যেটুকু দিয়েছি,উজার করেই দিয়েছি...

লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ০৯ মার্চ, ২০১৩, ১২:৫২:৫০ দুপুর



''হৃদি...দেখে যা কি দারুন বৃষ্টি হচ্ছে!জলদি আয়...'' বিশাল বড় ছাদ,অনেক গুলো পেয়ারা গাছে সাজানো, ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে কলেজ শেষে বান্ধবীরা মিলে ভেজা...চোখ বন্ধ করলেই যেনো সেই অনুভূতি গুলো প্রবলভাবে দুলে উঠে বুকের ভেতর।

''উমমম...ইসরে,হৃদি,আচারটা যা মজা হয়েছে না!কি বলবো,কাল আরো বেশী করে নিয়ে আসবি কিন্তু,না হলে তোর চুল ছিড়বো!'' বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাস ফাঁকির মূহুর্ত গুলো বাসা থেকে বানিয়ে আনা নাশতা-আচার খাওয়া নিয়ে সে কি কাড়াকাড়ি!মনে হলে এখনো মনটা হুহু করে উঠে!... আযানের শব্দ শুনে চমকে উঠে হৃদিতা!সকাল হয়েগেছে!!

সকালটা কোন ভাবে যে শুরু হয় তা আজকাল টেরই পায় না হৃদিতা। আসলে ও তো সকালের চিন্তায় রাতে ঠিক মতো ঘুমায় ও না! তারপর কোন ফাঁকে দিন পাড় হয়ে যায় তাও বলতে পারে না! সকাল মানেই,ঘড়ির কাঁটা ৮টা বাজার আগেই টেবিলে সবার জন্য নাশতা রেডি থাকতে হবে,একই রকম নাশতা না,কয়েক রকমের!কারো পরোটা তো কারো স্যান্ডউইচ,কারো ডিমের অমলেট তো কারো ডিম সেদ্ধ!এই অল্প সময়ের মধ্যে বাচ্চাদের ইউনিফরম পড়িয়ে ,টিফিন বক্স,স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে রাখতে হবে,সেই সাথে মিনহাজের লাঞ্চ বক্স। খানিকবাদেই শ্বশুড় বাজারে যাবেন,তাকে কি কি আনতে হবে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে হবে,এরপর বুয়া আসার আগেই কিচেন সহ সম্পূর্ন বাসা পরিস্কার করে রাখতে হবে,না হলে বাসা যেমন আছে সে সেভাবেই কোনরকম কাজ করে চলে যাবে! বুয়ার কাজের ফাঁকে ফাঁকেই নাশতা শেষ করে দ্রুত করে আনা বাজার গুলো গুছিয়ে বের হতে হবে,১২.৩০টায় ছোট ছেলের স্কুল ছুটি,স্কুলটা বাসা থেকে দূরে হওয়ায় আগেই বের হতে হয়,রাস্তার যা অবস্থা,টাইম মতো পৌছাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বাসায় এসেই চূলোয় দুপুরের রান্না বসিয়ে,দ্রুত নামায পড়ে ছেলে-শ্বশুড়কে দুপুরের খাবার দিয়ে,বের হতে হয় বড় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে,বাসায় এসে মা-মেয়ে একসাথে খেতে বসে,খাওয়া শেষে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে মেয়েকে কোচিং এ দিয়ে আসে,ওদিকে শ্বশুড় ও ছেলেকে নিয়ে কোচিং এ চলে গেছেন। সন্ধ্যা শেষে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যখন শ্বশুড়-বউ বাড়ি ফিরেন,তখন মিনহাজ সাহেব ও সারা দিনের অফিস শেষে বাসায় ফিরেছেন!

হৃদিতার এই একটা জায়গায় এসে ভালোই লাগে,মিনহাজের সাথে এই জায়গাটায় আর বেশ মিল!দিন শেষে সেও বাড়ি ফেরে,হৃদিতাও বাড়ি ফেরে।মিনহাজ নাশতা শেষে এশার নামায পড়ে হয় টিভি দেখে,না হলে বাবার সাথে গল্প করে,না হলে বই পড়ে,মাঝে মাঝে মেজাজ ভালো থাকলে ছেলেকে হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করে। আর হৃদিতা... ব্যাস্ত,রাতের খাবার তৈরীতে,মেয়েকে কফি বানিয়ে দিতে,ছেলের হরলিক্স,শ্বশুড়ের জন্য রুটি...। সবার অবসরের,প্রয়োজনের খোরাক গুলো তৈরী করতে করতে নিজের অবসরকে দিয়েছে ছুটি অনেক আগেই,এখন এই সবই তার অবসরতা,ব্যাস্ততা,ক্লান্তি,আনন্দ...

হৃদিতা এখন আর খুব একটা কাজ করতে পারে না,বয়সের সাথে সাথে রোগও বাসা বেঁধেছে! ডায়াবেটিকস,কিডনীর সমস্যা আর গ্যাস্ট্রিক তো সাথে আছেই। মিনহাজের ও একই অবস্থা! হৃদিতা তাও যথেষ্ট চেষ্টা করে নিজেকে সূস্থ রাখার,আর কিছুর জন্য না হলেও সংসারের জন্য,ছেলে-মেয়েদের জন্য,মিনহাজের জন্য। ও ঠিক না থাকলে এই মানুষ গুলো একেবারেই অসহায় হয়ে পড়বে,তিলতিল করে গড়ে তোলা এই সংসারটা ভেঙ্গে যাবে...

একদিন এই সংসারের জন্য,এই মানুষ গুলোর জন্যই হৃদিতা নিজের জীবনের সমস্ত অর্জন,আকাংখা গুলোকে বাস্তবতার বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছিলো...আর কখনো পেছন ফিরে তাকায়নি,চাঁপা দীর্ঘশ্বাস গুলোকে কখনো বের হতে দেয়নি। এই সংসারের সাথেই নিজেকে বেঁধে ফেলেছিলো আষ্টে-পৃষ্টে...

''কিরে বাবা?নাশতা করবি না?''

''সময় নেই,আম্মু,আমি কাল রাতেই তোমাকে বলে রেখেছিলাম,যে আমার সকালে ক্লাস আছে,আর তুমি নাশতা দিচ্ছো এখন?!হুহ''

''সরিরে,রাতে প্রেশারের হাইপাওয়ারের ঔষধ খেয়েছিলাম,তাই সকালে নামায পড়ে আর না ঘুমিয়ে পাড়লাম না!এখন বানিয়েছি যখন,নাশতাটা একটু খেয়ে যা...''

''আম্মু,একদমই সময় নেই,আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো!আসি...''

নাশতার প্লেটটা হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো ছেলের চলে যাওয়া দেখে হৃদিতা!বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও বের হতে দিলেন না,''থাক,ছেলে মানুষ,আর এখন বড় হয়েছে,অতো ঘরে খেতে কি আর ভালো লাগে!'নিজেই নিজেই বললেন যেনো!

''হৃদি,তোমাকে না কতো দিন বলেছি,আমার কাপড় বুয়াকে দিয়ে ধোয়াবে না!একদমই পরিস্কার হয় না,এতো বছরেও তোমাকে কথাটা বোঝাতে পারলাম না!উফ''

''মিশুর আব্বু,তুমিও তো বুঝোনা!আমার সময়টা কোথায় কাপড় ধোয়ার বলো?'

''সময়টা কোথায় মানে?সারাটা দিন করোটা কি বাসায়?'

''এই ২৭বছরেও তুমি যখন জানতে পারলে না,যে আমি সারাটা দিন বাসায় কি করি,তাহলে আর বলে লাভ কি!'

''অফিসে তো আর যাও না,তাই বুঝোও না,কোথায় কোন গেটআপে যেতে হয়...যত্তোসব!''

হৃদিতা,স্বামীর শার্ট হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমে ঢুকেন,বালতিতে কাপড় গুলো ভেজানোর জন্য বসতেই আঁ করে উঠেন!! আজকাল কমড়ের ব্যাথাটা এতো বেড়েছে,নীচে বসতেই পারেন না,নামায ও পড়েন চেয়ারে বসে।

হৃদিতার আজকাল বড্ড অসহ্য লাগে!মেজাজ ও কেমন খিঁটখিটে হয়ে থাকে...তার মনে হয়,এ সংসারের দিনে দিনে তিনি সবার কাছে বিরক্তির পাত্র হয়ে উঠছেন!কেউ তার কথা শুনতে রাজি না,তার সমস্যা বুঝতে রাজি না!সবাই শুধু আছে তাদের চাওয়া নিয়ে,দাবী নিয়ে...!কোন মানে নেই এই জীবনের! ২৭টা বছর ধরে এই মানুষ গুলোর জন্য নিজের সব উজার করে দিয়েছেন,প্রতিটা মিনিট,প্রতিটা সেকেন্ড সব সময় চেষ্টা করেছেন তাদের খুশী রাখার জন্য,দোয়া করেছেন তাদের ভালোর জন্য...কিন্তু এখন মনে হয় না হৃদিতাকে আর তাদের দরকার আছে! এই অসূস্থ,দুর্বল,অক্ষম হৃদিতাকে মনে হয় না আর কেউ চায়...

জীবনের এই অসহায় মূহুর্তে এসে হৃদিতার নিজের মায়ের কথা খুব মনে পড়ে... তাদের পাঁচটা ভাই-বোনকে কতো কষ্ট করেই না মানুষ করেছিলেন মা,ভাইয়েরা স্বাবলম্বী হতে শুরু করলো আর মা ও ওপাড়ে পাড়ি জমালো,সুখের মুখ আর দেখে যেতে পারলেন না,আজ তার মেয়ের জীবনেও বোধহয় সে সময় চলে আসছে...হৃদিতা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন,ক'দিন পর ছেলেটাও পাশ করে ডাক্তার হয়ে বের হবে,বিয়ে করবে... মিনহাজ ও রিট্যায়ার্ড করবেন। হৃদিতার মনে হয়,সে এখন আর সংসার থেকে ছুটি চায় না,একেবারে জীবন থেকেই ছুটি চায়। বেঁচে থাকার অবসরতা তার জন্য যেনো দুর্বিষহ! রবী ঠাকুরের সোনারতরীর মতো করে সে চায়না,একা একা বিশাল নদীর বুকে বেঁচে থাকতে,দেবার সামর্থ্য শেষ,আর নেয়ার ইচ্ছে?সেতো কোন কালেই ছিলো না... তাই আর বেঁচে থাকার অবসরতা সে চায় না।

হৃদিতা চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষনের জন্য... মূহুর্তেই ভেসে উঠে,ছেলেবেলা,কিশোরী কালের উচ্ছ্বলতা,তরুনী বয়সের লাজুক বউয়ের মুখ,ভালোবাসা ভরা দিন গুলো,মা হবার অপার্থিব আনন্দ... মা ডাক শোনার সেরা সুখ,সন্তানের মুখের হাসিগুলো... সব কিছু যেনো ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পান তিনি। একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে মুখে... নাহ,আমি ব্যার্থ নই,আমি চেষ্টায়-কর্মে কোন ত্রুটি করিনি...যখন যা করেছি,আন্তরিকতা দিয়েই করেছি,যা দিয়েছি হৃদয় উজার করে দিয়েছি...বিনিময় এখানে চাইনি,ওপাড়ের জন্য চেয়েছি...যেনো এই দুনিয়ার মতো করে সবাইকে নিয়ে ঐ দুনিয়াতেও থাকতে পারি...

[উৎসর্গ করছি,আমার আম্মুকে। সেই সাথে সকল নারীদেরকে,তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম,ত্যাগ,আর দোয়ার ফলেই আজ আমরা কিছু অর্জন করতে পারছি,নিজেদের পরিচয় তৈরী করতে পারছি। ভালো-খারাপ নিয়েই তো মানুষ!তবুও,চেষ্টা করুন নারীদেরকে সম্মান দিতে,মায়েদেরকে সম্মান দিতে,কারন মায়ের পায়ের নীচেই সন্তানের বেহেশত।]

বিষয়: বিবিধ

১৫০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File