যন্ত্রনার কান্না..
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ১২ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:১৫:৩১ রাত
সকাল থেকেই শরীরটা যেন কেমন করছে লামিয়ার,কিন্তু অতটা গুরুত্ব দেয়নি,তবে এখন অফিসে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে আরও বেশি খারাপ লাগছে...কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছেনা!১১টার দিকে শরীর আরও খারাপ লাগতে শুরু করল,মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়াটাই ঘুরছে,কোন রকমে উঠে বাথরুমে গেল,অনেকক্ষন পর মাথায় পানি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে টেবিলে এসে বসল।পাশের টেবিলের রুনা আপা প্রশ্ন করলেন,
--কি ব্যাপার বমি করার আওয়াজ পেলাম শরীর খারাপ নাকি?
--হুম,আর বলবেন না কয়দিন ধরেই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে
মুখে মুচকি হাসি টেনে রুনা বললেন,
--সুখবর আছে মনে হচ্ছে...?
কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেল লামিয়া,মাথা ঝাকিয়ে হেসে ফেলল।মুখে হাসলেও মনে মনে একটু শঙ্কিতই হলো লামিয়া,আবার মা হবার কথা মনে হলেই খুব ভয় লাগে...!প্রথম বার দিব্যের জন্মের সময় কি কষ্টটাই না হয়েছিল,যদিও আনিস প্রায়ই বলে 'একটা মেয়ে থাকলে খুব ভালো হতো'কিন্তু লামিয়া আর ভাবতে পারেনা।
সারাদিন পর অফিস শেষে রিকশায় উঠে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠল লামিয়ার,বাসা খুব বেশি দূরে না ওর তাই রিকশায় করেই ফিরে,যদিও আনিস প্রায়ই বলে গাড়ী নেয়ার জন্য।কিন্তু লামিয়ার রিকশাই ভালো লাগে...
ছয় বছর হতে চলল লামিয়ার বিবাহিত জীবনের,বড় বোনের একটু দ্রুত বিয়ে হওয়ায় পড়াশুনা বেশিদূর করতে পারেনি এই নিয়ে মায়ের আক্ষেপের শেষ ছিলনা,আরা তাই ওর বেলায় মাস্টার্স এর আগে বাবা বিয়ের কথা বলার সাহস পায়নি,পড়াশুনা শেষ করে চাকরী আর বিয়ে দুটোই একই বছরে হয়ে যায়।স্বামী আনিসুর রহমান পেশায় ব্যাবসায়ী,মানুষ হিসেবে লামিয়া যেমন চেয়েছিল তার থেকেও অনেক বেশি পেয়েছে বলে মনে করে। যেমন ওর ভালো বন্ধু তেমন ভালো সহযোগীও।শ্বাশুড়ী,স্বামী আর চারবছরের ছেলে দিব্য কে নিয়ে লামিয়ার সুখের সংসার।
আজকাল কাজের মানুষ নিয়ে খুব সমস্যায় আছে লামিয়া,ভালো বিশ্বস্ত কাজের মানুষ পাওয়া খুবই মুশকিল হয়ে পরেছে যেন। ছুটা কাজের বুয়া একজন আছে ঠিকই কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ার কারনে বেশি কাজ করতে পারেনা মিন্টুর মা।তবুও যতটুকু পারেন করেন লামিয়ার বিয়ের অনেক বছর আগে থেকেই এ বাসায় আছেন তিনি।কাজের মানুষ নিয়ে খুব বেশি টেনশন করলে লামিয়ার শ্বাশুড়ী বলেই ফেলেন,'চাকরী ছেড়ে দাও,সংসার কর।'সেই ভয়ে লামিয়া শ্বাশুড়ীর সামনে খুব একটা টেনশন দেখায় না,আনিস অবশ্য কখনোই চাকরী করা নিয়ে কোন কথা বলেনা।
অনেক চেষ্টার পর মিন্টুর মার ছেলে মিন্টু একটা মেয়ে যোগার করে নিয়ে এসেছে লামিয়ার জন্য,যদিও অনেকটা উঠতি বয়সের মেয়ে তবুও এখন ঠেকার কাজ চালানোর জন্য রাখতে রাজী হল লামিয়া।শ্বাশুড়ীও বাধ্য হয়েই সায় দিল তবে মিন্টুকে বলে দিল যত তাড়াতাড়ী পারে অন্য বুয়া যোগার করে আনতে অল্প বয়সী কাজের লোকের ভরসা নাই।
প্রায় একমাস হতে চলল রানু মেয়েটা লামিয়ার বাসায় এসেছে এবং এই এক মাসেই বলা যায় বেশ চালু হয়ে ঊঠেছে মেয়েটা। লামিয়া কাজের ফাঁকে খুব ভালো ভাবেই খেয়াল করে ব্যাপার গুলো,কয়েকবার ধমকও দিয়েছে কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হলো রানুকে আনিসের সামনে কিছু বলা যায় না তাহলে আনিস তাকে থামিয়ে দেয়,খুব অবাক হয়েই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল লামিয়া,
--কি ব্যাপার?!
আনিস হেসে বলেছিল,
--ব্যাপার কিছুই না,এমনিতেই কাজের মানুষ পাওয়া যায় না এখন যদি এটাও চলে যায় তাহলে এই সময় তোমারই তো কষ্ট হবে তাই না?আমিতো সকালে যাই রাতে আসি।
এরপরে শ্বাশুড়ীও লামিয়াকে কয়েকবার রানুর ব্যাপারে সতর্ক হতে বলেন,লামিয়া ভাবে শ্বাশুড়ীতো এমনিতেই একটু খুঁতখুতে মানুষ হয়তো এজন্যই বলছেন।
আজ শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে লামিয়ার,যাব যাব করেও ব্যাস্ততার কারনে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছেনা,কনসিভ করেছে প্রায় চারমাস হতে চলল,এখনো সেভাবে রেষ্ট নিতে পারছেনা ভাবছে অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিবে।এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে,ওকে দুপুর বেলাঅফিস থেকে ফিরতে দেখে মিন্টুর মার নাতি মিরাজ খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!সেদিকে একবার তাকিয়ে নিজের ঘরে যায় লামিয়া,ঘরে ঢুকে এবার নিজেই অবাক হয়ে যায়,আনিস এই সময় বাসায়?!! বিছানায় আনিসের মোবাইল,মানিব্যাগ কিন্তু আনিসকে কোথাও দেখতে পেলনা।রুম থেকে বেরিয়ে আনিসকে খুজতে লাগল কিন্তু আনিস,রানু কাউকেই দেখতে পেল না।ড্রয়িং রুমে এসে মিরাজকে প্রশ্ন করল,'কিরে?তোর মামা কই?আর রানুকে দেখছিস?'
মিরাজ ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলে,
--মামা আর রানু খালা উপরে চাইর তলায় আর নানী দিব্য ভাইয়ারে লইয়া হের ঘরে,কিন্তু মামী আফনে উপরে যাইয়েন না উপরে যাওন মানা...
লামিয়ার মনে হয় সারা দুনিয়া ঘুরছে,দাড়ানোর শক্তি নেই আর কিন্তু তারপরেও কি এক অদ্ভুত ধাক্কায় ও উপরের সিড়ি ভাঙ্গতে থাকে দ্রুত পায়ে,পেছন থেকে শুনতে পায় শ্বাশুড়ী ডাকছে,
''বউমা উপরে যেওনা আমার কথা শুন...''
মাগরীবের আযান দিবে দিবে মনে হচ্ছে,চারপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে আসছে কিন্তু লামিয়ার সেদিকে কোন খেয়াল নেই সেই তখন থেকে একভাবে সোফার উপর বসে আছে।মাঝে শ্বাশুড়ী একবার এসে কিছুক্ষন ওর পাশে বসে ছিলেন কিন্তু কিছু বলেননি।রাত হয়ে যায় কিন্তু লামিয়া সেই একভাবেই বসে আছে।মিন্টুর মা একটা চাদর এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে যায়।চোখের পানিও মনে হয় শেষ হয়ে গেছে ওর,কোন ভাবেই ভুলতে পারছেনা দুপুরে দেখা দৃশ্য গুলো...কেন?কিসের অভাবে আনিস এমন করতে পারল?...একটা বারের জন্যেও কি ভাবল না ওর কথা?দিব্যের কথা?...এই পরিবারের কথা...কতো বিশ্বাসইনা ছিল ওর উপর লামিয়ার,এতদিনের ভালোবাসা,আন্তরিকতা সব এভাবে শেষ করে দিতে পারল?...একবার মনে হল দিব্য কে নিয়ে চলে এ সংসার ছেড়ে যেখানে ওর এতটুকূ মুল্য নেই সেখানে থাকবেনা কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল কোথায় যাবে?বাবা-মা তো ও সুখে আছে ভেবেই নিশ্চিন্তে বসে আছে এখন তাদের সামনে কিভাবে বলবে এসব?...আর দিব্যকে কি বলবে?কি বলবে তাকে যার আগমনী বার্তা সে শুনতে পাচ্ছে?...কিন্তু কিভাবে মনকে বুঝাবে লামিয়া?এ কষ্ট সে কিভাবে ভুলবে?না পারবে কাউকে বলতে আর না পারবে সহ্য করতে...যে মানুষটার হাত ধরে দু'চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এ সংসারে এসেছিল আজ সেই এতো বড় ধোঁকা দিল!!কি করবে তাহলে...
শ্বাশুড়ী ঘরে ঢুকলেন পেছনে আনিস,ওর হাত দুটো ধরে আনিস মাথা নিচু করে বলতে লাগল,''প্লিজ ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও,আর কখনো এমন হবেনা প্লিজ মাফ করে দাও''।আনিসের স্পর্শে লামিয়ার মনে হল সে জ্বলন্ত আগুনে পড়ে গেছে প্রচন্ড রাগে কাঁপতে লাগল সে,অনেক কষ্টে বলল,'প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও,আমি এসব নিয়ে এখন কথা বলতে চাচ্ছিনা প্লিজ'' আনিস হতাশ হয়ে চলে গেল,এবার শ্বাশুরী বললেন,
--যা হওয়ার হয়েছে এখন যাও হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও তোমাকে তো আমি আগেই সাবধান হতে বলেছিলাম কিন্তু শুননি,এ জন্যই মেয়েদের চাকরী করা ঠিক না।
--হ্যা,ঠিকই বলেছেন আমারও উচিত ছিল আপনার কথামতো চাকরী ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে আপনার ছেলেকে পাহারা দেয়া তাই না?''কান্নায় কন্ঠ বুজে আসে লামিয়ার
--শোন বউমা,স্বামী হল সিঁদুরের মতো একবার মাটিতে পড়ে গেলে আর উঠানো যায় না,কিন্তু তুমিতো শিক্ষিত মেয়ে হয়েও সে কথা বুঝলেনা।
আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনা লামিয়ার,এখন সব দোষ তার। আজকে যদি সে শ্বাশুড়ীর মেয়ে হতো তাহলে কি তিনি এভাবে বলতে পারতেন?ছয়টা বছর দিন-রাত যে মানুষটার সাথে পাড় করেছে সে কিভাবে পারল সব ভুলে যেতে?স্ত্রী হিসেবে কি তার কোন দাবী কোন বিশ্বাস থাকবেনা আনিসের কাছে?কি দরকার ছিল তাহলে বিয়ে করার?যদি বিশ্বাসের এই মূল্যই সে দিবে...
আর ভাবতে পারেনা লামিয়া।নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়...
--তারপর কেটে গেছে পনেরটা বছর,কিন্তু যে বিশ্বাসকে আনিস খুন করেছিল তার আর পূনর্জন্ম সে দিতে পারেনি,দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি কেঁদেছি,ভুলতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি, যাকে ভালোবেসেছিলাম তার কাছ থেকে পাওয়া এত বড় বেঈমানী আমি আজও মেনে নিতে পারিনি,যত বার ওকে সামনে দেখি ততোবার চোখের সামনে সেই দৃশ্য গুলো ভেসে উঠে,অনেক কষ্ট সহ্য করা,সবাই বুঝবেনা...
--আর আপনার সেই দ্বিতীয় সন্তানটার কি হয়েছিল?
--প্রচন্ড মানুসিক চাপের কারনে মিসক্যারেজ হয়ে যায়,বাচ্চাটা আর পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি।জানো?আমার স্বামী আর শ্বাশুড়ী আমার ছেলে দিব্যকে আমার কাছ থেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখে তাদের ভয় আমি যদি দিব্যকে সব বলে দেই,দিব্য তো তাহলে তাদের থেকে দূরে সরে যাবে,সারাক্ষন দিব্যের কাছে আমার দুর্নাম করে,আর তাই দিব্যও আমার প্রতি খুব বিরক্ত,আমার থেকে অনেক দূরে থাকে সে,অনেক অভিযোগ ওর আমার প্রতি।
--আপনি দিব্যকে আপনার ভালোবাসা দিয়ে কাছে রাখুন
--সে চেষ্টা কি আমি করিনি বল?কিন্তু বলা অনেক সোজা বাস্তবতা অনেক কঠিন।ওরা হয়তো ভাবছে সত্য চেপে রাখবে কিন্তু একদিন না একদিন দিব্য সবই জানবে হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে,তবে আমি বিশ্বাস করি স্ত্রী হিসেবে আমি ব্যার্থ হতে পারি কিন্তু আমার মাতৃ্ত্ব ব্যার্থ হবেনা।একটা কথা কি জানো?একটা মেয়ের কাছে তার স্বামী অনেক কিছু,অনেক মূল্যবান তার কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট কতখানি সহ্য না করার মতো তা শুধু সেই ই বুঝে...
আমি আর কিছু না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম মিসেস লামিয়া রহমানের দিকে,আস্তে আস্তে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিল,লামিয়া ম্যামকে দেখে সবাই বলে,অনেক স্বার্থপর, ক্যারিয়ারিষ্ট মহিলা যার কাছে সংসার,সন্তানের কোন মূল্য নেই সব ফেলে দিয়ে নিজেকে চাকরীর জগতে ডুবিয়ে রেখেছেন।কিন্তু কেন জানি আমার মন কোনভাবেই তা মানতে পারতোনা...শুধু মনে হতো,আমরা মেয়েরা আর যাই হই সংসার বিমুখ হতেই পারিনা হাজার চাইলেও না,নিশ্চয়ই কোন কারন আছে...আজ জানলাম,কম কষ্টে এমন জীবন বেছে নেননি তিনি,এই মানুষটাও আর দশটা মেয়ের মতো সংসারী মেয়েই ছিল,অনেক সুখের সংসার ও ছিল তার কিন্তু আজ সে সবই শুধু স্মৃতি...এমন কেন হয়?...কেন?...
বিষয়: সাহিত্য
১৩৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন