মানিয়ে নেয়া অথবা বদলে যাওয়া
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ৩১ মে, ২০১৩, ০৪:৫০:২৮ বিকাল
''রোদসী,
আমার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মেইলটা শুরু করি,কেমন?!একটা মজার ব্যাপার কি জানো?এই মেইলটা যখন তুমি পড়ছো,আমি তখন তোমার কাছ থেকে,আমাদের কাছে থেকে,আমাদের সংসার থেকে,সবার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে এসেছি। বলা যায়,আমি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছি একেবারে!কবে ফিরবো সে ভাবনা ভেবো না,আমি আর ফিরবো না তোমার কাছে। তোমার সাজানো জীবনটা অগোছালো আর করবো না!তুমি হয়তো আমার অফিসে খোঁজ নিবে,লাভ নেই!আমি চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি। বাড়ি ছাড়ছি সে কথা শুধু মা কেই বলেছি,আর কেউ তেমন কিছু জানে না,সুতরাং তুমি খোঁজ নিলেও খোঁজ পাবে না।আর... ''
মেইলটা লেখার এ পর্যায়ে এসে আবীর কিছুটা থমকে রইল,কী বোর্ডের উপর আঙ্গুল ঘুরাতে লাগল,কিন্তু কোন কী তে চাপ দিবে বুঝতে পারছে না! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পিসির স্ক্রীনটার দিকে। একটা সময় মিনিমাইজ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসল,বিকেল এখনো পুরোপুরি হয়নি,সূর্যটা ঢলে পড়ছে মাত্র,চারপাশে নীরবতা আছে খনিকটা। মোবাইলটা বেজে উঠলো,আশিকের ফোন,সালাম নিয়ে বলল,
-দোস্ত,কথা বলার মুডে নাইরে একদম!
-জানি,এ জন্য আমি বলবো,তুই শুনবি
আবির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-বল
-তুই সব ছেড়ে পালানোর চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল,সমস্যা জীবনে আসেই,পালানো কোন সমাধান না। তুই এক কাজ কর,রোদসীকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে আয়।
-এই ফালতু আইডিয়া দেয়ার জন্য ফোন দিছিস?তোরা না আসলে বুঝতেই চাস না যে সমস্যাটা কি,কতোটা গভীর!
-একটা সম্পর্ক শুরু করলি বছর হইলো না,আর বলছিস,সমস্যা গভীর!!শোন,তোদের আসলে স্পেস দরকার,সো যা ক'দিন ঘুরে আয়,অন্তত লাস্ট একটা চেষ্টা করে দেখ...প্লিজ!
আবীর চুপ করে রইল,
-হইছে,তোর আর ভাবা লাগবে না,আমি আজকেই ও বাসায় কথা বলার ব্যাবস্থা করছি,রাতে জানাবো কি হলো,তুই কোথাও যাবি না এর মধ্যে,রাখি এখন।
আবীর আরো কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইল। আসলে ঐ ব্যাপারে কথা বলতেই ওর এখন অস্বস্তি লাগে খুব! রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো,কেমন জানি ফাঁকা লাগে আজকাল সব কিছু,মনে হয় জীবনটাই ধূলোর মতো বাতাসে উড়ছে! এতোটা মূল্যহীন সময় পাড় করতে হবে কখনো ভাবেনি। আশে-পাশের সবাই কেমন জানি বিরক্ত হয়ে আছে,সবার চোখের মাঝে নিজের এক ধরনের ব্যার্থতা দেখতে পায় যেনো!আরো বেশি অসহায় লাগে তখন।
রোদসীর সাথে আবীরের পরিচয় ইউনিভার্সিটি জীবন থেকে,এক রকম বন্ধুত্ব ছিলো বলা যায়। মেঝ খালার বান্ধবীর মেয়ে,আবার আবীরের বড় ভাইয়ের ছাত্রী ছিলো কলেজ জীবনে,সেই সুবাদেই ভালো খাতির ছিলো। মা মনে মনে খুব পছন্দ করতেন,আর তাই পড়াশুনা শেষ করে চাকরীতে ঢুকার পরেই মা রোদসীকে বউ করে আনার আবদার করে বসলেন! আবীরের বাবা নেই,বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে,তিনভাই এতোদিন একসাথে থাকলেও,ওর চাকরী হবার পর,মেঝভাই উত্তরা চলে যান,বড় ভাই বদলী হয়ে সিলেট। রোদসীরা পারিবারিক অবস্থার দিক দিয়ে আবীরদের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। সে জন্য আবীর রোদসীর ব্যাপারে তেমন কিছু কখনো চিন্তা করতে চাইতো না,কিন্তু রোদসীও যেহেতু রাজী ছিলো তাই মা কিভাবে যেনো সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলেন। রোদসী বউ হয়ে আসে আবীরের ঘরে।
চায়ের কাপটা কিচেনে রেখে আসতে হবে,বিছানা ছেড়ে উঠলো। মা বড় বোনের বাসায় গেছেন,পুরো বাসায় আবীর এখন একাই বলা যায়। রুমে এসে দেখে মোবাইল বাজছে,বড়'পার ফোন,সালাম বিনিময় শেষে বড়'পা বলল,
-তুই কি আমাকে আপন বোন ভাবিস নাকি পাড়াতো বোন?
কথাটা শুনে হচকিয়ে গেল আবীর!
-আপন বোনকে আবার পাড়াতো বোন ভাবে কিভাবে?!কি যে বলো না!
-চুপ কর,মানুষ বড় বোনের সাথে সব কিছু শেয়ার করে,আর তুই?হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও কথা বের করিস না,ভুল করেও বোনের বাসার পথ মাড়াতে চাস না!মরি না বাঁচি সে খবর তো নেয়া দরকার নেই!নাহ?
-উফরে আপা!আমি এমনিই ঝামেলায় আছি,আর তুমি কি শুরু করলা?
-হুম,তুই তো ঝামেলাতেই থাকবি!,শোন,মায়ের কাছে শুনলাম,রোদসীর সাথে নাকি তোর ঝামেলা চলছে,এ জন্য ও মায়ের বাসায় চলে গেছে আর তুই ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?!
আবীর কিছু না বলে চুপ করে থাকে,
-আবীর,আমরা বোনেরা কি এতোই পর হয়ে গেছি?যে এতো কিছু হচ্ছে,অথচ একবারও আমাদের সাথে শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করলি না!নিজেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি!আশ্চর্য!!
-আপা,আসলে কি করবো,কি বলবো মাথায় কাজ করে না,তাই...
-বুঝতে পেরেছি,তোকে কি আর আমি চিনি না?!ভালো মতোই চিনি। শোন,কাল অফিস শেষ করে আমার বাসায় আসবি,রাতে এখানেই খাবি,আমি কথা বলবো তোর সাথে,আর কোন না শুনবো না আমি!
কি আর করা?!আবীর হ্যাঁ বলে ফোন রেখে দেয়। কিচেনে কাপ রাখতে যেয়ে দেখে,চা বানানোর সময় চারপাশে চিনি ছড়িয়ে পড়েছিলো এখন সেখানে পিঁপড়া এসে জমেছে! নাহ,কেন যে সে কাজ করার সময় একটু খেয়াল রাখে না! রোদসী থাকলে তো এখন হয়েছিলো,এ নিয়ে লংকা কান্ড বাঁধতো! আবীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে চিনি গুলো পরিস্কার করা শুরু করে।
ছোট-খাটো এসব ব্যাপারে কেন জানি তার আর রোদসীর মধ্যে একেবারেই মিলতো না,তর্ক থেকে এক পর্যায়ে ঝগড়াও লেগে যেতো। নিজের ব্যাপারে কেউ এতো সূক্ষ ভাবে ভুল ধরবে ব্যাপারটা আবীর কোনভাবেই মানতে পারতো না!অন্যদিকে রোদসী... মানিয়ে নেয়ার মতো কষ্টকর কাজ যেনো তার জন্য আর কিছু নেই!তাই ওর কাছে টুকটাক ব্যাপার গুলোও সুন্দর-সঠিক হওয়া চাই,না হলে কেমন খুঁতখুঁতে লেগে থাকে মনে!
প্রথম প্রথম আবীর কিছু বলতো না,হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো,কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সে অসহ্য হয়ে পড়তে লাগল! আর রোদসীও বিরক্ত হতে শুরু করল,কিন্তু দু'জনে নিজের মতোই থাকল,একটা পর্যায়ে দু'মাসের মাথায় সুখ মূহুর্ত কাটানো কিংবা নতুন সংসার সাজানো বাদ দিয়ে সব বিষয় নিয়েই ওদের মধ্যে তর্ক শুরু হতে লাগল!!একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হবার বদলে রাগ-ক্ষোভ জন্মাতে লাগল!
-এভাবে হাসলে কেন?শুনতেই কেমন শোনায়!আচ্ছা আবীর,কারো সামনে এভাবে হাসলে অন্যরা বোর ফিল করে এটা বুঝোনা?!প্লিজ,এভাবে শব্দ করে হাসবে না,অন্তত আমার পরিচিত সার্কেলের সামনে না,ওরা আমাকে অনেক রুচি সম্মত মানুষ জানে!
-আমার রুচি নিশ্চয়ই জঘন্য না,আমি এতোটা থার্ড ক্লাস নই যে মানুষ আমার হাসি শুনে বোর ফিল করবে,গেলাম না তোমার সাথে কোথাও... !
-এভাবে লাগামছাড়া কথা বলো কেন?!
-আমি লাগাম ছাড়া কথা বলি না,আমার মনে যা মুখেও তা! আমি দিল খোলা মানুষ!
-দিল খোলা মানুষরা কি ব্যালেন্সহীন ভাবে কথা বলে?তুমি দিল খোলা না,তুমি কথা-বার্তায় একদমই লাগামহীন,কোথায় কোন রকমের মার্জিত ভাব নেই!
-আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে চাই না,পারলে আমার কাছ থেকে শিখো আর না হলে থাকো নিজের মতো!
রোদসী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকতো!কখনো তর্ক করতো! কিন্তু আবীর কখনো ভাবতে চায়নি,অন্যের জন্য স্পেশালি নিজের আপনজনদের জন্য নিজেকে বদলাতে হবে,ও বিশ্বাস করতো 'আমি যেমনই হই,আমার আপনজনেরা আমার সাথে এডজাস্ট করে নিবেই,দরকার হলে আমি তাদেরকে বদলে নিবো,বাট আমি বদলাবো না' আর অন্যদিকে রোদসীর ভাবনাটা এমন ছিলো,'আমি যার সাথে থাকবো,তাকে আমার মতোই হতে হবে,না হলে নিজেকে তৈরী করে নিবে,তবুও আমার মতোই হতে হবে। কিন্তু কারো থিউরিতেই কেউ পড়েনি! আর কেউই পারেনি কাউকে নিজের থিউরী মতো গড়ে নিতে। আবীরের এক বন্ধু পরামর্শ দিলো,'শোন,তুই তোর মতো থাকবি,এক সময় দেখবি এমনিই সে এডজাষ্ট করে নিবে।' তাই আবীরও সেভাবেই রইল।
অন্যদিকে ধীরে ধীরে রোদসী খুবই হতাশ হতে লাগল,সংসার সম্পর্কে,আবীর সম্পর্কে মনের ভেতর অনীহা-হতাশা আর ক্ষোভ জন্মাতে লাগল!আবীরকে বিয়ের সিদ্ধান্তটা বলতে গেলে অনেকটা রোদসীর নিজেরই ছিলো,ও না চাইলে আব্বু-আম্মু কখনোই জোর করতেন না,কিন্তু আবীর সম্পর্কে ওর সব সময়ই বেশ ভালো ধারণা ছিলো,তাই প্রপোজাল আসতেই সে একবাক্যে হ্যাঁ বলে দিয়েছে। এ কারনেই রোদসী ওদের সমস্যা গুলো কারো সাথেই শেয়ার করতে চাইতো না,এমনকি মা কেও বলতো না!চেয়েছিলো নিজেই সলভ করতে তাও পারছেনা,একটা সময় আবোরের প্রতি,নিজের প্রতিই এক ধরণের অভিমান জন্মাতে লাগল,তাই ধীরে ধীরে সবার কাছ থেকে,সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় শুধু!
আবীর খেয়াল করছিলো,ক'দিন যাবত রোদসী একদমই চুপচাপ হয়ে আছে,কোন কথাই নেই বলা যায়। আবীর উচ্চ আওয়াজে টিভি দেখলেও সে কিছু বলছে না,মোবাইলে কথা বলার সময় উচ্চ স্বরে হাসলে কিংবা রোদসীর মতে,বন্ধুদের সাথে ক্ষ্যাত ভাষায় কথা বললেও ওর কোন বিকার নেই! অফিসে যাওয়ার সময় নিজের কেনা একই কালারের শার্ট পড়ছে অথচ রোদসীর পছন্দ করে কিনে দেয়া অন্য কালারের শার্ট ধরেও দেখছে না এটা নিয়েও রোদসীর কোন কথা নেই! যেনো সে এই জগতেই নেই! সপ্তাহ শেষে যখন মা এসে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দেয় আবীরের হাতে,তখন আবীরের কেন জানি মনে হয়,রোদসী সম্ভবত কোন বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে!এতোটা উদাসীন মানুষ সে না,মা বলল,ওর নাকি আজকাল কি হয়েছে,খুব একটা কথা বলে না,সকালেও বের্যে যায় চুপচাপ আবার সারাদিন অফিস শেষে ফিরে চুপ করে রুমে বসে থাকে,সংসারে কি হচ্ছে কোন খবর নেই!আবীরের বুকের ভেতর কেমন জানি ভয় ভয় লাগতে শুরু করে! যেনো বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে...!
রোদসী অনেকক্ষন যাবত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আবীরের জন্য। রাত আটটা বেজে চলছে,এখনো আসার নাম নেই!ওকে অপেক্ষা করতে দেখে আবীরের বড় বোন নিশাত বলল,
-ও কি,তুমি যখন বাসায় ছিলে,তখনো এমন দেরি করে ফিরতো?
প্রশ্নটা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলো রোদসী!
-নাহ,অতোটা দেরি কাজ না থাকলে খুব একটা করতো না,আর হলেও আমাকে জানাতো।
-হুম,আজো হয়তো কোন কাজেই আটকা পড়েছে,তুমি তো আর নেই সাথে,তাই জানায়নি!
রোদসী কিছু না বলে চুপ করে রইল। মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো মনে হয়! মাত্র এ কয়দিনেই কি মানুষ বদলে যায়?! ওকে চুপ থাকতে দেখে নিশাত বলল,
-ওর জন্য কি তোমার এখনো খারাপ লাগে?মানে চিন্তা হয়?
রোদসী মাথা নিচু রেখেই বলে,
-তাতো হয়ই,আমি তো আর ওর মতো না,জানেন আপু,আমি মায়ের বাসায় আজ মাস খানেক হয়ে এলো,একবারো ফোণ করে বলেনি,স্যরি বা ফিরে এসো। ২/১দিন পর পর ফোন করে,তাও কেমন আছি জেনেই কথা শেষ!অথচ আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম!আসলে আমার সাথে ওর এডজাষ্ট কখনোই হবে না...ও কোনদিনই আমাকে বুঝবে না!আর আমারো বুঝা হবে না!
নিশাত একটু হাসল,
-তুমি কি জানো?ও যে চাকরী-বাসা সব ছেড়ে দিয়ে ঢাকা থেকে চলে যাচ্ছে।
রোদসী চমকে উঠলো!তা দেখে নিশাত বলল,
-হুম, আসলে ও পালাতে চাচ্ছে,কারন হতে পারে, ও না পারছে তোমার সাথে থাকতে,না পারছে নিজের মতো থাকতে আর না পারছে তোমার সাথে যে ব্যাবহার করেছে তার অপরাধবোধ থেকে বাঁচত। আবার এটাও হতে পারে,ও তোমার কাছে থেকে অনেক অপ্রত্যাশিত কষ্ট পেয়েছে,হতাশ হয়ে গেছে আর তাই সে ভাবছে,সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেই সে বাঁচবে,তুমিও ওকে ছাড়াই ভালো থাকবে!
রোদসী তাকিয়ে রইল নিশাতের দিকে!সাথে সাথেই কিছু বলতে পারল না। নীল আকাশে একফালি চাঁদটা বারান্দা থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে,সেদিকে তাকিয়ে নিশাত বলল,
-তুমি জানো,আমি সংসার করছি আজ ১৬বছর,অথচ তোমাদের দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো,আমার প্রিয় রঙ কি,সে জীবনেও বলতে পারবে না,এমনকি তাকে যদি জিজ্ঞেস করো,যে আপনার আপন ছোট ভাইয়ের শ্বশুড়বাড়ি কোথায় তিনি সেটাও বলতে পারবেন না। অথচ আমাকে জিজ্ঞেস করো,তাঁর নাড়ি-নক্ষত্র কি আছে সব বলতে পারবো। তোমার দুলাভাই,ঘুমালে নাক ডাকে,আর আমি যদি একবার ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড সর্দি নিয়ে হাঁচি দেই,সে চেঁচিয়ে উঠে!সে আজ পর্যন্ত কোথাও গেলে আমার কিছু শখ করেও আনেনি,আমার যদি পছন্দ না হয় এই ভয়ে!আর আমাকে দেখো?শপিং এ গেলে নিজের জন্য কিছু না কিনলেও তার জন্য মনে করে তার প্রয়োজনিয় সব কিছু কিনে আনি। রোদসী, তার মানে কিন্তু এই না,যে আমি তার বিপরীত আচরন গুলোর জন্য মনে কষ্ট পাইনি,আমি এক ঝাটকায় সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিয়েছি!মোটেও না। আমিও আড়ালে কেঁদেছি কখনো মন খারাপ করে,ভেবেছি আমার বান্ধবীরা না জানি কতো ভাগ্যবতী,ওদের স্বামীরা ওদের কতো ভালোবাসে! কখনো কখনো অনেক অতিষ্ট হয়েছি,ভাবতাম আমি তো তার কাছে টাকা-গয়না চাই না,স্রেফ ভালোবাসা চেয়েছি,আমার জন্য তার কিছু স্বভাব-ব্যাবহার সংশোধন করুক এটাই চাই,আমার যা ভালো লাগে না তা সে না করুক এগুলো কি খুব বেশি চাওয়া?!!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নিশাতের বুক থেকে যেনো!কিছুক্ষন চুপ থেকে রোদসীর দিকে তাকিয়ে মুচকী হেসে বলল,
-কিন্তু আমার সব কান্না-অভিমানই শেষ হয়ে যেতো যখন তার মুখে হাসি দেখতাম,আমার কোন কাজ দেখে তার মুখে তৃপ্তির আভা দেখতাম,তখন অসম্ভব খুশী লাগত। আমার প্রতি তার বিশ্বাস আছে,যে আমি কোন কাজে বা তার প্রতি কোন উদাসীনতা দেখাবো না,আমি সব কিছু যত্ন নিয়েই করবো,এবং ধীরে ধীরে তার এটাও বিশ্বাস জন্মেছে যে,আমি তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি,তার জন্য যা কিছু ভালো আমি তাই করতে চাই,তার এই বিশ্বাসই আমাকে অনুপ্রেরনা দিয়েছে,তার বিপরীত আচরন গুলো সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে,এবং একটা সময় সেও বুঝতে পেরেছে,তার ভুল গুলো সংশোধন করা উচিত!কিন্তু স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য গুলো মানুষ চাইলেও বদলাতে পারেনা,তাই তোমাদের দুলাভাইও আজো পারেন নি!হাহাহা
নিশাত শেষের দিকে এসে এমন ভাবে বলল,যে রোদসীও না হেসে পারলো না। রোদসী বলল,
-আপনি অনেক সুন্দর মনের মানুষ আপা,কি সুন্দর করে আপনি পেরেছেন দুলাভাইয়ের অপছন্দনীয় সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে,কিন্তু আমি পারিনি! আমার মানতে অনেক কষ্ট হয়,যে আবীর এমন! আসলে,যতোদিন ওকে জেনেছি,কোন নেগেটিভ কিছু জানিনা,তাই বিয়ের পর এতোটা বিপরীত আশা করিনি। মানুষটা কেমন জানি এক ধরণের খামখেয়ালী ভাব নিয়ে থাকতে পছন্দ করে,নিজে যা পছন্দ করবে না সেটা হাজার বলেও করানো যাবে না,আর খুব বিরক্ত ভাব নিয়ে থাকে সব সময়। আপু আপনিই বলেন?আমাদের বিয়েটা কি জোর করে কেউ করিয়েছিলো? কিংবা আমি কি একেবারেই তার অপছন্দের কেউ?...কেন সে আমার কথা শুনতে চায় না তাহলে?আমি কি তার শক্রু?আমার আবদার,ইচ্ছে সব কিছুতেই তার বিরক্তি! আমি একেবারেই ফেডআপ হয়ে গিয়েছিলাম,মনে হচ্ছিলো,আমার পক্ষে সব কিছুই অসম্ভব!এ জন্যই চলে আসি ওকে ছেড়ে...
নিশাত কিছুক্ষন চুপ করে থাকে,
-হুমম...বাট এখন কি মনে হচ্ছে তোমার?
রোদসী হাসার চেষ্টা করে বলল,
-খুব যে অনুশোচনা হচ্ছে তা না,তবে মনে হচ্ছে,সংসার ছেড়ে আসাটা ঠিক হয়নি...এতো সহজেই অস্থির না হলেও পারতাম তবে হ্যাঁ,এতটুকু বুঝতে পেরেছি,ও ইচ্ছে করে ওসব করেনি,ওর স্বভাব বিরুদ্ধ কিছু কেউ করলে ও তার উপর অনেক বিরক্ত হয়ে যায়,আমার উপরেও তাই হয়েছিলো,বাট ও আমাকে অপছন্দ করে না। কিন্তু আপু,আমাকে কখনো আবীর বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেনি,বলেই দেখতো একবার!না আমাকে বুঝার চেষ্টা করেছে না নিজে কি বুঝাতে চায় তা বলেছে...
বলতে বলতে অভিমান ভরা দৃষ্টি নিয়ে নিশাতের দিকে তাকালো রোদসী,সম্ভবত নিশাতের সায় চাইছে,নিশাত মুচকী হেসে রোদসীর হাত ধরে বলল
-দেখো,ভুল-ত্রুটি তো সবারই আছে কম বেশি,তোমার আমারো আছে,তবে হ্যাঁ আবীরের যে বেশ কিছু বদঅভ্যাস আছে সেটা আমিও মানি,পরিবারের সবার ছোট ছিলো,তাই আদরো বেশি পেয়েছে সে জন্য নিজের দোষ দেখার বা শুধরানোর অভ্যাস কম,এবং ভেতরে ভেতরে অনেকটাই ছেলেমানুষি আছে এখনো কিন্তু আমি এটাও জানি,ওর মনটা যথেষ্ট ভালো এখনো ও খুব আদর-ভালোবাস খুঁজে সবার কাছে। আর এটা একটা কমন ট্রিক, যে কাউকে রাগ দেখালে যদি না বুঝে তবে ভালোবাসা দিয়ে,আন্তরিকতা দিয়ে বুঝালে সে ঠিকই বুঝে,আবীরের বেলাও তাই। বুঝলে?
রোদসী স্মিতি হেসে মাথা উপর-নিচ করলো,তা দেখে নিশাত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-আমি জানি রোদসী,তুমি অসম্ভব ভালো মনের একটা মেয়ে,গুনীও বলা যায় এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো তুমি ওকে অনেক পছন্দ করো,ওকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না। আর ঐ বান্দাকেও আমি চিনি,মায়ের কাছে শুনলাম,তুমি ছিলেনা,এ ক'দিন সে তোমাকে যথেষ্ট মনে করেছে,একদমই মনমরা হয়ে ছিলো। চেষ্টাও করেছে নিজেকে কিছুটা সংশোধন করার,মা বলল,ও নাকি নিজেই নিজের রুম গুছিয়ে রেখেছে,রাত জেগে টিভিও দেখেনি,তুমি যা যেভাবে রাখতে সেভাবেই রেখেছে বাট হয়তো তোমাকে কিছু বলেনি,না জানি ইগোতে লাগে এই ভয়ে!হাহাহা।
রোদসী আগের মতোই মুচকী হেসে বলল,
-আমি বুঝি সেটা,কিন্তু ইগো তো আমারো কম না,তাই তো আমিও চুপ করে আছি! তাই বলে এই সুযোগে আপনার ভাই চাইলেও আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না,আমি ঠিকই বেঁধে রাখবো!
একথা শুনে নিশাত আবারো হেসে ফেলল,সাথে রোদসীও! কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নিশাত হাসি থামিয়ে উঠল,কিছুদূর যেয়ে আবারো ফিরে এসে রোদসীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-তবে একটা কথা কি জানো,একদম মনের মতো পারফেক্ট কেউ হয়না,খুব কপাল ওয়ালা কেউ কেউ হয় হয়তো,তবে বেশির ভাগই হয় না,হতে পারে তুমি অনেক কিছু চাও না কিন্তু তারপরেও একদম যতটুকু চাও ততটুকুও সম্পূর্ণ মনের মতো পাবে না। কমবেশি নিয়েই আমাদের চলতে হয়,সেটা যেখানেই যাও। এটাই জীবনের বাস্তব রূপ। আমি যাই,আবীর এসেছে মনে হয়,তুমি একটু পরে এসো,দেখো...তোমাকে দেখে কতো খুশী হয় সে!
''মেলেনা,আজ কিছু মেলে না
ভালবাসা আর বাঁচতে চাওয়া ছাড়া
এ দু'টোই মিলে যায় বসে একা ভাবি তাই,এই কি বেশি না? বলো,এই কি বেশি না?''
গানটা গুন গুন করতে করতে রোদসী আরো কিছুক্ষন বসে থাকে ব্যালকনিতে,আপুর এই ব্যালকনিতে হাসনাহেনা ফুল ফুটেছে খুব সুন্দর...ঘ্রানে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রোদসীর কেন জানি,আবীরের সেই খারাপ ব্যাবহার গুলো ঘুরে ফিরে মনে পড়ে!সেই রাগ,উল্টা-পাল্টা কথা গুলো... আসলে,মনকে মানানো অতো সহজ না,যতোটা সহজে বলা যায়,মানিয়ে নাও। কিন্তু সব কিছুর পরেও প্রিয় মানুষটা একবারে হারিয়ে ফেলতে কেউ কখনোই চায় না,যতো কিছুই হোক। ব্যাপারটা এখন রোদসী-আবীর খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে,কিন্তু তবুও মনে খটকা লাগে,সামনের দিন গুলো তে সব ঠিক থাকবে তো?দু'জন দু'জনকে কিছুটা হলেও বদলাতে বা একে অপরের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে তো?...!! ভাবতে ভাবতে রোদসী ড্রয়িং রুমে ঢুকে,আবীর ওকে দেখে একদমই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে,রোদসী সালাম দিয়ে মুচকী হেসে বলে,
-আমাকে চিনতে পেরেছেন আপনি?চেনার অবশ্য কথা না!বহু বছর পর যেহেতু দেখা!বাট আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি,আপনার সাথে আমার সাত মাস আগে বিবাহ হয়েছিলো,এবং আমি সেই যাকে রেখে আপনি এখন বনবাসে চলে যেতে চাচ্ছেন!!
আবীর মুখের ভাবটা আরেকটু করুন করে বলল,
-তুমি কিভাবে জানলে?আমার খবর জেনে আর কি হবে!বাদ দাও আমার কথা...তুমি তো ভালোই আছো নাকি?
রোদসী কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল,ইচ্ছে করছে সোফাটা তুলে আবীরের মাথায় ভাংতে!! ঠিক তখনই আবীর হাসি চেপে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোমার কি কিছু ভাংতে ইচ্ছে করছে? থাক,আর কিছু আমার মাথায় ভাংতে হবে না!অলরেডি আমার মাথায় যথেষ্ট কিছু তুমি ভেঙ্গেছো তারচেয়ে...
-আমি ভেঙ্গেছি?আর তুমি কি করেছো?ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছো?তোমাকে ধরে আমি ১৬তলার ছাদের উপর থেকে উল্টো করে ঝুঁলিয়ে রাখবো!তোমার সাহস কতো,সমস্যা বাঁধিয়ে তার সমাধান না করে এখন আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছো!তোমাকে...
আবির চেঁচিয়ে বলল,
-আমি দূরে যাচ্ছি?বাসা ছেড়ে কি আমি এতোদিন দূরে ছিলাম?দোষ শুধু আমার একারই না?
-নাহ,দোষ সব আমার!নিজে কিছু বলবেও না,বুঝতেও দিবে না,অন্যেরটা বুঝবে দূরের কথা!আর এখন...?আমিও গেলাম তাই সেও যাচ্ছে!বাহ...কি সমাধান!!!
বলতে বলতে রোদসী মাথা নিচু করে ফেলল! খুব কান্না পাচ্ছে ওর। আবীরও আর কিছু বলল না,দু'জনেই চুপ। কিছুক্ষন পর আবীর বলল
-আচ্ছা,ঠিক আছে,যা হওয়ার হয়েছে,আমি কোথাও যাচ্ছি না। এখন তুমি ঠিক করো,তুমি কি এখান থেকে আমার সাথে নিজের বাসায় যাবে নাকি একাই মায়ের বাসায় যাবে?
রোদসী চেষ্টা করেও রাগ ধরে রাখতে পারলো না,তবুও মুখ না তুলেই বলল
-আমি আমার বাসায় যাবো!'' আবীর সাথে সাথে বলল,'আলহামদুলিল্লাহ,যাক,বাঁচলাম!!''
রোদসী হাসছে,প্রানপনে চেষ্টা করছে,হাসি চেপে রাখতে কিন্তু পারছে না!আবীরের মনে হলো,এই প্রথম সে বুঝতে পারছে,রোদসী যখন রাগ ভেঙ্গে হাসে তখন তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে,চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না যেনো,যেমন এখন সে চোখ ফেরাতে পারছে না,এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদসীর দিকে...মানিয়ে নেয়াটা আসলে খুব কঠিন না!যতোটা তারা ভেবেছিলো।
[উৎসর্গঃপ্রিয় একজন বন্ধুকে। অনেক ভেবে চিন্তেই আমরা নতুন একটা জীবন শুরু করে থাকি,তুমিও করেছো। সমস্যা আসে সবার জীবনেই,তবে সব ক্ষেত্রে পালিয়ে সমাধান করা যায় না। হয়তো,তেমন অভিজ্ঞতার সময়-সুযোগ হয়নি,কিন্তু এতটুকু বলতে পারি,মানিয়ে নিতে হয় কিছু সময় না চাইলেও,তখন আমরা কি চাই সেটা গুরুত্বপূর্ণ না,সেটাকে গুরুত্ব দিতে হয় না। চাইলে সত্যিই পারা যায়,ভেঙ্গে চূর্ণ হবার শেষ মূহুর্তে এসেও নতুন করে কিছু গড়তে। ]
বিষয়: বিবিধ
৪৫৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন