''শিক্ষিত মেয়েরা এখন আর শখের বশে চাকরী করে না''-এটাই সত্য।
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ০২ জুলাই, ২০১৩, ০৬:৪০:৫৩ সন্ধ্যা
কেস স্ট্যাডিঃ১
মিসেস তাহমিনা রহমান। জামাই পেশায় একজন প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী,ঢাকায় নিজের বাড়িও আছে। তাহমিনার বিয়ে হয়েছিলো,ইন্টার পাশ করার পর,সংসার জীবনে চার সন্তানের জননী। বড় সন্তান জন্মের সময় একলেমশিয়া হয়েছিলো,আর বাকী তিন সন্তানই সিজারে হয়েছে!এতো কিছুর মধ্যেও তিনি অনেক ধকল সামলে পড়া শুনাটা শেষ করেছেন। চাকরী করার ইচ্ছে তেমন কখনোই ছিলো না,আর বাচ্চারা হওয়ার পরে তো আরো নেই!তিন নম্বর বাচ্চাটা হবার অর তার হাঁপানী রোগ হয়,আর শেষ বাচ্চাটা হবার পর পরই ডায়াবেটিকস ধরা পরে। ব্যাস,প্রতিদিন ঔষধ তার জন্য বাঁধা হয়ে যায়,মাস শেষে দেখা যায়,তার ঔষধের খরচ বাবদ লাগছে ৩০০০টাকার বেশি। অন্যদিকে সন্তানরা বড় হচ্ছে,সংসারে খরচ বাড়ছে,এমন অবস্থায় জামাইয়ের কাছে ঔষধের টাকা চাইতে গেলেই ধমক শুনতে হয়!!
-কি এতো রোগ বাঁধিয়েছো??তোমার ঔষধের টাকা দিতে দিতে আমি অতিষ্ট!
-আমাদের মায়েরাও তো ৭/৮ বাচ্চার মা হয়েছে,কই তাদের তো এতো ঔষধ-রোগ দেখিনি!এখনই এই অবস্থা বাকী জীবন যে কি জ্বালা সইতে হবে আমাকে কে জানে!!
এমন অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে হতো!কখনো মনে হতো,বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর!রোগ কি ইচ্ছে করে তিনি বাঁধিয়েছেন?কিন্তু আজ বউকে ঔষধের টাকা দিতে জামাইয়ের কত হিসেব!অথচ আত্নীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বাকী সবার জন্যই উদার হাত তার...! মাঝে মাঝে তাহমিনা ধমকের ভয়ে ঔষধ শেষ হয়ে গেলেও জামাইকে কিছু বলতেন না! পরিণাম? রোগ আরো তীব্র হলো!কিন্তু তার তো সূস্থ থাকা জরুরী,সংসারের জন্য,সন্তানদের জন্য। তাই বিয়ের ১৪বছর পর বাধ্য হয়ে তাহমিনা বাসার পাশেই হাইস্কুলে চাকরী নিলেন। সেই স্কুলের আবার কমিটির সেক্রেটারী স্বয়ং তার হাজব্যান্ড!! কিন্তু চাকরী ক্ষেত্রে কোন বাড়তি সুযোগ তার জন্য ছিলো না,ফলে সংসার-বাচ্চাদের সামলে নিয়েই তিনি চাকরী করতেন। অল্পদিনেই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় টিচার হয়েছেন তিনি,এবং দীর্ঘ চাকরী জীবনে কখনো এমন হয়নি যে,বাচ্চারা বুয়ার হাতের রান্না খেয়েছে,বাচ্চাদের রেজাল্টও অসম্ভব ভালো। কিন্তু আশেপাশের সবার একই কথা,প্রতিষ্ঠিত হাজব্যান্ড থাকা সত্ত্বেও তাহমিনা কেন চাকরী করেন??টাকার কি অভাব আছে কোন?এ কেমন মানুষিকতা!কেমন মা!বাচ্চা গুলোকে এভাবে রেখে চাকরীতে পরে থাকেন? পড়া-লেখা শিখলেই কি চাকরী করতে হবে?
কেস স্ট্যাডিঃ২
মালিহা তিন বোন ১ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মালিহা খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে পড়াশুনা শেষ করেছে,স্টুডেন্ট লাইফে ২/১টা টিউশনি করলেও চাকরী করতেই হবে এমন মানুষিকতা কখনো ছিলো না। বিয়ে হয়েছে বেশ ভালো পরিবারে,জামাই ব্যাংকে আছেন সিনিয়র অফিসার হিসেবে। ভালোই চলছিলো সংসার জীবন,বিয়ের এক বছর পর হঠাত করেই বাবা মারা গেলেন,রেখে গেলেন অবিবাহিত বাকী ২বোন আর ছোট ভাইকে,এবং সেই সাথে বাড়ির জন্য নেয়া ব্যাংক লোন! মালিহা কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেনা,কি করবে এই অবস্থায়?জামাইয়ের সাথে শেয়ার করলো,জামাই তেমন কিছুই বলল না!অবশেষে মালিহা চাকরীতে ঢুকার সিদ্ধান্ত নিল। বিয়ে হয়েগেছে বলেই যে বাবা-মা,ভাই-বোনের প্রতি সব দায়িত্ব চুকে গেছে তাতো না,আর বাবা তাকে লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন কি স্রেফ ভালো একজন জামাই পাবার জন্য?! সংসারের এই দুর্দিনে যদি সন্তান হিসেবে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে না পারে তাহলে কি লাভ? মালিহার চাকরী করা নিয়ে জামাই কিংবা তার পরিবারের কারো তেমন উচ্চ-বাচ্চ নেই!মালিহা যা রোজগার করে তার এক অংশ সে ব্যয় করছে নিজের মায়ের বাসার জন্য আরেক অংশ নিজের সংসারের জন্য। চাকরীর ৫বছরের এই সময়ে জামাই কখনোই বলতে পারবেনা যে তাকে রান্না করে খেতে হয়েছে বা তার আত্নীয়-স্বজন,বাচ্চাকে কখনো বুয়ার হাতের রান্না খেতে হয়েছে। জামাই ফ্ল্যাট কিনেছে তার কিস্তি প্রতিমাসে মালিহাই দিচ্ছে,ননদের বিয়ের সময় ফার্নিচারের টাকাটাও মালিহা নিজের ঈদের বোনাস পুরোটা দিয়েছে! শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি হজ্জ করতে গেছেন সেখানেও মালিহাই ইন্সেনটিভ এর টাকা পুরোটাই দিয়েছে!
কিন্তু আশে-পাশের মানুষের প্রশ্ন ঠিকই রয়ে যায়,কি দরকার মালিহার চাকরী করার? কোন দিক দিয়ে অভাব আছে তার? এভাবে সংসার ফেলে চাকরীতে পড়ে থাকার কোন মানে আছে?ক্যারিয়ার কি শুধু চাকরীতেই হয়? জামাই কখনোই বলেনা,যে তোমার চাকরী করার দরকার নেই,দু'জনে মিলিয়ে সব দিক সামলাতে চেষ্টা করি চলো! তবে অভিযোগ ঠিকই করেন...
কেস স্ট্যাডিঃ৩
নাবিলার বিয়ে হয়েছিলো চাকরী করা অবস্থাতেই। বাবা নেই,সংসারের প্রয়োজনেই চাকরী করতে হতো। কিন্তু বিয়ের পর নিজের ইচ্ছেতেই চাকরী ছেড়ে দেয় সে। কারন তার জামাই ভালো ইনকাম আছে,সংসারে অসূস্থ শ্বাশুড়ি আছে সুতরাং ওর সংসারে সময় দেয়া প্রয়োজন। নাবিলার বিয়ের বছর খানেক পর দেবরকে বিয়ে করায়,বউ ডাক্তার। অবাক হয়ে নাবিলা লক্ষ্য করে,শ্বাশুড়ি থেকে শুরু করে নিজের জামাই পর্যন্ত সবার ব্যাবহার কেমন যেনো বদলে গেছে!ইনকাম করা বউ যেখানে একজন আছে সেখানে তার মূল্য যেনো নেই!!অথচ সংসারের সব কাজ,শ্বাশুড়ির সেবা সব কিছুই তো নাবিলা করছে,কিন্তু তারপরেও নাবিলার যেনো কোন মূল্যই নেই!অথচ ডিগ্রীতো তারও কম নেই। তবুও নাবিলা সব সহ্য করে যেতো,কিন্তু পারলো না যখন নিজের প্রচন্ড অসূস্থ মায়ের জন্য একটা ইনজেকশন কেনা বাবদ আট হাজার টাকা চেয়ে জামাই-শ্বাশুড়ির কাছে অপমান হতে হলো!!
-তোমার তো ভাই আছে,সে দেখবে তোমার মা কে,তুমি কেন?এটা কেমন কথা!তোমার জামাইয়ের টাকা দিয়ে তোমার মায়ের চিকিৎসা করাবে!তোমার জামাইয়ের কি কাড়ি কাড়ি টাকা?তাই দেখাতে চাও সবাইকে জামাইয়ের অনেক টাকা আছে?!
বাধ্য হয়েই নাবিলা আবারো ফিরে আসে নিজের চাকরী জীবনে। এবং নাবিলা এখন জামাইয়ের বাড়িতে বেশ ভালোই সম্মান পায়!! যা ইনকাম করে তার পুরোটাই সে সংসারের জন্য ব্যয় করে,যখনই যার প্রয়োজন তখনই নাবিলা তার জন্য দ্বিধাহীন ভাবে করে,বিনিময়ে যদিও কখনো এমন হয়নি যে,জামাই তাকে একবেলা রান্না করে খাইয়েছে বা দিন শেষে ফিরার পর এক কাপ চা বানিয়ে খাইয়েছে!কিংবা কোন কাজ সময় মতো করতে না পারলে কেউ সেটা করে দিয়েছে,কোন অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে!
কিন্তু মানুষের মুখ কি আর বন্ধ থাকে??সুযোগ পেলেই নাবিলাকে শুনতে হয়,এতো ক্যারিয়ারিস্ট কেন আপনি?সংসারের প্রতি একটু মনোযোগী হন। আপনার উনি তো ভালোই ইনকাম করেন,তাও যদি আপনি চাকরী করেন?এত এনার্জি কই পান?!!
কেস স্ট্যাডিঃ৪
মারিয়াম বিয়ের পর থেকেই দেখছে,প্রতিমাসেই তার জামাইয়ের ঋণ করে!মারিয়াম সব সময়ই ঋণ জিনিসটাকে অপছন্দ করে,প্রয়োজনে কম নিয়ে সন্তষ্ট থাকবো তবুও ঋণ করবো না এমনটা মারিয়েমের নীতি। কিন্তু জামাইকে এই জিনিসটা বুঝিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না!আসলে বেচারাই বা কি করবে? চাকরীর বেতন খুব বেশি না,কিন্তু সংসারের খরচ অনেক!বাবা-মা,ছোট ২বোনের পড়াশুনা,বাসা ভাড়া,সংসারের খরচ সব মিলিয়ে সে কোনভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারে না!কিন্তু এসব কথা সে মারিয়ামকে বলতে চায়না,কারন মারিয়াম চাকরী করবে এটা তার কোন ভাবেই কাম্য না। কিন্তু শিক্ষিত-বুদ্ধিমতি মারিয়াম সবই বুঝতে পারে! চাকরী করার ইচ্ছে তো তারও নেই,তবে এভাবে আর কতোদিন? মানুষ কি বলবে এই ভেবে বউকে চাকরী করতে দিচ্ছে না,অন্যদিকে নিজে ঠিকই ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে!মাস শেষে বাড়ি ভাড়ার জন্য তাগাদা পেতে হচ্ছে!অবশেষে অনেকটা জামাইয়ের অবাধ্য হয়েই মারিয়াম চাকরীতে ঢুকে। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয় অবস্থার। এবং অবস্থা এখন কিছুটা ভালো,জামাই এখনো চায় মারিয়াম যেনো চাকরী না করে,কিন্তু মারিয়াম তো জানে সংসারটা চালানোর জন্য তার ইনকাম করাটা কতো জরুরী!মানুষ যতোই দেখুক না কেন,জামাই ভালো অফিসে চাকরী করে,সংসার কিভাবে চলছে,কি হচ্ছে এখানে তো আর দেখবে না!
কিন্তু প্রশ্ন মারিয়ামের বেলাতেও থেকেই যায়!! শিক্ষিতা হয়েছে দেখেই চাকরী করে,ইঞ্জিনিয়ার জামাইয়ের বউ হয়েও তৃপ্তি নেই!ক্যারিয়ার বানাতেই হবে??হাহ!
টু'ডে ব্লগে গত কয়দিন যাবত একটা টপিকসে বেশ ভালোই তর্ক-বিতর্ক চলছে। এখানকার ব্লগারদেরকে আমি অনেক দিন ধরেই চিনি,আর তাই তাদের তাদের সাথে তর্কে জড়াতে একদমই চাই না। নিতান্তই বাধ্য হয়ে কখনো মন্তব্য করি এসব বিষয়ে! তবে আজ লিখলাম,লিখতে বাধ্য হলাম! কারন মুদ্রার এপিঠ যেমন সবাই দেখছে,তেমন ওপিঠটাও দেখা জরুরী। হতে পারে,ব্লগে বয়সের দিক দিয়ে আমি তাদের থেকে অনেক জুনিয়র,কিন্তু জানার বেলায় বয়স কিছু না,এমন অনেক কিছুই হয়তো তাঁরা দেখেননি যা আমি দেখেছি!যদি দেখতেন তাহলে আর বলতেন না...
উপরে আমি যাদের কেস স্ট্যাডি গুলো দেখালাম,এরা সবাই আপাত দৃষ্টিতে,চাকরী করছে স্রেফ নিজের ক্যারিয়ার তৈরীর জন্য!অবস্থা সম্পূন্ন হাজব্যান্ড থাকা সত্ত্বেও তারা সংসার ফেলে চাকরী করছেন,কেন?? উত্তর সিম্পল,শিক্ষিতা হয়েছে কি বসে থাকার জন্য? এবং তাদেরকে যদি কখনো জিজ্ঞেস করেন,যে আপনারা কেন চাকরী করেন,তারা কিন্তু কেউই বলবে না,তাদের আসল কারন গুলো কি... এবং বলা যায় ও না এসব কারন।
কি বলবে তাহমিনা?তার জামাই তাকে ঔষধের টাকাটা পর্যন্ত দিতে চায় না,এই কথা?!!
কি বলবে মালিহা?সে তারা বাবা-মায়ের জন্য বিয়ের পর চাকরী করছে?
কি বলবে নাবিলা?চাকরি না করলে শ্বশুড় বাড়িতে তাকে অপমান হতে হবে?
কি বলবে মারিয়াম?চাকরী না করলে তার জামাইকে ঋণ করে সংসার চালাতে হবে?
এসব কারন কোনদিনই তারা বলবে না। এক কথায় তারাও এই উত্তরই দিবে,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চাকরী করছি,ইনকাম করার যোগ্যতা আছে তাই চাকরী করছি,স্বচ্ছলতার জন্য চাকরী করছি। সংসার-সন্তানদের ভবিষত ভেবে চাকরী করছি। ব্যাস...
পাঠক এটা ভাববেন না,তাদের জামাইরা বা পরিবারের বাকীরা,ইসলামিক মানুষিকতার না! যদি ভাবেন তাহলে ভুল!
তারা সবাই খুব ভালো ভাবেই জানেন,ইসলাম কি,কিভাবে তা মানতে হয়,এবং তারা অনেক ক্ষেত্রে মানেনও,আপাত দৃষ্টিতে তারা সমাজের আর দশটা পরিবার থেকেও আলাদা! তাহলে সমস্যা গুলো কোথায়? সমস্যা এখানেই যে,
থিউরী আর বাস্তবতা এক না। আর আমরা যতোই মুখে বলি না কেন,বাস্তবে নিজের মনগড়া থিউরী ছাড়া আর কোন থিউরীই ঠিক মতো মানিনা। এই ব্লগে গত ক'দিনে যথেষ্ট থিউরী কপচানো মানুষদের মন্তব্য-লেখা গুলো দেখেছি!দেখে বলতে বাধ্য হয়েছে,উনারা আসলে কোন দুনিয়ায় থাকেন,আর আমরা কোন দুনিয়ায় থাকি?!!! আমরা যা দেখি উনারা তা দেখেন না কেন??না দেখেই কিভাবে বলতে পারেন,মেয়েরা চাকরী করে শখের বসে!! বর্তমান বাস্তবতা অনেক কঠিন,এখানে যেমন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় তেমনি টিকে থাকার জন্যেও লড়াই করতে হয়। একটা সংসার চালানো যেমন এখন কঠিন,তেমনি টাকা থাকলেও একটা সংসার টিকিয়ে রাখাও অনেক কঠিন। মারিয়াম-নাবিলাদের কাছে,বেঁচে থাকার জন্য অনেক টাকা দরকার নেই,কিন্তু টাকার দরকার আছে,তারপরেও ওরা চাকরী করছে। একটা সংসারে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংসারের মানুষ গুলো কি চায়,কিভাবে চায় তা দেখাও জরুরী,হোক তা নিজের ইচ্ছা বিরুদ্ধ!
কর্পোরেট জগতের সাথে আমরাও জড়িত,তাই বলতে পারছি,কর্পোরেট অফিসে ক'টা মেয়ে পাবেন যারা শখের বসে চাকরী করছে?১০জনের মধ্যে বড়জোর,২জন। আর বাকীরা সবাই বাধ্য হয়েই সংসার সামলে হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি খাটছেন! কিন্তু আপনি যদি ঐ২জনের উপর ডিপেন্ড করে বলেন,শিক্ষিতা মেয়েরা চাকরী করে শখের বসে তাহলে আপনার মতামত হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই!
কিছুদিন আগে আমার এক পরিচিতার বিয়ে হয়েছে,শ্বাশুড়ি বিয়ের পরের দিনই বলেছেন,''শোন,পড়াশুনা শিখেছো,সুতরাং চাকরী করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এটা মাথায় রেখো,আমার ছেলে ভালো ইনকাম করে ঠিক আছে,কিন্তু এটা ভুলে যেও না,তুমি ছাড়াও তারা মা-বাবা,ভাই-বোন আছে!!
কি বলবেন এক্ষেত্রে?মেয়েটা কেন চাকরী করছে?শখের বশে?নাকি বাধ্য হয়ে?...
প্লিজ,নিজেদের জানার পরিধি একটু বাড়ান... যা জেনেছেন এতোদিন তাছাড়াও বাস্তবতা বলে আরো অনেক কিছু আছে পারলে তা জানার চেষ্টা করুন,এবং বুঝার চেষ্টা করুন। আপনি-আমাকে নিয়েই সমাজ না,সমাজে আরো অনেকেই আছে,সুতরাং মতামত দেবার আগে যাচাই করে দিন। সময় অনেক পাল্টে গেছে,মানুষ অনেক বদলে গেছে,সুতরাং কোন মানুষটা ভেতরে কি চেপে কাজ করছে তা বাইরে থেকে ঢিল ছুঁড়লেই বুঝা হয়ে যায় না। মানুষের বাধ্য হওয়ার সীমা আপনি-আমি চাইলেও নির্দিষ্ট কোণ ছকে আটকাতে পারবো না।
মেধাবিকাশ ভাই একটা মন্তব্য করেছিলেন,ফাতিমা আপুর লেখায়,''যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে'' এই প্রবাদটা কারা ডিজার্ভ করে জানেন?এইসব সংসারী-চাকুরিজীবি মেয়েরা। যারা নিজেদের সুখ-শখ বিসর্জন দিয়ে ভালোভাবে সংসার করার জন্যে,সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্যে,ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
'সংসারী' উপাধি পাবার যোগ্য এই সব মেয়েরা,কারন সত্যিকার অর্থে,এরাই সংসারী। সংসারের জন্য যা করা লাগে এরা তাই করছে। তিন বেলা সবার মন মতো রান্না করা,মেহমানদারী করা,অসূস্থ হলে সেবা করা এবং বাচ্চা মানুষ করা,বাচ্চারা কোথায় কি করছে তার খবর রাখা,সংসারের কি প্রয়োজন তা দেখা এবং সর্বোপরি জামাইয়ের সব রকমের চাহিদা পূরণ করা এই সব কিছু তারা করছে সেই সাথে ৮ঘন্টা চাকরীও করছে। আবার যদি প্রয়োজন হয়,চাকরী ছেড়ে দিয়ে,সার্টিফিকেট গুলোকে ফাইলে ভরে সন্তানদেরকে নিয়েই দিন পাড় করছে,কোণ রকম আফসোস ছাড়াই।
আর আপনারা বসে বসে টাইপ করছেন,অধিকাংশ শিক্ষিতা মেয়েরা চাকরী করে শখের বসে!তাদের জন্য আরো অনেকেই চাকরী দরকার হলেও চাকরী করতে পারছেন না!!তারা সংসারে অমনোযোগী,তারা স্বামীর সাথে ভালো আচরন করে না!!হাহাহাহা...হাসতে বাধ্য হই!
সংসারের দায় তো স্রেফ বউটার একার তাই না?সে জন্য এক বেলা জামাইকে রাঁধতে বললে মহাপাপ হয়ে যায়,সংসারই ভেঙ্গে যায়!!! আমার নানীর মতো বলতে হয় এখন,''বউয়ের কাজে একটু সাহায্য করতে বললে যেই জামাইয়ের ভালো লাগেনা,সে ছেলের আসলে বিয়ের না,বউ এর সাথে থাকারই যোগ্যতা নাই,ওর মা এর কোলেই থাকা দরকার'' খিকজ!
হিসেব যদি করেন,তাহলে আরেকটু হাতে কলমে ভালো করে করেন,দেখবেন,একজন কর্মজীবি মা ও আদর্শ মা হতে পারেন,আদর্শ গৃহিনী হতে পারেন। যদি,সুযোগ্য পতি তাহার সনে থাকে! কারন,একটা মেয়ে স্ত্রী-মা হিসেবে যতোটা না যোগ্য করার চেষ্টা করে,একজন ছেলে সুযোগ্য পতি-বাবা হওয়ার চেষ্টা খুব কমই করে,যদি চেষ্টা করে তাহলে সবই সম্ভব।
কিন্তু আফসোস হলেও সত্য,আজকাল প্র্যাক্টিসিং মুসলিম পরিবার গুলোতেও সেই সমস্যাই দেখা যায়,যা নন-প্র্যাক্টিসিং পরিবারে থাকে!একই ধারনা,একইভাবে ব্যাবহার তারাও করেন যেমনটা নন-ইসলামিক পরিবার গুলোতে হয়ে থাকে! কিন্তু দোষ সব শেষে পরে মায়ের ঘাড়েই!! আজব অবস্থা!!
সব শেষে নিজের একটা উদাহরন দিয়ে শেষ করছি,আমি নিজেও একজন কর্মজীবি,সোস্যাল ওয়ার্কার মায়ের সন্তান। আলহামদুলিল্লাহ,আমি গর্ববোধ করি,আমার মা কে নিয়ে। আমার মা শুধু আমার দৃষ্টিতেই না,আমার আশে-পাশের,এবং আত্নীয়-স্বজনদের সবার দৃষ্টিতে,একজন আদর্শ গৃহিনী,আদর্শ মা,আদর্শ বউ এবং আদর্শ স্ত্রী। আমার বাবাকে একবার তার এক কলিগ বাসার স্ট্যাডি রুমে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার হওয়া সত্ত্বেও ভাবি চাকরী করেন,ব্যাপারটা কেমন না?!চাকরী করলে কি ছেলে-মেয়ে মানুষ করা যায়?
আব্বু বরাবরের মতো শান্ত কন্ঠে গুছিয়ে বলেছিলেন,''খাদিজা (রা) কিন্তু ব্যাবসায়ী নারী ছিলেন,তিনি কয়েকটা সন্তানের মা ছিলেন,আল্লাহর রাসূল (স) এর স্ত্রী ছিলেন,সর্বোপরি একজন উম্মুল মু'মিনিনা ছিলেন। কখনো কি তার ব্যাবসার পাশা-পাশি সংসার করার কারনে আল্লাহর রাসূলের মুখে কোন অভিযোগ শোনা গিয়েছিলো? যায়নি। কারন,ইসলাম একটা নারীকে সব দিক থেকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে,হোক সে কর্মজীবি নারী কি গৃহিনী। কথা হচ্ছে,আপনি-আমি যারা ইসলাম জানা-মানার চেষ্টা করি,তারা কতটুকু প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছি!আমি জানি,আমার সংসারে আমার স্ত্রীর পাশাপাশি আমার কতটুকু দায়িত্ব-কর্তব্য,এবং আমরা দু'জনেই যদি দু'জনের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিক ভাবে পালনের চেষ্টা করি,তাহলে কি খুব বেশি হওয়ার কথা?আমি অন্তত আল্লাহর রহমতে তেমন সমস্যা বোধ করিনি,বরং আমার চাইতে আপনাদের ভাবিকেই সবসময় বেশি সিনসিয়ার দেখেছি।''
আর যদি আমার আম্মুকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়,''আপনি ঘর-বাহির দুটোই একসাথে সামলাচ্ছেন,সমস্যা হয় না?'' তিনি উত্তর দিবেন,
-আমার বিয়ের পরে,যতো সফলতা এসেছে তার জন্য যদি,কাউকে ক্রেডিট দিয়ে হয়,আমি অবশ্যই আমার জীবন সঙ্গীকে দিবো। সাহায্য,অনুপ্রেনা,দোয়া এই তিনটার কোনটারই অভাব আমি বোধ করিনি তার দিক থেকে,তাহলে সমস্যা হবে আর কি,আর হলেই বা আল্লাহর রহমতে তার সমাধান হবে না কেন?''
চাকরী বলেন,আর সমাজসেবা বলেন,মেয়েরা যে কারনের ঘরের বাইরে আসুক না কেন,তারা কখনোই তাদের আসল পরিচয়,দায়িত্ব-কর্তব্যকে অবহেলা করতে চায় না,করেও না। ২/১জন অতি বিলাসী,আবেগি নারীর উদাহরন কে আমি কখনোই বাস্তবতার পরিচয় বলে মানবো না। এক্সসেপশন ইজ নট এক্সাম্পল। মা কর্মজীবি হলেই সন্তান খারাপ হয় না,মা ঘরের বাইরে আসলেই সন্তান বিপথে যায় না,আবার মা সন্তানকে সারা সময় দিলেও সন্তান মানুষ হয়ে যায় না। উদাহরন অনেক অনেক আছে এমন...সেগুলোকেও দেখুন। আদর্শ মা,শিক্ষিত মা হতে হলে গৃহিনীই হতে হবে এমন কোন কথা নেই... আদর্শ শিক্ষিত মায়ের পরিচয় পাওয়া যায়,তার সু-শিক্ষায়,আর দায়িত্ববোধে এবং তার আমলদারিতায়। আর একজন সু-সন্তানের পরিচয়ের ধারক আদর্শ বাবা-মা দু'জনেই,মা একা নয়।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের আমরা যারা মেয়ে আছি,তাদের একটা কমন সমস্যা কি জানেন?আমরা কখনোই নিজের সমস্যা কথা কাউকে বলতে পারিনা,ব্যাক্তিত্বের লজ্জায় বলেন কি অভিমান!আমরা বলতে পারিনা,কি ধরনের কষ্ট আমরা সহ্য করি!কি কষ্ট চাপা দিয়ে কতোটা অভিমান নিয়ে আমরা সাত সকালে উঠে ভীড়-ধাক্কা সামলে বাসে করে অফিসে যাই,আবার দিন শেষে,আঁধার নামার আগেই রিক্সা-সিএনজি না পেয়ে বাসে দাঁড়িয়ে হলেও বাসায় ফিরি,আর দশটা পুরুষের মন্তব্য হজম করে! আমাদের কমন সমস্যা হচ্ছে,যাই কিছুই হোক না কেন সব আমাদের ঘাড়েই এসে পড়ে,আবার সব দায়িত্বও আমাদেরকেই নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে! তাই কেউ যদি,বলে চাকরী করি শখের বশে,তবে আমরা তাই নীরবে মেনে নেই!কারন,নিম্নবিত্ত পরিবারের সমস্যা দেখা যায়,মধ্যবিত্তের সমস্যা দেখা যায় না,কেউ কেউ দেখেও দেখেনা! কারন,অপমান-অপবাদ আর কষ্ট সহ্যের ক্ষমতা তো আমাদের মেয়েদেরই বেশি,বিলাসিতা-শখ স্যাক্রিফাইসের দায়টাও তাই আমাদেরই বেশি! কিন্ত এটাই সত্যি,চাকরী এখন আর মেয়েরা শখের বশে করে না। মানুন কি না মানুন,বিশ্বাস করুন আর নাই করুন।
বিষয়: বিবিধ
৫৬২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন