লোভ...

লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ২১ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:২৪:৪৫ সকাল



মোরগটা সেই কখন থেকে অকারণেই ডাকছে,বেলা তো শুরু হয়েছে সেই কখন,তো এখনো এতো ডাকার কি আছে?

একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ দুটো মেললেন নাসিমা,শোয়া অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিকে তাকালেন। ছেলে-মেয়েদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছেন না,ঘরের ভেতর বলতে গেলে তিনিই আছেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন,প্রায় দশটা বাজতে চলছে!উঠে বসার চেষ্টা করলেন নাসিমা,কিন্তু পারলেন না,খুব কষ্ট করে বালিশে হেলান দিয়ে দুর্বল কন্ঠে ডকলেন,

-আরিফ... ও আরিফ,কইরে বাজান,একটু এদিকে আয়

আরিফের কোন সাড়া শব্দ পেলেন না,কিছুক্ষন পর মেঝ ছেলে মুনির কি কাজে যেনো ঘরে ঢুকলো,তাকে দেখে বললেন,

-কিরে বাজান?তোর বড় ভাই কই?

-ভাই তো স্কুলে গেছে,সামনে তার পরীক্ষা।

-তুই যাস নাই স্কুলে?

-নাহ,আইজ আর যামু না,কাইল যামু।

নাসিমার খুব মাথা ঘুরছে,আর নিঃশ্বাস মনে হয় বারবার ভারী হয়ে আসছে!

-তোর মামা ফোন দিছিলোরে আর?

-নাহ,দেই নাই।

নাসিমা আর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। মাথায় নানান দুঃশ্চিন্তা ঘুরছে,কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না!এদিকে আরিফের বাবারও কোন খবর নেই,সে পাশে থাকলেও না হয় কিছু একটা উপায় করা যেতো।

চারদিন যাবত লেবার পেইন নিয়ে ঘরে বসে আছেন নাসিমা,ডাক্তারর দেয়া ডেট পার হয়ে গেছে আরো আগেই,গ্রামের ক্লিনিকে গিয়েছিলেন,কিন্তু যেহেতু তার পেইন তেমন বেশি না,এই বাড়ছে তো কমছে অবস্থা তাই তারা বলেছে,ঠিক মতো পেইন না উঠলে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। গ্রামের সামান্য ক্লিনিক,তেমন অভিজ্ঞ কেউ নেই, কোন রকমে চলে,মাসে দু'এক বার শহর থেকে ডাক্তার আসেন,তখন লোকজন আসে ফ্রি চেকাপ করাতে। বেশি সিরিয়াস কিছু হলে,উপজেলার সরকারী হাসপাতালে যেতে হয়,যদিও সেখানে একই অবস্থা। ডাক্তার থাকে না সব সময়,নার্সরাই সব কিছু সামলায়।

নাসিমা গত তিনদিন যাবত হাঁটা-চলা করতে পারছে না,হাত-পা অবশ হয়ে আসছে মনে হয়,আর মাথা সারাক্ষন ঘুরতেই থাকে!বাচ্চা গুলো ছোট,ওদের বাবা গেছে অন্য জেলায় ধান কাটতে,কবে ফিরবে জানে না,হাতে টাকা পয়সাও নেই,এই অবস্থায় হাসপাতালে কিভাবে যাবে,কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না!

মেয়ে আইরিনকে দেখে ইশারায় ডাকদিলো,কাছে এলে মোবাইলটা দিতে বলল,হাতে নিয়ে বড় ভাবীর নাম্বারে কল দিলো,একবার-দুইবার-তিনবার...নাহ,ভাবি ফোন ধরছেই না।

নাসিমা জানে ভাবি আসলে ইচ্ছে করেই ফোন ধরছে না,সে জানে,এখন নাসিমার টাকার দরকার তাই! নাসিমারও ইচ্ছে করে না,ভাইদের কাছে হাত পাততে কিন্তু কি করবে?নিরুপায় হয়েই ভাবিকে ফোন দেয়,কখনো বা বিদেশে অবস্থান করা ভাইকে মিসকল দেয়,ভাইয়ের যদি ইচ্ছে হয় তখন কল ব্যাক করে। বাবা-মা নেই,জামাইও তেমন উপার্জনক্ষম না,এমন অবস্থায় কতো বার ই বা ভাবি চাইবে,নিজের সংসারের টাকা ননদকে দিতে! নাসিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে সে,কোনভাবে যেনো আল্লাহ একটা ব্যাবস্থা করে দেন।

-মা,আমার তো সামনে পিএসসি পরীক্ষা,স্যারেরা কইছে,২০০টাকা কইরা দিতে,নাইলে প্রবেশপত্র দিতো না।

আরিফের গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেললেন নাসিমা। কিছু না বলে চুপ করে থাকলেন,কি বলবেন?নিজের যে অবস্থা,বাঁচেন কি মরেন তাই বুঝতে পারছেন না,আর সেখানে ছেলে-মেয়েদের প্রয়োজন!কি করবেন জানেন না! ভাবতে ভাবতে হঠাত কি মনে হওয়াতে দ্রুত ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-বাজান,মোবাইল থেইকা তোর আয়শা খালার নম্বরটা বাইর কইরা দে তো,দেখি আফারে ফোন দিয়া!

আয়েশা তার বড় খালার মেয়ে,শহরে থাকেন,তাকে অনেক আদর করেন,আপাকে বলে যদি,ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ম্যানেজ করা যায়,তাহলে হয়তো হসপিটালে যেতে পারবেন। আর যদি ভাই নাও দেয়,আপা পারবেন বাকী খালা-মামাদেরকে বলে টাকা ম্যানেজ করে দিতে। আল্লাহর অশেষ রহমতে,আপা ফোন ধরলেন,সব কথা শুনে বেশ রাগ হলেন তিনি,

-এটা কোন কথা হইলো?তোর জীবন-মরণের সমস্যা আর তোর ভাই-ভাবি আছে টাকার হিসাব নিয়া!!আর তুইও... চারদিন ধরে ব্যাথা উঠে আছে,আর তুই বাসায় বসে আছিস?ছেলে-মেয়ে গুলোর জন্য কি টান আছে?

নাসিমার খুব কান্না পায় আপার কথা শুনে!

-আফা কি করমু কন?আপনেগো জামাইও বাড়িত নাই,আমার হাতে একটা টাকাও নাই!

খানিক্ষন ভেবে আপা বললেন,

-শোন,আমার কাছে এই মুহুর্তে হাজার পাঁচেক টাকা আছে,আমার বাজারের খরচ,পাঠায় দিচ্ছি,আর তোর ভাইকেও বলতেছি,ও পরে আমাকে এই টাকা দিয়ে দিবে,এখন তুই আসমাকে ফোন দিয়ে আসতে বলে, রেডি হো আর দেরি করসিন না বোন...

মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন নাসিমা। প্রতিবেশিদের সহযোগীতায় বিকেল নাগাদ নাসিমা যখন হাসপাতালে পৌছালেন,ততোক্ষনে তার ব্যাথা আরো তীব্র হয়েগেছে,এমন অবস্থায় ডাক্তার ও নেই,হরতালের কারণে,শহর থেকে ডাক্তার আসতে পারেননি! যিনি এসেছিলেন,দুপুরের পর পরই চলে গেছেন। বাধ্য হয়ে নার্সরা অপেক্ষা করতে বললেন।

আল্লাহর অশেষ রহমতে রাতের দিকে নরমাল ডেলিভারি হলো,চতুর্থবারের মতো ছেলে সন্তানের মা হলেন নাসিমা।

সকালের মধ্যে আরো দুই খালাকে ফোন দিয়ে আয়েশা আপা আরো কিছু টাকা ম্যানেজ করে পাঠিয়েছেন,ছোট বোন আসমাও এসেছে। ডাক্তার চেকাপ করে বলে গেলেন,বিকেলে নাগাদ বাড়ি চলে যেতে পারবেন নাসিমা।

দুপুরের বোনের আনা খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নাসিমা,হঠাত এক নার্স এসে বললেন,

-আফনের নাড় পরিস্কার করতে হইবো,সোজা হইয়া শুয়েন দেখি!

নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,

-আমার তো নরমালেই বাচ্চা হইলো,আর ডাক্তার আফা তো সকালে দেইখা গেলো,কই?কিছুতো কইলো না!

-সব কথা কি হেরা আফনেরে কইয়া যাইবো?তাইলে আমরা আছি কি করতে?যা কইতাছি শুনেন!

অগ্যাত বাধ্য মেয়ের মতোই নাসিমা শুয়ে পড়লেন। বুঝতে পারলেন না,এসব লোভী নার্সদের একটা কৌশল!এরা গ্রামের সহজ-সরল রোগী পেলে তাদেরকে বেশি সময় হসপিটালে রাখার জন্য এরা সিজার/নরমালে ডেলিভারি হবার পর সেলাইয়ের জায়গাতে অথবা নাজুক জায়গা গুলোতে হাত লাগিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে! অনেক সময় এদের এইসব লোভের বলি হয়ে রোগীনি মারাও যায়! কিন্তু তাতে কি?এদের দরকরা টাকা!

কিন্তু নাসিমা যখন বুঝতে পারলো,ততোক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে!! নাসিমা তাকিয়ে দেখলো,তার চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এতো রক্ত...মনে হচ্ছে কোরবানীর সময় গরু জবাই করলে যেমন রক্তে চারপাশ ভেসে যায়,ঠিক তেমন!

নাসিমা অসহায়ের মতো নার্স মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

-বইন,কি করলেন আফনে?আমারে মাইরাই ফালাইলেন?!আমার পোলাপাইন গুলার কি হইবো এখন!!

বলতে বলতে জ্ঞান হারালেন নাসিমা। চতুর নার্স এর বুঝতে সময় লাগলো না অবস্থা আসলে কি!আর কি করতে হবে তাকে!

দ্রুত নাসিমার বোনের জামাইকে ডেকে বললেন,

-ইনারে জলদি শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান!এর অবস্থা ভালো না!জলদি নিয়া যান!

কোন রকমের রক্ত বন্ধ করে নাসিমাকে নিয়ে যখন শহরের হাসপাতালে ছুটা হলো,ততোক্ষনে নাসিমার প্রাণ শক্তি অনেকটাই নির্জীব হয়ে গেছে!

অস্পষ্ট চোখে নাসিমা দেখতে পায়,তার বাড়ীটাকে,তার বাচ্চাদেরকে উঠোনে খেলতে,জাল বুনাতে ব্যস্ত তাদের বাবাকে!

বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করে নাসিমা!তার মনে হচ্ছে,অনেক দিন পর তার প্রিয় মা পাশে বসে আছেন। বলছেন,

-মা গো,কষ্ট হইতাছে অনেক?আরেকটু সবুর কর,আমি তোরে লইয়া যামু আমার লগে!

নাসিমার চোখের কোণ গুলো ভিজে উঠে বার বার! জ্ঞান হারানোর পূর্বে নাসিমা কেবল শুনতে পায়,তার বোন বলছে,

-ও আফা,এই যে আইছি আমরা হাসপাতালো!কিচ্ছু অইতো না তোমার!

এম্বুলেন্সটা তখন সত্যি সত্যি হসপিটালের গেট ধরে ভেতরে প্রবেশ করে ছিলো।

[উপরের ঘটনাটা সত্যি। আমি কোন পেশাকে বা এই পেশার সব মানুষকেই খারাপ কিংবা দোষী বলছি না,কিন্তু এটা সত্যি,যে আমাদের দেশে এভাবেই প্রতিদিন অনেক নাসিমারা প্রাণ হারাচ্ছেন,অকালে চলে যাচ্ছেন আমার শাহানা মামীর মতো অনেকেই। এইসব নামে মাত্র দালাল-নার্সদের অমানুষিক কাজ-কর্ম আর লোভের কারণেই,অনেক অবুঝ সন্তানেরা মা হারা হচ্ছে! আমাদের দেশের গ্রাম গুলোতে চিকিৎসা ব্যাবস্থা এখনো অনেক অনুন্নত!বেশিরভাগ সময়ই,হয় দেরি হয়ে যায় অনেক!না হয় রক্ত পাওয়া যায় না,না হলে চিকিৎসা পাওয়া যায় না!তার উপর এই সব সেবক-সেবিকা নামের মানুষরুপি পশুগুলো!জানিনা,আমাদের সমাজের নাসিমারা ঐ সব লোভী-সাইকো মানুষ গুলোর অত্যাচার থেকে কবে মুক্তি পাবে!শুধু নাসিমাদের মুখের দিকে তাকালে,চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না!]

বিষয়: বিবিধ

১৭০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File