মেঘ কেটে রোদ হেসেছে,অতঃপর..

লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ০৭:১৭:২৫ সন্ধ্যা



''আবেগ বস্তুটা কিছুটা লবনের মতো - বেশী থাকলে জীবন বিষের মত হয়ে যায়, আর কম থাকলে জীবন হয়ে যায় স্বাদ বিহীন ''

কথাটা যে কে বলেছিলো তা এই মুহুর্তে মাথায় আসছে না,তবে কথা গুলো এডিট করে যদি,এভাবে বলা হতো,

''মানুষ হচ্ছে লবনের মতো!! বেশি থাকলে জীবনটা হয় বিষের মতো আর কম থাকলে স্বাদহীন'' তাহলে এই স্ট্যাটাসটাতে লাইক দেয়া যেতো! ভাবতে ভাবতে নাবিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,তারপর ফেবু থেকে লগ আউট করে পিসিটা অফ করে দিলো। এই মুহুর্তে তার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে!আসলে এতোটা রিএক্ট না করলেও মনে হয় পারতো!আবার মনে হলো,নাহ খুব একটা ভুল মনে হয় করেনি সে,স্বাভাবিক রিএকশন বলা যেতে পারে! কিন্তু স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যেমনই হোক না কেন,সকালে যা ঘটেছে তার ফলাফল এখন পর্যন্ত ভালো বলা যাচ্ছে না। নাবিলার মনটা ক্রমেই খারাপ থেকে কান্নার দিকে যাচ্ছে! ইচ্ছে করছে,বাচ্চাদের মতো হেঁচকি তুলে কাঁদতে!

মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো,নাহ...কোন সাড়া-শব্দ নেই! নাবিলার মনে হলো,তার মুড আবারো মন খারাপ থেকে মেজাজ খারাপের দিকে ফিরে যাচ্ছে,যেকোন মূহুর্তে প্রচন্ড রাগ উঠবে,কিন্তু রাগটা উঠলে সেটা ঝাড়বে কার উপর?!!

কথাটা মনে হতেই আবারো হেঁচকি তুলে কান্না পেলো!

ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করতে করতে মনে পড়লো,সে দুপুরে কিছু খায়ওনি এবং রান্নাও করেনি! রাতে কি কিছু রান্না করবে?যদি পরিবেশ ঠিক না হয়,তাহলে তো রান্না করে লাভ নেই,কেউ খাবে না,শুধু শুধু খাবার নষ্ট হবে!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে নিলো,নিপা ভাবির নাম্বারে কল দিবে না দিবে না করেও কল দিয়েই ফেলল!

সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর ভাবিই বলল,

-তো কি করছো তুমি?পড়াশুনা?

নাবিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-নাহ,বসবো পড়তে,আপনি কি করছেন ভাবি?অনেক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি!

-হুম,বাচ্চারা খেলছে দাদা-দাদীর সাথে!তাই শব্দ আসছে। জানো,আজকে আমি আর আম্মা মিলে অনেক রকমের খাবার বানিয়েছি,মুড়ির মোয়া,লাড্ডু,সেমাই পিঠে তারপর ঝাল হিসেবে চাপটি পিঠা আর শুঁটকি ভর্তা,তপুকে ফোন করেছিলাম,বলেছি অফিস শেষে যেনো আমাদের বাসা হয়ে যায়,তোমার জন্য খাবার দিয়ে দিবো,কিন্তু ও বলল,আজ পারবে না,কি নাকি কাজ আছে। তো এক কাজ করো,কাল পরীক্ষা দিয়ে তুমিই চলে এসো,দুপুরে এক সাথে খাবো আমরা,কেমন?

নাবিলা সাথে সাথে কিছু বললো না। নিপার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকলো!নাবিলা কেমন চুপ হয়ে আছে,দুপুরে তপুও কেমন যেনো দায়সারা ভাবে কথা বললো!ঘটনা কি?

-হ্যালো নাবিলা,কি ব্যাপার?সব কিছু ঠিক আছে তো?

নাবিলা নিষ্প্রাণ ভাবেই বললো,

-হুম ভাবি,ঠিক আছে সব,আচ্ছা,আমি এখন রাখি ভাবি,কাল আসবো। ওকে,আল্লাহ হাফেজ।

ও পাশ থেকে কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিলো নাবিলা,নিপা খুবই অবাক হলো!সেই সাথে নিশ্চিত হলো,কিছু একটা হয়েছে দেবর আর তার বউ এর মধ্যে!

@

রাতের জন্য অল্প পরিমানে ভাত রান্না করে নাবিলা পড়তে বসলো,কাল পরীক্ষা আছে,কিছুই রিভিশন দেয়া হয়নি এখনো তার,সব ভুলে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো। পড়তে পড়তে কখন যে ১১টা বেজে গেছে টেরই পেলো না! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে যতোটা না অবাক হলো,তার থেকে বেশি অবাক হলো,এখন পর্যন্ত কলিংবেল বাজে নাই কেন এটা ভেবে!

তপু তো কখনো এতোটা রাত করে না বাড়ি ফিরতে,আর ২/১বার হলেও ওকে তা ফোন করে জানায়। কিন্তু আজ কোন সাড়া শব্দই নেই!আশ্চর্য মানুষ তো! রাগ-ঝগড়া যাই হোক,একটা এসএমএস তো করে জানাবে? নাবিলা দ্বিধা ঝেড়ে তপুকে ফোন করলো,দু'বার রিং বাজলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না,নাবিলার টেনশন লাগতে শুরু করলো! তিন বারের বেলায় তপুর আওয়াজ শুনতে পেলো,

-কি ব্যাপার?কোথায় তুমি?কয়টা বাজে?

-আমি আছি নাদিমদের মেসে,আজকে আসবো না,তুমি রাত না জেগে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়।

নাবিলা পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলো!!

-তুমি আজকে বাসায় আসবে না?কেন?

-আমার ইচ্ছে!আর তোমার সমস্যা কি?তুমি তো একা থাকতেই পছন্দ করো তাই না?

-আমি একা থাকতে পছন্দ করি?তপু,তোমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে,সো বাসায় এসে করো।

-আমার কোন কিছুরই ইচ্ছে নাই আর!তোমার যখন আমার আব্বা-আম্মার বাসায় থাকা নিয়ে অনেক আপত্তি,তোমার বাসায় বাড়তি মানুষ থাকা পছন্দ না,তো থাকো তুমি তোমার বাসায় একলা!আমি থাকি না থাকি তাতে তোমার কি?

নাবিলার মনে হলো কেউ ওর গলা চেপে ধরেছে!কোন শব্দ করতে পারছে না সে!এভাবে বলতে পারলো তপু?!! নাবিলা আর কোন কথা না বলে নিঃশব্দে লাইনটা কেটে দিলো। ধীরে ধীরে বিছানায় লুটিয়ে পরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল!

নাবিলার এভাবে কিছু না লাইন কেটে দেয়ায় কিছুটা অবাক হলো তপু!মোবাইলটা রেখে হাতে বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো কিছুক্ষন,কিন্তু পারলো না। ঘুরে ফিরে সকালের দৃশ্যগুলো আর নাবিলার ফোন রেখে দেয়া মাথায় ঘুরতে লাগল!

ঝগড়ার শুরুটা নাবিলাই করেছিলো,একটা পর্যায়ে তপুও ক্ষেপে যায় খুব। গ্রাম থেকে বাবা-মা এসেছেন চেকাপ করাতে,উঠেছেন বরাবরের মতো বড় ভাইয়ের বাসায়,তপু চাচ্ছিলো বাবা-মা তার বাসাতে থেকেই চেকাপ করুক,কিন্তু বাধ সাধে নাবিলা!তার কথা,এখন তার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে,তাই সে চায়,পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাসায় কোন গেস্ট না আসুক। কিন্তু তপু কোন ভাবেই মানছিলো না,তার কথা এতোদিন ব্যাচেলর ছিলাম ভিন্ন কথা,এখন বিয়ে করেছি বাসা নিয়েছি,সুতরাং বাবা-মা এসে তার বাসায় উঠবে,সব সময়তো ভাইয়ের বাসায়ই উঠেছে,আর কতো?যদিও বাবা-মা কিংবা ভাই-ভাবি কেউই তেমন কিছু বলেনি,কিন্তু মনে মনে ঠিকই অপেক্ষায় আছেন,যে কবে তপু বলবে!

এক কথা-দু'কথায় কথা বাড়তে লাগল,বাড়তে বাড়তে তা চূড়ান্ত ঝগড়ায় পরিণত হলো!রাগের মাথায় তপু বলেই বসলো,

-তোমার মন যে এতো ছোট তা আগে বুঝিনি!শহরে একলা থাকতে থাকতে মনটা একদমই ন্যারো হয়ে গেছে তোমার!আসলে ভুল আমারই হয়েছে,তোমাকে বিয়ে না করে গ্রামের অল্প শিক্ষিত জয়েন্ট ফ্যামিলির একটা মেয়ে বিয়ে করাও অনেক ভালো ছিলো!!

কথা গুলো নাবিলার কাছে প্রচন্ড অপমান জনক মনে হলো!

-তাই না?ভুল করেছো তুমি আমাকে বিয়ে করে?বাহ!বছর ঘুরলো না আর তোমার কাছে এখন ভুল মনে হচ্ছে?!!ছিঃ, কি খারাপ বলেছি আমি?আমি জাস্ট বলেছি,আব্বা-মা ক'টা দিন পরে আসুক আমার বাসায়,তুমি তাদেরকে বলো,যে আমার পরীক্ষা চলছে এখন,শেষ হলেই আমি-তুমি নিজে যেয়ে নিয়ে আসবো উনাদেরকে! আর এজন্য তুমি বলছো,আমার মন ছোট?আমি ন্যারো মানষিকতার?!!

-তুমি শুধু ছোট মনেরই না,তুমি ডমিনেটেড মানুষিকতারও!সব সময় সব কিছু তোমার ইচ্ছে মতো চালাতে চাও!অন্য কারো ইচ্ছে-অনিচ্ছার মূল্যই নেই তোমার কাছে!এই সংসার কি শুধু তোমার একার? আজ যদি তোমার বাবা-মা হতেন তাহলে কি করতে এমন?বিয়ের পর অবস্থার সাথে নিজেকে এডজাস্ট করে নিতে হয়,শিখো নাই এটুকু?

নাবিলার মনে হলো রাগে সারা দুনিয়াটা ওলোট-পালট হয়ে যাচ্ছে!এসব কি বলছে তপু?

-আমি কি শিখেছি সেটা না দেখে নিজের দিকে তাকাও!স্বার্থপরের মতো আমার দোষটাই দেখে যেও না!সামান্য একটা বিষয়কে নিয়ে তুমি কি রকম বাড়াবড়ি করছো দেখো!কোথায় এটার সমাধান বের করবে তা না!আশ্চর্য!!শোন, এই রকম মানুষিকতা নিয়েই যদি থাকো,তাহলে তোমার সাথে সংসার করা ইম্পসিবল!আমার পক্ষে,এইসব বাজে কথা শোনা সম্ভব না!

এ কথা শুনে তপু সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো,রাগে চেহারা লাল হয়ে গেছে তার,কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাত পানির গ্লাসটা 'ধাম' করে মেঝেতে ফেলে দিলো তপু!!নাবিলা ভয়ার্ত চোখে হতভম্ব হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল!

কিছুক্ষন পর দেখলো তপু রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো,নাবিলা যেভাবে ছিলো সেভাবেই বসে রইলো,ডায়নিং টেবিলে পড়ে রইলো তপুর জন্য রেডি করে রাখা লাঞ্চ বক্সটা।

@

কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলল নাবিলা,দ্রুত উঠে বসল। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায়নি সে!

ঘড়ি দেখল,রাত ১টা। এতো রাতে কে কলিংবেল দিচ্ছে,মোবাইলটা হাতে নিলো,নাহ কোন মিসডকল/এসএমএস নেই!তাহলে দরজায় কে?!

লাইট অন করে নাবিলা,জিজ্ঞেস করলো,

-কে?

কোন জবাব নেই!কি-হোলে তাকালো,কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কিছুই দেখতে পারছে না!আবারো জিজ্ঞেস করলো,

-কে বাইরে?তপু?

কোন জবাব নেই,কলিংবেল আর বাজারো শব্দ নেই। মনে হচ্ছে মনের ভুল!কিন্তু ঘুম তো ভেঙ্গেছে এই আওয়াজেই,তাহলে কি তপুই এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে?! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো নাবিলা!কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না,তারমানে কেউই না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো!কি ভেবে আবার যেনো দরজাটা খুলে বের হলো,সিড়ির সামনে যেয়ে নীচে উঁকি দিলো,কিন্তু কোথাও কাউকে দেখলো না!দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে পেছন ফিরে আসার পথেই ঘটলো বিপত্তিটা!

অন্ধকারে কারো ফেলে যাওয়া কলার খোসায় পা দিয়ে ফেলে,আর সাথে সাথেই কিছু বুঝে উঠার আগেই যা ঘটার ঘটে যায়!

@

নাবিলা যখন চোখ মেলল,তখন দেখলো সে একটা অপরিচিত বাসায়। চারপাশে তাকালো,সব পরিচিত মুখ,আশে-পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন। ওকে তাকাতে দেখেই বাড়িওয়ালী খালাম্মা বললেন,

-এইতো চোখে মেলেছে,এই কেউ যাও তো,ওর জামাইকে পাশের রুম থেকে আসতে বলো। কি মেয়ে?কেমন লাগছে এখন?

নাবিলা মনে করার চেষ্টা করলো কি ঘটেছিলো!আস্তে আস্তে মনে হলো,ওর সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা,আর মাথা এবং ডান পা টা মনে হচ্ছে অনেক ভারী হয়ে আছে!

কিছু বলতে যাচ্ছিলো,এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে তপু ঘরে ঢুকলো। দ্রুত ওর পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বললো,

-এখন কেমন লাগছে?হসপিটালে যেতে হবে মনে হচ্ছে?

নাবিলা আস্তে করে বলল,

-প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে বিশেষ করে মাথায়,এবং পায়ে!আচ্ছা,কি হয়েছিলো?

-রাত দেড়টার দিকে বাড়িওয়ালা চাচা ফোন দিয়ে বললেন,তুমি নাকি সিঁড়ি গড়িয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছো!এতো রাতে কোন ডাক্তার খুঁজে পেলাম না,তাই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করছি,চল এখন,হসপিটালেই চলো।

নাবিলার সব মনে পড়লো। তারমানে তখন তপু কলিংবেল দেয়নি!ওটা তার মনের ভুল ছিলো! নাবিলা কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। তপু বের হয়ে গেলো ক্যাব ভাড়া করতে,ফিরে এসে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে নাবিলা কে নিয়ে বের হলো।

তপু খেয়াল করলো,নাবিলা কোন কথা বলছে না,কিন্তু নিঃশব্দে কাঁদছে!চেহারাটা কেমন ফুলে গেছে ব্যাথায় নাকি কান্নার কারণে বুঝতে পারলো না। তপু ধীরে ধীরে নাবিলার হাতটা চেপে ধরলো,কিন্তু নাবিলা হাত ছাড়িয়ে নিলো,কান্না চাপতে সে অন্যদিকে মুখ ফেরালো।

তপুর নিজেকে অপরাধী মনে হলো,আসলে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে! ঝগড়া-ঝাটি একটু আধটু হতেই পারে,তাই বলে এতোটা রাগ না দেখালেও পারতো,কিন্তু মেজাজটা এতোই খারাপ হয়েছিলো যে,কোন সমাধানের চিন্তা মাথায় আসেনি! যদিও এখন মনে হচ্ছে,এতোটা অবুঝের মতো আচরন করাটা তার ঠিক হয়নি।

বেলা দশটার দিকে মাথা-পা ব্যান্ডেজ করে,প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাসায় ফিরলো দু'জন। কথা তখনো বন্ধ,শুধু হু/হ্যাঁ চলছে!

১২টার দিকে নিপা ভাবি আসলেন,সাথে তপুর মা,তার একটু পরেই নাবিলার আম্মু-বোন আসলেন। সবাই বার বার জিজ্ঞেস করছে,কি হয়েছিলো,কিভাবে ঘটলো,এতো রাতে নাবিলা সিঁড়ির সামনে কি করছিলো ইত্যাদি। নাবিলা ক্লান্তি আর ঘুমের অযুহাতে এড়িয়ে গেলো,আর তপুও নানাভাবে এড়িয়ে গেলো। নিপা সারাটা সময় ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু'জনকে দেখলেন। কিছুটা রাগও লাগল তার,কি এমন বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে যে,কারো সাথে শেয়ারও করছে না,আবার দু'জন স্বাভাবিক ব্যাবহারও করছে না!

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে নাবিলার আম্মুরা চলে গেলেন,নিপা শ্বাশুড়িকে পাশের রুমে বিশ্রামে রেখে নাবিলার রুমে এসে দেখলেন,তার দেবর বারান্দায় বসে আছে,আর নাবিলা চোখে পানি নিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে! নিপা স্বাভাবিক কন্ঠে নাবিলাকে বলল,

-নাবিলা,কি সমস্যা হয়েছে?আমাকে বল। আমি তোমাদের বড় বোনের মতো,দ্বিধা ফেলে বলতো,কি হয়েছে?

নাবিলা এবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-ভাবি আসলে দোষ আমারই!আমিই সেলফিস এর মতো ভেবে ওর সাথে খুব বাজে বিহেভ করেছি,আমার এতোটা একপেশে ভাবা উচিত হয়নি,কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি কাল সারাটা দিন-রাত খুব অপরাধী ফিল করেছি,আমি আসলে বুঝতে পারিনি! আমি...

কান্নার দমকে আর কথা বলতে পারছে না নাবিলা,নিপা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-ভুল তো মানুষেরই হয়,ভুল হবে সেটা বুঝতে পারলে সংশোধন করে নিবে এটাই তো নিয়ম। কিন্তু হয়েছেটা কি সেটা আগে বলো?

নাবিলা সব খুলে বললো। সব শুনে নিপা মুচকী হাসল!হাসিতে কিছুটা লজ্জাও ছিলো...অনেক দিন আগে নিজের এই অবস্থাটার কথা মনে পড়ে গেলো!

@

তার নিজেরও বিয়ে হয়েছিলো,পড়াশুনার মাঝখানে,তখন শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি ঢাকায় আসলে তপুও মেস ছেড়ে তাদের বাসাতেই থাকতো। এসব নিয়ে তপুর ভাইয়ের সাথে মন কষা-কষি তার নিজেরও কম হয়নি!

কিন্তু এসব বিষয়ে তপুর ভাই বেশ ধৈর্য্য আর সহযোগীতার পরিচয় দিতেন,কখনো ধৈর্য্য ধরে বুঝাতেন,কখনো বা চুপ করে থাকতেন,তপুর আম্মাও এসে বউকে কোন কাজ করতে দিতে চাইতেন না,বুয়াকে নিয়ে নিজেই সব কাজ করতেন, সে সময় এই মানুষ গুলো এতো সহানুভূতিশীল আর আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন বলেই নিপা পেরেছিলো নিজের ভেতর ব্যাপারগুলোর সাথে এডজাস্ট করে নিয়ে বিরক্তির বদলে ভালোবাসা তৈরী করতে। আর তাইতো এখন নিজের পরিবারের কেউ আসবে শুনলে যতোটা না আনন্দ লাগে তার থেকে বেশি আনন্দ লাগে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি আসবেন শুনলে।

সেদিক থেকে অবশ্য নাবিলাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না,কারণ,ওর বিয়ের পর আব্বা-আম্মা যতবার এসেছেন অল্প সময়ের জন্য এসেছেন,আর বেশির ভাগ সময় নিপার বাসায়ই থেকেছেন,তাদের সাথে খুব বেশি সময় নাবিলা কাটায়নি,অবশ্য বিয়ে হয়েছে ওদের তেমন দীর্ঘ সময়ও হয়নি। নিপা বুঝতে পারছে,নাবিলার মনের অবস্থাটা,বেচারী এখনো পুরোপুরি সংসারের হাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি,আর অন্যদিকে তপুও সংসারের কোন সমস্যার কেমন সমাধান তার ধারা বুঝেনি! বাড়াবাড়িটা আসলে দু'জনেই করেছে,এর মধ্যে যদি দু'জনের একজন ব্যাপারটা ভাই/ভাবি কারো সাথে শেয়ার করতো তাহলে অন্তত এতোটা সিরিয়াস অবস্থা হতো না।

ভাবতে ভাবতে নিপা শ্বাশুড়ির রুমে গেলেন,সব কিছু খুলে বললেন তাকে। শ্বাশুড়ি আসরের নামাজ পড়ে নাবিলা-তপুকে নিয়ে একসাথে বসালেন,

-বুঝলে ছোট বউ,আমার এই ছেলেটা সব সময় কাজের চেয়ে রাগ বেশি করে!এত বড় হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো কোন সমস্যায় পড়লে মেজাজ সামলাতে পারে না,তাই না বাপ?

তপু কিছু না বলে মাথা নিচু করলো। তা দেখে মনোয়ারা বেগম হেসে বললেন,

-শোন বাপ,আমার এই বউ কে কিন্তু আমি চিনেছি!ও কোনদিনই আমাকে তোর বাবাকে পর মনে করে না,ও শুধু একটু বুঝতে ভুল করেছে,আর ভুল তো হবেই,একে তো নতুন সংসার তার উপর আমরা থাকি দূরে,কিভাবে বুঝবে?সময় লাগবে না একটু? কি বউ,তুমি কি আমাদেরকে পর মনে করবে কখনো?

শ্বাশুড়ির কথা শুনে নাবিলার চোখে পানি চলে আসল,

-না আম্মা,আমি কোনদিনই এমন ভাবতে পারবো না!আমি আসলে বুঝতে পারিনি,আপনি প্লিজ মনে কিছু করবেন না!আমি তো একলাই থাকি,আপনারা আসলে আমার অনেক ভালো লাগে!আমি ভেবেছিলাম,আমার তো পরীক্ষা আসলে আপনাদেরকে ঠিক মতো সময় দিতে পারবো না,তাই বলেছিলাম পরীক্ষাটা শেষ হলে আসতে,কিন্তু দেখেন আল্লাহর কি ইচ্ছা,এমন অবস্থাই হলো,যে আর পরীক্ষা দেয়াই হলো না আমার!'' বলতে বলতে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসল।

মনোয়ারা বেগম,ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে এবার ছেলের দিকে ফিরলেন,

-কি?এবার বুঝেছিস? বাবারে,সংসার করতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে,একটু বুঝে শুনে কাজ করতে হবে এমন হুটহাট ক্ষেপে যেয়ে বাড়ি ছাড়লেই সমস্যার সমাধান হবে না! হয়েছে,এবার এই রাগ-অভিমান বন্ধ কর,বউটা কি ব্যাথা পেয়েছে দেখেছিস? আল্লাহ না করুক,যদি আরো খারাপ কিছু হতো?!এমন করবি না আর,বুঝদার হও বুঝলি?

নিপা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-আর একটা কথা আমি বলি,যেকোন সমস্যা হলে চেষ্টা করবে,বড়দের সাথে একটু পরামর্শ করতে। সংসারে রাগ-অভিমান সবারই হয়,এসব ব্যাপারে কম-বেশি অভিজ্ঞতা তো তাদের আছে, তাই সংকোচ না করে শেয়ার করবে,দেখবে ইনশাআল্লাহ সমাধান পেয়ে গেছো। সমস্যা জমিয়ে না রেখে দ্রুত সমাধান করে ফেলবে,দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে,সমস্যা জমিয়ে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ না,বুঝলে? আর ভালোবাসার মাঝে এতো রাগ আসে কোথা থেকে,আর এতো সময় ধরে থাকে ই বা কিভাবে শুনি? তপু,সেদিক থেকে তোমার ভাই তো মাশাআল্লাহ,অনেক ভালো,আর যাই হোক,এক ঘন্টার উপরে আমার উপর রাগ করে কখনোই থাকেনি!

বলেই নাবিলার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন ভাবি!শ্বাশুড়িকে অন্য রুমে চলে যেতে দেখে বললেন,

-বুঝলে নাবিলা,তোমার জামাই এখনো তোমাকে অনেক ভালোবাসে না!!এজন্যই এতো রাগ দেখায়!জামাইকে শক্তভাবে ভালোবাসায় বাঁধো,বুঝলে? না হলে কিন্তু এমন হাত-পা প্রায়ই ভাংতে হবে! হাহাহা!''

ভাবির কথা শুনে দু'জনের হেসে ফেলল। আড়চোখে একজন আরেক জনের দিকে তাকালো কয়েকবার। ভাবি চলে গেলে,তপু হঠাত বলল,

-এই রুমের কেউ কি চকলেট খাবে?আমি নিচে যাচ্ছি,কেউ যদি খেতে চায় তাহলে যেনো বলে,আমি নিয়ে আসবো!

নাবিলা এবার রাগের ভান করে হাসি চাপতে চাপতে বালিশ ছুঁড়ে মারল তপুর দিকে,দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-কেউ টা কে শুনি?আমার নাম নাই?আর আনতে হবে এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে?জানো না আনতে হবে যে! ঢং না?

তপু বালিশ হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

-একটু আগে না ভাবি বললো,জামাইকে ভালোবাসতে!আর এখনই বালিশ ছুঁড়ছো না?দাড়াও ভাবিকে বলছি!

নাবিলা এবার হাসতে হাসতে বলল,

-ইইহহ,আসছে...যাও ভাগো!

তপু মোবাইলটা নিয়ে বের হতে হতে বলল,

-যাই যাই,ভালোবাসা তো আর নাই!

নাবিলা হাসতে হাসতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। আর মনে মনে বলল,

'অনেক অনেক ধন্যবাদ আল্লাহ,কঠিন একটা সমস্যার সুন্দর সমাধানের জন্য আর এমন চমৎকার কিছু মানুষদেরকে পরিবার হিসেবে দেবার জন্য।' Happy

বিষয়: বিবিধ

২৩০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File