মায়ায় জড়ানো অনুভুতিগুলো..
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ০৭ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:২৭:২৯ রাত
প্রচন্ড ক্লান্তি যেনো চোখে এসে ভর করেছেন,কোনভাবেই চোখ মেলতে পারছেন না রোকেয়া!কিন্তু তার খুব ইচ্ছে করছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় মুখ গুলোর দিকে একটা বার চোখ খুলে তাকাতে। তিনি জানেন,চোখ মেলে একটিবার তাকালেই প্রচন্ড ভাবে কাঁদতে থাকা এই মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফুঁটে উঠবে,তাদের ভীতিগ্রস্থ মনে আশার আলো জ্বলে উঠবে কিন্তু তিনি পারছেন না,চোখ মেলতে। রোকেয়ার কেন জানি মনে হচ্ছে,এখন সকাল বেলা,কেমন হিম হিম লাগছে তার কাছে,কিন্তু সকালে তো অনেক ব্যস্ত থাকেন তিনি!কতো কাজ তার সকালে,ভাবতে ভাবতে মনের চোখে ভেসে উঠলো তার প্রিয় সংসারে কাটানো রোজকার দিন গুলো...
@
সকালের এই সময়টা বড্ড বেশিই ব্যস্ত বলা চলে। চারপাশ জুড়ে যেনো শুধু ছুটাছুটি আর শোরগোল,সবাই খুব ব্যস্ত। ৪নং রোডের একদম শেষ মাথার এই বাড়িটাতেও এই সময় সবাই প্রচন্ড ব্যস্ত থাকে। সবচেয়ে বেশি ছুটোছুটিতে থাকেন রোকেয়া,যিনি এই বাড়ির গিন্নী। যতক্ষন পর্যন্ত না তিনি হাঁক-ডাক শুরু করবেন ততোক্ষন পর্যন্ত কেউই রুম থেকে বের হবে না,না ছেলে-মেয়ে না তাদের বাবা। রোকেয়ার মনে হয়,সে এই মানুষ গুলোর জন্য ঘড়ি হিসেবেও কাজ করে!
যতোক্ষন সে ডাক না দিবে,কেউ ঘুম থেকে উঠবে না,যতক্ষন তাড়া না দিবে,কেউ রেডি হয়ে খেতে আসবে না,আবার যতোক্ষন ফোন করে সময় মনে করিয়ে না দিবে কেউ সময় মতো বাসায়ও ফিরবে না!
মাঝে মাঝে অসম্ভব বিরক্ত হলেও এক ধরনের অভ্যস্থতাও কাজ করে। রোজকার মতো তাই আজো,নাশতা রেডি করে টেবিলে রাখতে রাখতে একবার করে সবার রুমের সামনে যেয়ে ডেকে আসলেন। ছেলের রুমের সামনে হয়ে আসার সময় দেখলেন,হাতে ব্রাশ নিয়ে ছেলেটা বিছানায় বসে ঘুমে ঢুলছে!ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেকোন মূহুর্তে সে বিছানায় আবার শুয়ে পড়বে! রোকেয়ার ইচ্ছে হলো,যেয়ে কানটা ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড় করাতে। কিন্তু সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া ছেলেকে কি আর কান ধরে বকা দেয়া যায়?তাই দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললেন,
-হুম,এভাবেই ঝিঁমাতে থাক ঘুমে,বেলা বাজে ৮টা ক্লাসে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়া বাদ দিয়ে সে ঘুমে ঢুলছে!এমনই কর,বুঝলি?
মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে ছেলে রাহী হাই হাই তুলতে মুখে ব্রাশ পুরলো।
-আম্মু আমি যাচ্ছি,আসসালামু আলাইকুম।
মেয়ের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত রান্না ঘর থেকে বের হলেন রোকেয়া,দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
-কিরে তুই যাচ্ছিস,পানির বোতল নিয়েছিস?
রুবা উল্টো দৌড় দিয়ে টেবিলের কাছে এসে দ্রুত ব্যাগে পানির বোতল ঢুকালো। রোজই সে এই কাজটা করে,রোকেয়া খেয়াল না করলে সে পানি না নিয়েই বের হয়ে যায়,রুবা বাইরের পানি খেতে পারে না,যেদিন বাসা থেকে পানি নিয়ে যাবে না,সেদিন দরকার হলে সারাদিন সে পানি না খেয়ে থাকবে,তবুও বাইরের পানি খাবে না।
রুবা চলে গেলে,রাহীকে আরেকবার ডাক দিয়ে রোকেয়া ইসলাম নিজের রুমে গেলেন। রহমান সাহেবের তখনো পেপার পড়া শেষ হয়নি,তিনি প্রচুর পড়ুয়া মানুষ। পেপার পড়ার বেলাতেও তার একাধিক পেপার পড়তে হয়,বাসায় একটা পরেন,অফিসে যেতে যেতে একটা পড়েন,আবার অফিসে যেয়ে একটা পড়েন। হকার সকালে পেপার দিয়ে যাবার পর সেটাকে এনে বেড রুমে রাখাটা যেমন রোকেয়ার কাজ,তেমনি সব কিছু রেডি করে এসে হাত থেকে পেপারটা নিয়ে ভাঁজ করে রাখাটাও তারই কাজ,যতক্ষন তিনি এটা না করবেন রহমান সাহেবের মনে পড়বে না,যে তাকে অফিসে যেতে হবে!
@
এমন সব বেখবর,অগোছালো আর ভুলো মনের মানুষদের মাঝে রোকেয়রা মতো একজন কর্মঠ,দায়িত্বশীলা,চতুর্দর্শী মানুষ যে বছরের পর বছর কিভাবে আছেন তা কোনভাবেই কাজের বুয়া মতির মায়ের মাথায় আসে না! বেচারী প্রায়ই একা একা বিড়বিড় করেন,
-কি সব আজব লোকজন এরা!বাপ-ছেলের একই কাপড় চাইরদিন পড়লেও হুঁশ হয় না ধুইতে দেয়ার,মাইয়া একজন এই মোটা মোটা বই হাতে নিয়া ঘুরতেছে অথচ জামা পড়ছে এক তো সালোয়ার আরেক!চুলার পাড়ে চা নিতে আইসা ওড়নায় আগুন লাইগা যায় আর সে চুপচাপ চা খাইতে খাইতে বাইর হইয়া যাইতেছে! বাপ না হয় এমন মানলাম,কিন্তু তাই বইলা,পোলা-মাইয়া গুলা একটাও মায়ের মতোন হইবো না?হইলো কিছু?! মা টা সারাদিন তাগো পিছনে দৌড়ায় দেইখা,না হইলে খবরই আছিলো!
রুবার মাঝে মাঝে বায়োক্যামস্ট্রির বই পড়তে পড়তে,কিংবা দূর থেকে তাকিয়ে অথবা বিকেল বেলা রিকশায় ফিরতে ফিরতে মাথায় খুব ঘুরে,তার মা আসলে কতোটা গুণবতী,সহনশীলা মানুষ!কতোটা ভালোবাসা থাকলে তিনি পারছেন ওদের এমন যন্ত্রণা গুলো হাসিমুখে সহ্য করে নিতে,এসবের সাথে অভ্যস্থ হয়ে দিন কাটাতে। অথচ সে তো মনে হয়,এই মা এর মেয়ে হিসেবে তার এক ভাগ গুনও পায়নি!
কিন্তু রুবা যতোটা ভাবে তার এক ভাগও রাহীর মাথায় ঢুকে না!তবে ঢুকুক না ঢুকুক,মা কে ছাড়া তার একদিনও চলবে না,দিন শেষে বাড়ি ফিরে যতক্ষন না মা ভাত মাখিয়ে এনে সামনে রাখবেন,ততক্ষন পর্যন্ত খাওয়ার কথা তার মনে হবে না! কোন কিছু করতে বা আনতে ভুলে গেলে সোজা এক বাক্যে নির্দোষী সে,'আম্মু তো আমাকে মনে করিয়ে দেয়নি!আমার কি দোষ?!'
রহমান সাহেব মাঝে মাঝে অফিসে কলিগদের সাথে গল্প করতে গেলে খেয়াল করেন,অফিসের সবাই থাকে খুব সেলডিপেন্ডেন্ট মানুষ হিসেবে ভাবে,সব কিছুতে বেশ নিয়ম মেনে চলেন,অথচ রহমান সাহেবের মনে হয়,তার এই গোছালো জীবন,যা কিছু অর্জন তার পেছনে তেইশ বছর আগেও একমাত্র তারই অবদান বেশি ছিলো,কিন্তু বিয়ের পর এই ২৩বছরের বিবাহিত জীবনে যা কিছু তিনি করেছেন তার পেছনে নিজের থেকেও বেশি অবদান রোকেয়ার। আজ তার ভালো চাকরী,যা কিছু এসেট,সততা আর নিষ্ঠার সম্মান সব কিছুর পেছনেই অর্ধেকের বেশি অবদান রেখেছেন রোকেয়া।
রহমান সাহেব চাপা স্বভাবের মানুষ,অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা তার খুবই কম,আর তাই কোনদিন মুখে তার পরিবারের কারো প্রশংসা করেন না,করতে পারেন না,কিন্তু যতোবারই জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ পেয়েছেন,মন ভরে রোকেয়ার জন্য দোয়া করেছেন। যদিও কোনদিনই তিনি বুঝাতে বা বলতে পারেননি তার জীবনে রোকেয়া আল্লাহর দেয়া কত বড় নিয়ামত।
ছেলে-মেয়ে দুটোও তার মতোই হয়েছে,সারাক্ষন মা মা করবে কিন্তু মায়ের সামনে আসলে মুখের হাসি-মায়া সব উড়ে যায়!আবার মা একটু দৃষ্টির আড়াল হলেই অস্থির হয়ে যায়! কিন্তু মায়ের সামনে কোন কথা নাই,কোন অনুভূতির প্রকাশ নেই।
@
রোকেয়ার মনে হলো তার আবারো দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো!কিন্তু চোখ খোলার খুব চেষ্টা করছেন তিনি। সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,সেই যে রান্নাঘরে হঠাত করে মাথা ঘুরে পরে গেলেন,তারপর থেকে তো আর চোখই খুলতে পারছেন না তিনি। রোকেয়া নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কখনোই উদাসীন ছিলেন না,তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরতো,
'আমি অসূস্থ হয়ে পড়লে আমার সংসারের মানুষ গুলোকে দেখবে কে?ওদের খেয়াল রাখবে কে?'
কিন্তু হঠাত করে যে কি হলো বুঝতে পারেননি!বাসায় ও সেই সময় কেউ ছিলো না। চূলোর তরকারী নাড়তে নাড়তে হঠাত করেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। প্রায় অনেক সময় পড়েছিলেন,বুয়া ছিলো ছাদে,সে এসে দেখে দ্রুত পাশের বাসার ভাবিকে ডেকে এনে সবাইকে খবর দেয়।
রোকেয়ার মনে হলো,তার মাথার কাছে তার নানী বসে আছেন,সেই অনেক বছর আগের মতো। তাকে বলছেন,
-হ্যাঁরে বুবু,এভাবে শুয়ে থাকলে হবে?মেয়ে মানুষের এতো শুয়ে থাকা চলে না,কতো কাজ করতে হয়। ঐযে দেখ,বাইরে তোর ছেলে-মেয়ে দুটো কিভাবে কাঁদছে,আর তোর জামাই টা... আহা,বেচারা তো তোর শোকে কাহিল হয়ে যাচ্ছে!
রোকেয়ার খুব ইচ্ছে করছে,সেই ছেলে বেলার মতো করে নানীর কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে!কিন্তু কেন জানি অনেক শব্দ কানে বাজছে! মনে হচ্ছে,রুবা ডাকছে,
-আম্মু...কি হলো তোমার?ও আম্মু...
রোকেয়ার কপাল কুঁচকে এলো!আরেকবার চেষ্টা করলেন চোখ দুটো খোলার কিন্তু নাহ!পারছেন না এবারও। কেউ মনে হচ্ছে চোখের পাতার উপর বরফ দিয়ে রেখেছে!
সেই তখন থেকে রুবা কেঁদেই যাচ্ছে! লায়লা আন্টি স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন,একটু দূরে চেয়ারে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রাহী,আর বাবা সেই তখন থেকে মুখ কালো করে আসেন।
বুয়া এসে রুবাকে বলল,
'এতো কান্দে না,ভাবির কিছু হয় নাই,বেশি খাঁটা-খাঁটনি করে তো এই জন্য মনে কয়,মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে! ডা তো কয়া গেলোই,শুনো নাই?'
রুবার কান্না দ্বিগুণ বেগে বাড়লো যেনো! রুবার বারবার মনে হতে লাগল,আম্মু ওদের জন্য কষ্ট করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন! সারাটা দিন-রাত শুধু ওদের জন্য ব্যয় করতেন,নিজের দিকে একটুও খেয়াল করেননি!আর ওরাও কেউ আম্মুর দিকে খেয়াল রাখেনি,যদি রাখতো তাহলে আজ আর আম্মুর এই অবস্থা হতো না!
ধীরে ধীরে রোকেয়া চোখ মেললেন,সবাই তার পাশে ছুটে আসল,রোকেয়া রুবা কে ইশারায় কাছে ডেকে খুব আস্তে আস্তে বললেন,
-কয়টা বাজে এখন?
-৪টা বাজে আম্মু। তুমি এখন কেমন ফিল করছো?
রোকেয়া আগের মতোই বললেন,
-ভালো,তোরা দুপুরে খেয়েছিস?
রুবা কিছু বললো না। রহমান সাহেব বললেন,
-তুমি চুপ করে রেস্ট নাও,কথা বলো না।
রোকেয়া তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কয়টা বাজে এখন?তুমিও খাওনি,ছেলে-মেয়ে গুলোও খায়নি!জলদি খেয়ে নাও,আমি ঠিক আছি।
লায়লা আন্টি হেসে বললেন,
-আপনার এই অবস্থা দেখে কি কারো খাওয়া হবে?কি ভয়টাই না পেয়েছে সবাই!ঠিক আছে,আমি যাই এখন পরে আবার আসব,ওকে?
রোকেয়া একবার সবার দিকে তাকালেন,হাতের ইশারায় সবাই কে আবারো খেতে যেতে বললেন। রুবা দ্রুত টেবিলে খাবার সাজিয়ে,মায়ের জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে রুমে আসল।
-আম্মু,একটু উঠে বসো,খাবে এখন।
-তুই খেয়েছিস?
-না তুমি খাবে,তারপর খাবো,আমি খাইয়ে দেই?
রোকেয়া কিছু না বলে উঠে বসলেন।
রুবা মাকে খাইয়ে দিচ্ছে,রাহী পানির জগ-গ্লাস নিয়ে পাশে বসে আছে। দরজায় এসে দাঁড়ালেন রহমান সাহেব। রোকেয়া তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন,তারপর ছেলে-মেয়ের দিকে তাকালেন,মনে মনে বললেন,
'মাঝে মাঝে এমন অসূস্থ হওয়াটা খারাপ না আসলে!যদি এভাবে প্রিয়জনদের ভালোবাসা পাওয়া যায় তবে...!'
[উৎসর্গঃ প্রিয় আম্মু কে ]
বিষয়: বিবিধ
২৩১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন