

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ৩য় বর্ষের তুখোড় ছাত্রী মনিজার সাথে প্রায় দু'বছরের ছোট মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের জাভেদের বন্ধুর মতো সম্পর্কটা অনেকের কাছেই ভালো লাগতোনা সেটা ভালোভাবেই জানতো মনিজা।কিন্তু এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতো না,ও এখানে পড়াশুনা করতে এসেছে,প্রেম বা বিয়ে করতে না,তবে হ্যাঁ এটা ঠিক জাভেদ তার অন্য বন্ধুদের থেকে আলাদা,খুব খেয়াল রাখে মনিজার,হোষ্টেলের এই একঘেয়ে জীবনে আনন্দের বেশির ভাগ সময় গুলো জাভেদের সাথেই কেটেছে,এমনকি অনেকবার মনিজার সাথে জাভেদ ঢাকা এসেছে শুধু মাত্র এই কারনে যে মনিজা একা একা বাসে গেলে যদি কোন বিপদ হয় সেই ভয়ে,অথচ বলতো ওর নিজেরো ঢাকায় কাজ আছে কিন্তু আসার পর ওকে বাস থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরতি বাসে আবার সিলেট ব্যাক করতো জাভেদ।

ওর এসব পাগলামি প্রথম প্রথম মনিজা তেমন পাত্তা দিতো না কিন্তু দেখতে দেখতে এক ধরনের ভালোলাগা যে কবে থেকে মনের ভে্তর জন্মাতে থেকে টেরই পায়নি মনিজা।দেখতে দেখতে মনিজার ফোর্থ ইয়ার ফাইনা্ল পরিক্ষা শেষ হয়,জাভেদ তখন থার্ড ইয়ারের স্টুডে্নট।মনিজা ব্যাগ গুছাতে থাকে হোষ্টেল জীবন শেষ করে বাসায় ফেরার,ইচ্ছা আছে মাস্টার্স দেশের বাইরে কোথাও করবে।আর অন্যদিকে জাভেদ প্রচন্ড মানুসিক চাপ নিয়ে মলি্ন মুখে মনিজার সামনে বসে ওর স্বপ্নের কথা শুনে,মনিজা খেয়াল করে জাভেদের ভেতর আগের মতো সেই উছ্বাস আর নেই,সব সময়ের মতো এবার জাভেদ ওকে বলছেনা,তুই কোন বাসে ঢাকা যাবি?আমিও তাহলে সেই বাসেই যাব,আমারও ঢাকাতে কিছু কাজ আছে...''

এমনকি মনিজা যেদিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে আসে সেদিন অনেক খুজেও জাভে্দের দেখা পায়নি কোথাও,খুব মন খারাপ হয়েছিল ওর অনেক অভিমান কাজ করছিল মনের ভেতর,কেন এমন করল জাভেদ?ও চলে যাচ্ছে জেনেও একটা বার ও দেখা করতে এলো না?!...

ঢাকায় আসার পর থেকে মনিজা মনের ভেতর কোন শান্তি খুজে পাচ্ছেন,সারাক্ষন অস্থির লাগছে,দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন...অনেক চেষ্টা করেও জাভেদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা কোন খবর নেই জাভেদের,না কোন ফোন না কোন চিঠি...ভার্সিটিতেও নাকি আসছে না অনেকদিন ধরে...উদাস ভাবে মনিজা রুমে বসে ভাবছিল একা একা হঠাৎ মনে হল আ্কাশে প্রচন্ড শব্দে মেঘ ডাকছে বাইরে তাকিয়ে দেখে চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে,দেখতে দেখতে বৃষ্টি শুরু হয়েগেল তুমুল জোরে,মনিজার মনটা হঠাৎ খুব ভালো হয়ে গেল যেন...দ্রুত বারান্দায় এসে দাড়ায়,অনেক্ষন আপন মনে বৃষ্টিতে হাত ভিজেয়ে রাস্তায় তাকাতেই প্রচন্ডভাবে অবাক হয় মনিজা!!জাভেদ...!!!!

মনিজা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে জাভেদ তাকে অনেক ভালোবাসে এমনকি সে নিজেও।কিন্তু এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত সে বা জাভেদ কেউই দেখতে পাচ্ছেনা।প্রায় দুমাস ধরে জাভেদ চেষ্টা করে যাচ্ছে জাভেদের পরিবারকে রাজী করানোর কিন্তু কোনভাবেই জাভেদের কলেজ অধ্যক্ষা মা বয়সে বড় মনিজাকে একমাত্র ছেলের বউ করতে রাজী না একই অবস্থা মনিজার পরিবারেও।কোনভাবেই যখন কোন কিছু সম্ভব হচ্ছেনা তখন জাভেদ স্কলারশিপ পায় ইউকে তে, অনেক ভেবে চিন্তে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়,তবে মনিজাকে কথা দিয়ে যায় ইউকে তে যেয়ে মনিজাকে ও নিয়ে যাবে এবং সেখানেই বিয়ে করে সংসার শুরু করবে দু'জনে,কেউ মানুক আর না মানুক।আস্তে আস্তে সব কিছু অনেকটা নরমাল হতে থাকে।জাভেদ যাওয়ার একবছর পর মনিজাও স্কলারশিপ পায় ইউএসএ তে কিন্তু যাওয়ার আগে জাভেদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারেনা কারন জাভেদের মা শর্ত দিয়েছেন জাভেদের পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে তার সাথে কোন কন্ট্যাক্ট করবেনা,যা হওয়ার জাভেদ দেশে আসার পরেই হবে।অনেক অপেক্ষা আর স্বপ্ন নিয়ে মনিজা চলে যায় সদূর আমেরিকাতে,কিন্তু দেশে ফিরে আসতে হয় ছয়মাসের মাথায় বড় বোনের চিঠি পেয়ে,দেশে ফিরে দেখে সব কিছু শেষ...সব স্বপ্ন সব আশা...

মনিজা চলে যাবার পর জাভেদের মা জাভেদ কে জানায় মনিজা বিয়ে করে বরের সাথে আমেরিকা চলে গেছে আর তাই জাভেদকে কিছু জানিয়ে যায়নি!খবরটা শুনে প্রচন্ডভাবে শকড হয় জাভেদ,কোন ভাবেই সে বিশ্বাস করতে পারেনা...আর তাই দুমাস পরেই পাগলের মত দেশে ছুটে আসে জাভেদ কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসার পথে রোড এ্র্র্যা্কসিডেন্টে করে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায় জাভেদ স্মৃতি শক্তি হারিয়ে এখন পাগল!!মানসিক হাসপাতালে আছে......!

খবরটা শুনার পর সেদিন যেভাবে চমকে উঠেছিল আজকেও কেন জানি সেভাবেই আবার চমকে উঠে মনিজা...অতীত থেকে ফিরে আসে,ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়,প্রতি সপ্তাহে এখনো জাভেদের সাথে হাসপাতালে দেখা করতে যায় মনিজা,আগের মতোই সারাক্ষন চিৎকার করে তবে ওকে দেখলেই না চিনতে পারলেও কেমন যেন শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে জাভেদ।ওর সেই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়েই জীবনের সব কিছু বাদ দিয়ে এই শহরে একা একা জীবন পাড় করে যাচ্ছে মনিজা আজও...সব স্বপ্নই পূরন হয়েছে জীবনের শুধু পাওয়া হয়নি,আর তাই পাবেনা জেনেও মিথ্যে প্রতিক্ষার প্রহর গুনে যাচ্ছে অবিরত...

বিষয়: সাহিত্য

১৪১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File