ব্লাক মেইলিং ও রেপঃ একটি বাস্তব ঘটনা এবং এর প্রতিকার
লিখেছেন লিখেছেন নোমান সাইফুল্লাহ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৯:১৫:০৭ রাত
কেস ষ্টাডি এক.
এটি একটি সত্য ঘটনা। সমাজে নারীদের সচেতনতার জন্য এই ঘটনাটি লেখা হয়েছে। ঢাকা শহরের এক বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী নাজিয়া চৌধুরী। বয়স চল্লিশোর্ধ হলেও এখনো তিনি বেশ প্রানবন্ত এবং রুপ সচেতন। তার ছোট ভাই শোহান। শোহান একটি বেসরকারী চ্যানেলের রিপোর্টার হিশাবে চাকুরী রত। শোহানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলন মাহবুব। সে প্রায়ই বন্ধুর সাথে তার বড় বোন নাজিয়া চৌধুরীর বাড়িতে আসত। মিলন মাহবুব এর ঝোঁক সে একজন বড় ব্যবসায়ী হবে। এ ব্যাপারে বন্ধুর বোন নাজিয়া চৌধুরীর সাথে আলাপ করতো। এবং প্রায়ই অনুরোধ করতো, ব্যবসার একটি পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্য। নাজিয়া চৌধুরী স্বামীর ব্যবসা দেখভাল করেন বিধায় গার্মেন্ট ব্যবসা সম্পর্কে তার ভালো ধারনা আছে। ছোট ভাইয়ের বন্ধু মিলন মাহবুব এর প্রতিনিয়তঃ অনুরোধ শুনে, তার প্রতি একটা সহানুভূতি তৈরী হয়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন, বেকার ছেলেটিকে কিভাবে উপার্জনের রাস্তা তৈরী করে দেয়া যায়। যে ভাবা সে কাজ। একদিন স্বামীর গার্মেন্টের বেশ কিছু অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। এতে বেশ কিছু তৈরী পোষাক অবিক্রিত থেকে যায়।
তিনি ছোট ভাই এর বন্ধু মিলন মাহবুব কে ফোনে জানালেন, গার্মেন্টের এই সব পোষাক কম দামে কিনে বেশী দামে খোলা মার্কেটে বিক্রি করে তুমি লাভবান হতে পার।
কিন্তু মিলন মাহবুবের চিন্তায় ছিল অন্য কিছু। সে আগে থেকেই পরিকল্পনা তৈরী করে রাখে। তারপর যথাসময় নাজিয়া চৌধুরিকে বললো, ঠিক আপু চলো। কোথায় সেই পোশাক, আমি সবগুলো কিনে নেব। তারপর নাজিয়া চৌধুরী এবং মিলন মাহবুব এক সাথে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে সে এবং তার বন্ধুরা নাজিয়া চৌধুরীকে একটি নির্জন বাড়ী নিয়ে যায়। এবং পালাক্রমে ধর্ষন করে। ভিডিও চিত্র ধারণ করে। তারপর বলে, যদি তুমি কাউকে কিছু জানাও। তাহলে আমরা তোমার এই নগ্ন ভিডিওটি নেটে ছেড়ে দেব। এতে করে তুমি আর কোনদিন সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। এরপর থেকে যখনই মিলন মাহবুব এবং তার বন্ধুরা ফোন দিত। নাজিয়া চৌধুরী তাদের কাছে যেতে বাধ্য হত।
এদিকে নাজিয়া চৌধুরী মানসিকভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়েন। কাউকেই কিছু বলতে পারছেন না। পরিবারের সবাই জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে তোমার? তিনি বলেন- কিছুই হয়নি। ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ হয় না। তিনি দিন দিন মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন।
কেস ষ্টাডি দুই.
নাজিয়া চৌধুরীর এক মেয়ে আছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়েন। মিলন প্রায়ই বাসায় আসে এবং তার মেয়ে সুমাইয়ার সাথেও বিভিন্ন সময় আলাপ করতো। এসব দেখে তিনি মেয়ের সাথে প্রায়ই রাগারাগি করতেন। বলতেন, ওদের সাথে কথা বলো না। ওরা খুব খারাপ। মেয়ে তখন পাল্টা প্রশ্ন করতো, তাহলে তুমি কেন কথা বলো?
একদিন মিলন মাহবুব নাজিয়ার সাথে আলাপ করছিল। এমন সময় সুমাইয়া বলে, আম্মু আমাকে তোমার সাথে কথা বললে বকা দেয়। মাহবুব হাসে। বলে কেন বকা দেয় তা আমি জানি। সুমাইয়ার মনে কৌতুহল জাগে। বলে কেন বকা দেয় আমাকে একটু বলো। মাহবুব বললো, তোমার মা একজনের সাথে পরোকিয়া করে। মেয়ে তো আকাশ থেকে পড়লো। ভীষনভাবে তার কাছে আবদার করে, তুমি আমার মামা। প্লিজ আমাকে সত্য ঘটনা বলো।
তারপর মিলন মাহবুব জানালো, ঠিক আছে তুমি অমুক জায়গায় আসো। তোমাকে সব ঘটনা খুলে বলবো। কথামত সুমাইয়া ঐ জায়গায যায়। ঠিক তখন পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা মিলন এবং তার বন্ধুরা মিলে সুমাইয়াকে নির্জন বাড়ীতে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষন করে। এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করে। ঠিক একই কায়দায় ভয় দেখায়, যদি কাউকে বলো তাহলে প্রকাশ করে দিব। তারপর থেকে যখনই সুমাইয়াকে ফোন দেয়া হত। সে বাধ্য হত মিলন মাহবুব এর কাছে যেতে। এভাবে মা এবং মেয়ে যখন এই অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছিলো না, তখন গিয়ে পরিবারের কাছে জানালো। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হলো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আসামীরা সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
পর্যালোচনাঃ
যদি নাজিয়া চৌধুরী ঘটনা ঘটার পর পরই ফ্যামিলিকে জানাতেন, তাহলে তিনি এবং তার মেয়ে একই সাথে পাষবিকতার স্বীকার হতেন না।
কিছু দৃষ্টি ভঙ্গিঃ
=> প্রথমতঃ ধর্ষিতা নারী কোন অপরাধ করেননি। কেন তাকে সমাজ অবহেলার চোখে দেখবে?
=> যেকোন পাষবিকতার স্বীকার হলে সঙ্গে সঙ্গে গোপন করার প্রবনতা কেন? বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সাথে শেয়ার করতে হবে। তাহলে সেই অপরাধ আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
=> শালীনভাবে পোষাক এবং সামাজিকতা রক্ষা করা হলে এই ধরনের অত্যাচার অনেকাংশেই কমে আসবে।
ধর্ষনের শাস্তিঃ
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
১[ ১০৷ যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন তিন বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
সংশোধিত ৯উপধারা (৩) এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং এর অতিরিক্ত অনূ্যন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে।
দন্ডবিধির ৩৬৬ ধারায় বলা হয়েছে-
কোন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অপহরন প্রতারনা মূলক হরন ইত্যাদির মাধ্যমে যৌন সহবাস করতে বাধ্য করা হলে, যেকোন মেয়াদের শাস্তি যা দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
ব্ল্যাক মেইলিং এর প্রতিকারঃ
কোন নারীকে ভয় ভীতি প্রদর্শন, শালীনতার অমর্যাদার ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি অপরাধগুলোর বিচারের জন্য দণ্ডবিধির ৫০৩, ৫০৪, ৫০৫ (ক), ৫০৭, ৫০৮ ও ৫০৯ প্রযোজ্য। ফৌজদারি আইনে এতে মামলা করা যাবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে-
যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
আইনি সহয়তাঃ
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা
এই সংস্থার মাধ্যমে সরকারীভাবে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। লিগ্যাল এইডে সরকারীভাবে আইনজীবি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাতে করে সাধারন এবং দরিদ্র মানুষ, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন মানুষেরা আইনী অধিকার লাভ করতে পারেন।
এছাড়া বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠন বিনামূল্যে অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে আইনী সহায়তা প্রদান করে থাকেন।
ঠিকানা
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ,
কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুফিয়া কামাল ভবন, ১০/বি/১ সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০, ফোন -৭১৬৯৭০১,
ফ্যাক্স ৮৮-০২-৯৫৬৩৫২৯, ই-মেইল
ওয়েব- http://www.mahilaparishad.org
মহিলা আইনজীবী সমিতি,
৪৮/৩, মনিকো মিনা টাওয়ার,
পশ্চিম আঁগারগাঁও, ঢাকা, ফোন-৯১৪৩২৯৩
ওয়েব- http://www.bnwla.org.bd
আইন ও সালিশ কেন্দ্র,
৭/১৭, ব্লক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা
ফোন- ৮৮০-২-৮১২৬১৩৪, ৮১২৬১৩৭, ৮১২৬০৪৭
ফ্যাক্স ৮৮-০২-৮১২৬০৪৫,
ওয়েব- http://www.askbd.org/web
ই-মেইল
ব্লাস্ট,
১/১ পায়নিয়ার রোড/ ওয়াইএমসিএ,কাকরাইল, ঢাকা, ফোন-৮১৭১৮৫, ৯৩৪৯১২৬
বিষয়: বিবিধ
২৪০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন