বিষাদ-বেদনা আর প্রত্যাশার ২০১৩
লিখেছেন লিখেছেন নোমান সাইফুল্লাহ ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৪:৩৬:০৯ বিকাল
ঘড়ির কাঁটার বিরামহীন শব্দের সাথে সবুজ জীবনের বিমুগ্ধ মুহুর্তগুলো ঝরে পড়ছে অবিরাম। দিনের আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে বয়সের সময় ক্রশশঃ ছোট থেকে ছোট হচ্ছে। ধুসর শহরে অস্থির রাজপথে হাঁটছি আর শেষ বিকেলের শীতের আমেজ মাখানো ঘুম ঘুম রোদের চাদর জড়িয়ে ভাবছিলাম, জীবনের রঙিন ডানার বাঁধন থেকে ঝরে গেলো আরো একটি বছর। কেমন ছিল ২০১৩ সাল? কোন হিশাবের অঙ্কে মেলাতে পারছি না। ব্লগ যেহেতু ব্যক্তিগত ডায়েরী। তাই ডায়েরীর পাতায় কিছু একান্ত অনুভূতি লিখছি। ব্লগ বন্ধুদের সাথে একাত্ম হওয়ার মাঝে এক ধরনের নির্ভার সুখ আছে। জমানো বিষাদগুলো ঝরে পড়লে জীবনের আকাশটা হয়তবা স্বচ্ছ নীল উচ্ছাসে হেসে উঠবে। ইংরেজীতে আনলাকি থার্টিন বলে একটা কথা আছে। যদিও ধর্ম বিশ্বাস এসবকে সমর্থন করে না। তবুও কেমন যেন আনলাকি একটি বছর শেষ হয়ে গেল।
জানুয়ারী-প্রথম উদ্দেপনাঃ
বছরের প্রথম সপ্তাহে অনেকগুলো প্লান এসে জমা হলো। অনেকগুলো প্রত্যাশার পান্ডুলিপি আকাংখার আলমিরায় সাজানো হলো। প্রথমতঃ নিজের অজ্ঞতাকে পরিপূর্ণ জানার কাছে নিয়ে যাওয়া। এই তালিকায় রয়েছে শিল্প, সাহিত্য এবং ধর্ম বিষয়। শিল্প নিয়ে পড়াশোনার শুরুতেই বাংলা ভাবদর্শন নিয়ে পড়াশোনা শরু করলাম। পছন্দের তালিকায় লালন সাঁই প্রথম পছন্দ ছিল। ভাবদর্শনের সাথে ধর্ম দর্শনের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। পড়তে গিয়ে ধর্ম, রাজনীতি ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এসে যোগ হলো। ইসলাম ও সম্পত্তি ধারণা পড়তে গিয়ে ইসলামী চিন্তাবীদদের ব্যাখ্যাগুলো কেমন যেন পশ্চিমা প্রভাবিত মনে হলো। তারপর ইসলাম ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে জানার খানিকটা প্রচেষ্টা ছিল। এসব জানুয়ারীর ২০১৩ সালের কথা। দেশের চলমান রাজনীতি তখন চরম অগ্নিগর্ভ। ঘরে কোন প্রকার ইসলামী বই রাখা জীবনের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি। তাই পড়াশোনায় ছেদ ঘটলো। এমনকি নিজের ঘরে থাকাও প্রচন্ড রিস্কি ছিল। তাই কিছুটা আড়ালে আবডালে থাকা।
ফেব্রুয়ারি-বিষণ্ন প্রহরঃ
ফেব্রুয়ারীতে সংঘাত আর সংঘর্ষের ভেতর হঠাৎ বাবা অসুস্থ হওয়ার সংবাদ পেলাম। ঢাকায় এনে ইবনে সিনাতে ভর্তি করা হলো। চিকিৎসকরা জানালেন তাঁর ক্যানসার হয়েছে। খুব বেশী দিন থাকবে না। তবুও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলছিল। আমার বাবা সারা জীবন শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সততার বিষয় তাঁর সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। হাসপাতালে তাঁর ছাত্র এবং শুভাকাংখিদের ভীড়ে নিজেকে খুব একটা অসহায় মনে হয়নি। এত মানুষের ভালোবাসা খুব কম মানুষেরই ভাগ্যে জোটে। সততার মূল্যটা এখানেই, মানুষের ভালোবাসা থাকে অকৃত্রিম অফুরন্ত। এখানে বলে রাখছি ব্লগার নূর নবী আমার বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন। এসময় অপারেশন আর থেরাপি চলছে।
মার্চ-দুঃসহ সময়ঃ
মার্চ ২০১৩। সারা দেশে জামাতের হরতাল চলছে। হরতালের দিন একান্ত জরুরী না হলে বাইরে বের হই না। বাসায় সকাল বেলা ঘুমাচ্ছিলাম। এমন সময় বাসায় পুলিশ আসলো। বিনা ওয়ারেন্টে বিনা অপরাধে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। সঙ্গে পুলিশ লুটপাট করে হাতিয়ে নিল নগদ টাকা। ন্যূনতম নাগরিক অধিকার মানবাধীকারও পুলিশ মানেনি। বাসায় আইনের কিছু বই ছিল। বাংলাদেশের সংবিধান আর আইনের বুকে লাথি মেরে পুলিশ ছিনিয়ে নিল নাগরিক অধিকার। দেখলাম আইনের বই দেখে পুলিশ তিরষ্কার করলো। এখানে বলে রাখি। এ বছর পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের মধ্যে অন্ততঃ ৮০% মানুষ ছিল নিরপরাধ। যাহোক এরপর শুরু হলো দুঃসহ কারা জীবন। চরম মানবাধিকার বিপন্ন একটা জীবন কাটালাম প্রায় চার মাস।
জুন-মুক্তি এবং বেদনাঃ
চার মাস পর জেল থেকে মুক্তি পেলাম। অনেক বড় করে একটা মুক্ত জীবনের শ্বাস নিলাম। মুক্ত জীবনের আনন্দ একমাত্র যারা কারাজীবন অতিবাহিত করেছে তারাই জানে। স্বাধীনতা মানে কি? এই বিষয়টা জানার জন্য জেল একটা কার্যকর জায়গা। যাহোক বাড়ি যাচ্ছিলাম খুব উচ্ছাস নিয়ে। বাড়ি যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানতে পারিনি, আমার পিতা ইন্তিকাল করেছেন। ফ্যাসীবাদী সরকার এর অত্যাচার নিপীড়নে বাবার জানাজায় অংশ নিতে পারিনি। এই ব্যর্থতা কোন শান্তনায় ভুলে যাবার নয়।
কৃতজ্ঞতাঃ
বাবার ইন্তিকালের পর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর সহ স্থানীয় ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ শোক ও সমদেবদনা জানিয়েছেন। সংগ্রাম পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে নিউজ ছাপা হয়। এছাড়া কারাগার থেকে বের হওয়ার পর, দেশের নানা প্রান্ত থেকে এবং বিদেশ থেকে শুভাকাংখি-বন্ধুরা সমবেদনা জানিয়েছেন। টুডে ব্লগে ব্লগার নূর নবীপোষ্ট লিখে সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছাড়া যে সকল ব্লগারবৃন্দ সমবেদনা জানিয়েছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আবার নতুন পথচলাঃ
অনেক ছন্দপতনের পর আবার নতুন করে পথ চলা শুরু। পড়াশোনা, চাকুরী, খানিকটা লেখালেখির মাঝে অন্য রকম একটা নতুন অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি নিয়ে নতুন করে নাগরিক জীবন যাপন শুরু হলো।
স্বপ্নেরা মরে যায় নাঃ
অনেক দুঃসহ বৈরী বাতাসের মাঝেও স্বপ্নরা মরে যায় না। সব সময় সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগায়। লেখালেখির সাথে অনেক দিন যুক্ত থাকলেও, এই বছরই প্রথম কবিতার বই প্রকাশনার কাজ হাতে নিয়েছি। আগামী ফেব্রুয়ারি একুশে বই মেলাতে প্রকাশ হবে আশা করছি। আনলাকি থার্টিন পুরোপুরি আনলাকি দিয়ে শেষ হয়নি।
দুঃখ-বিষাদ, হাসি-আনন্দ, ভালোবাসা এবং ঘৃণা, ভাঙা এবং গড়ার একটি অমোঘ নিয়মে চলে জীবন নদী। ভোরের নদীতে আবারও প্রত্যাশারা মাছের মত গড়াগড়ি খায়। হয়ত দুঃখ না থাকলে আনন্দ বোঝা যায় না, বেদনা না থাকলে ভালোবাসা বোঝা যায় না, রাত না থাকলে দিবস বোঝা যায় না। এইসব ঝরে যাওয়া দিনগুলোও একদিন অনেক দূর থেকে পিছু ডাকে। কেননা স্মৃতি মানেই পিছুটান। হোক সেটা ভালো আর মন্দ। সেই সব দিনের মাঝে শরীর ঘ্রাণ লেগে থাকে। পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে। কিছু ঝরে যাওয়া অশ্রুও শুকিয়ে যায় না। তবুও বিদায় জানালাম একটি বছরকে। আরো এক পা বাড়ালাম অনন্ত মৃত্যুর পথে।
বিষয়: বিবিধ
২৪৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন