অমর একুশে গ্রন্থমেলাঃ বাঙালীর প্রাণের আওয়াজ

লিখেছেন লিখেছেন নোমান সাইফুল্লাহ ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:০৩:১০ রাত



অমর একুশ। একটি ইতিহাস একটি প্রাণের আওয়াজ। বাঙালী জাতির স্বাধীনতা-স্বাধীকার আন্দোলনের প্রথম শ্লোগান। যে জাতি ভাষা এবং ঐতিহ্যের জন্য প্রাণ দিতে পারে, সে জাতির স্বাধীনতা কোন শুকুনের দল কেড়ে নিতে পারবে না কখনো।



একুশে ফেব্রুয়ারী ঘিরে বাঙালীর স্বপ্ন এবং কল্পনার মেলা বসে বাংলা একাডেমি চত্বরে। এখানে বাংলা ভাষার সৃজনশীল নান্দনিকতা, শিল্পকলার রঙতুলি লুটোপুটি খায়। শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণী এবং বয়সের ভারে নুয়ে যাওয়া বৃদ্ধও একবার বাঙালীর স্বপ্নকে স্পর্শ করতে একুশে বইমেলায় ঘুরে আসে। হাজারো বাঙালীর প্রাণের কোলাহলে ভরে ওঠে ফাল্গুনের নীল আকাশ।



অমর একুশে বইমেলার ইতিহাসঃ

বাংলা ভাষার স্বাধীনতা তথা বাঙালী চেতনার স্বাধীনতা স্বাধীকার হরণ করার বিরুদ্ধে বাঙালী তরুণরা রাজপথে নেমে আসে ১৯৫২ সালে। তৎকালীন পাকিস্থানি স্বৈরশাসকের পদলেহী বাহিনীর গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত সহ অসংখ্য তরতাজা প্রাণ বুকের রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষার অধিকারকে উর্ব্ধে তুলে ধরেন। এই প্রতিবাদ শুধু ভাষার জন্য নয়। এই প্রতিবাদ ছিল, স্বৈরচার এবং অনাচারের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদ ছিল বাঙালী জাতির স্বকীয় এবং স্বার্বভৌমত্ব ঘোষণার প্রথম বিষ্ফোরণ। আর এই আন্দোলন ৫২ এর ভাষা আন্দোলন হিশাবে পরিচিত। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় পরবর্তীতে গড়ে ওঠে অমর একুশে বইমেলা।

=> ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন।

=> ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমী প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং এদের দেখাদেখি আরও কেউ কেউ বাংলা একাডেমীর মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।

=> ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ঐ গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমীর পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমীর কোন ভূমিকা ছিল না শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেয়া ছাড়া।

=> ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হোন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম "অমর একুশে গ্রন্থমেলা"র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। (উইকপিডিয়া)

=> ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মেলার নামকরণ করা হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রন্থমেলা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতো। এরপর ক্রেতা, দর্শক ও বিক্রেতাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন অবধি এই মেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু ফেব্রুয়ারি মাসে চার বছর পর পর অধিবর্ষ আসে, তাই কখনও এই মেলা মাসের ২৮ তারিখে, কখনও ২৯ তারিখে শেষ হয়।



গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মেলা নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে। প্রকাশনীসমূহের স্টলগুলো প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্ণার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় বিভাজন করে স্থান দেয়া হয়। এছাড়া মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে ভাগ করা হয়। এই মেলায় দেশের খ্যাতনামা সব প্রকাশনী, বই বিক্রেতা ছাড়াও দেশের বাইরে, যেমন ভারত, রাশিয়া, জাপানপ্রভৃতি দেশ থেকেও নানা প্রকাশনা সংস্থা তাঁদের বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।

=> এই মেলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারেরও বহু রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান, যেমন: বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ইত্যাদি তাদের স্টল নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। মেলাতে ইদানিং বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা যেমন সিডি, ডিভিডি ইত্যাদিও স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের সেবার বিবরণসহ উপস্থিত হয়। মেলাতে বেশ জনপ্রিয়তার সাথে স্থান করে নিয়েছে লিটল ম্যাগাজিনও। মেলার মিডিয়া সেন্টারে থাকে ইন্টারনেট ও ফ্যাক্স ব্যবহারের সুবিধা। এছাড়া থাকে লেখক কর্ণার এবং তথ্যকেন্দ্র। মেলা প্রাঙ্গন পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত। মেলায় বইয়ের বিক্রয়ে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় থাকে। এছাড়া মেলায় শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ ও তথ্যের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স রাখা হয়, যারা বইয়ের কপিরাইট বা মেধাসত্ত্ব আইন লঙ্ঘন করেছে কি-না সনাক্ত করেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেন। মেলায় প্রবেশের জন্য ছুটির দিন ও ছুটির দিন বাদে অন্যান্য দিন আলাদা প্রবেশ সময় থাকে।

এবারে বইমেলা বাংলা একাডেমি চত্ত্বর ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বর্ধিত কলেবরে আয়োজন করা হয়েছে।



পরিশেষে কবিতা দিয়ে শেষ করছি

ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়

ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য-বাংলার জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে

একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য

আলাওলের ঐতিহ্য

কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের

সাহিত্য ও কবিতার জন্য—

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে

পলাশপুরের মকবুল আহমদের

পুঁথির জন্য—

রমেশ শীলের গাথার জন্য,

জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে

ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল

নজরুলের ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি

আমার দেশের মাটি।’

কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি

----- মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী



তথ্যসুত্রঃ

১. দৈনিক জনকন্ঠ

২. উইকপিডিয়া

৩. গ্লোকাল২৪ডটকম

৪. ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ গুগল মামা

বিঃদ্র (এটি কোন মৌলিক প্রবন্ধ নয়। পাঠকের জানার সুবিধার্থে অধিকাংশ তথ্যই হুবহু তুলে ধরা হয়েছে)

বিষয়: বিবিধ

২১৫০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

176475
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০১:৩১
গেরিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:২৯
129901
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : ধন্যবাদ আপানাকে....Good Luck
176495
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:২৫
নিস্পাপ লিখেছেন : নোমান, তথ্য সমৃদ্ধ লিখার জন্য ধন্যবাদ। ব্লগে অনিয়মিত কেন ??
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৩
129903
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : ব্লগ নিয়ে সমস্যায় আছি। সরকার কিছু দিন পর পর বন্ধ করে, কিছুদিন বিরতি। আবার লেখা....এসবের কারণে একটু ছেদ পড়ে। আবার পাঠক মন্ডলি এমন রসকসহীন লেখা পড়তে আগ্রহী হয় না। আমিও আবার রস দিয়ে লিখতে আগ্রহী হই না। ফলে সব মিলিয়ে লেখালেখিটাও চলছে ধির গতিতে..

আর আপনার এই নিকটি নতুন হলেও কথাগুলো খুব পুরনো মনে হচ্ছে...
স্বাগতম আপনাকেGood Luck
176513
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৫:০২
শিকারিমন লিখেছেন : চমত্কার তথ্য বহুল লিখা।
ধন্যবাদ।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৫
129905
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : শুভেচ্ছা আপনাকে প্রথম বসন্ত...Good Luck
176530
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৬:৫৬
জবলুল হক লিখেছেন : ভালো লাগলো । Rose Rose Rose
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৬
129906
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : শুভেচ্ছা আপনাকেও....Good Luck
176534
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৮:১৩
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : খুউব ভালো লাগলো তথ্য সমৃদ্ধ পোষ্টটি। Good Luck Good Luck
আপনার আর ইকি আপুর বই আমি বই মেলা থেকে খরিদ করে এনেছি। তা না হলে বই মেলায় কবে যেতাম নিজেও জানতামনা।
আপনার আর ইকি আপুর বই পাশাপাশিই ছিলো।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৮
129907
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : এমন পাঠক পাওয়া সত্যি দুষ্কর। সেই দিক থেকে মনে হয় আমি ভাগ্যবান। অনেক শুকরিয়া। আশার আগে ফোন দিলে অবশ্য দেখাও হয়ে যেত। প্রথম বসন্তের শুভেচ্ছা..Good Luck
176675
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:১৭
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ধন্যবাদ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৮
129908
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকেও শুভেচ্ছা....Good Luck
176676
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:১৮
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : ধন্যবাদ Rose
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৯
129910
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা প্রথম ফাল্গুনের...Good Luck
176831
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:৪৭
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : টিভির খবরে দেখলে মনে হয় লোকজন বই কেনার চেয়ে ঘুরে বেড়ায় বেশী। বাড়ির কাছের পরিচিত জায়গা। ছবির মাধ্যমে চলে যাওয়ার উপায় থাকলে এতক্ষনে চলে যেতাম।

ভালো লাগলো আপনার তথ্যসমৃদ্ধ পোস্টটি Good Luck Good Luck
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:০৫
130088
নোমান সাইফুল্লাহ লিখেছেন : বইমেলায় ঘোরার লোকই বেশী। এটাও ভালো। কারণ অন্ততঃ বইয়ের সাথে একটু হলেও ভালোবাসা তৈরী হচ্ছে। বইমেলাতে বড়দের চেয়ে দেখলাম ছোটদের বই বেশী বিক্রি হয়। বাবা মা নিজেরা না পড়লেও ছেলেমেয়েদের পড়াতে আগ্রহী।
লেখাটি পড়ার জন্য বিশেষ দিবসের ভালোবাসা রইল.....Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File