গল্পঃ তবুও প্রতীক্ষায়
লিখেছেন লিখেছেন ইক্লিপ্স ১২ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৫১:৩১ রাত
কষ্টে কেন যেন মানুষ অভ্যস্থ হয় না। অভ্যস্থ হয় সুখে। তাই বহু আগের সুখের অভ্যাসগুলো এখনো নিপুর রয়ে গেছে। এখনো কষ্টে হাহাকার উঠে নিপুর মন। এখনো কষ্ট পেলে যেন পুরো পৃথিবী কেঁপে ঊঠে। পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। অথচ তার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। তার মত মা মরা মেয়ের ঠিক উল্টোটি হওয়ার কথা ছিল! মাথায় দুঃখের আকাশ ভেঙে পড়লেও সোজা দাঁড়িয়ে থাকবে। এক ফোটা জলও আসবে না তার দু চোখে । আর এটাই হবে তার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু না! সে দিন বাবার দুর্ব্যবহারেও ছিঁচকাঁদুনে মেয়েদের মত কয়েকঘন্টা ধরে কেঁদেছে সে! বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে এক রাত তাদের বাসায় থাকার অপরাধে তার মত যুবতি মেয়েকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছে তার বাবা! শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি। রাগের চোটে বাড়ির উঠোনের নিম গাছটা থেকে ডাল ভেঙ্গে এনে তাকে পিটিয়েছে!
ক্ষোভে লজ্জায় নিপুর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করেছে। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকেই বুঝিয়েছে এটাই তার ভাগ্য। তারমত মেয়েদের হাসতে নেই। এতটুকুন হাসলে তার কয়েক ডবল দুঃখ নেমে আসে তাদের জীবনে। বান্ধবীর বিয়ে আনন্দ একটু বেশিই করে ফেলেছিল। এখন তার মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর পৃথিবীতে আরো বহু মানুষ তার থেকে আরো অনেক বেশি কষ্টে আছে। তারাও তো বেঁচে আছে নাকি! সে তো অন্তত তাদের থেকে ভালো আছে। আর কালো বর্ণের মেয়েদের ধৈর্য শক্তি একটু বেশিই থাকতে হয়।
এদিকে নিপুর সাথে এমন আচরণের জন্য মেজো বোন মিনুও গলা উঁচিয়ে বাবাকে বকাবকি করেছে। হুমকি দিয়েছে এমন ঘটনা আর ঘটালে দুই বোন মিলে তাকে একা ফেলে যে দিকে দুই চোখ যায় হাঁটা দিবে। তখন কে দেখবে তার মতো বদমেজাজি বুড়োকে? বাবা শুনে দূরে বসে গজ গজ করেছে। কোন প্রতিবাদ করেনি। মেজো মেয়েকে সে দারুণ ভয় পায়। দুজনেরই রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না।
বাবা তখনকার মত চুপ হয়ে গেলেও নিপু জানে সে সহজে কোন কিছু ভুলে থাকে না। যতদিন না নতুন কোন ঘটনা ঘটে সে এই ঘটনা ভুলে না যাবে ততদিন সে সুযোগ পেলেই তাকে খোটা দিয়ে যাবে। সে দিন বিকেলে টিউশনি করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বাবা চিৎকার করে বলা শুরু করে দিয়েছে ,'' কি রে নিপু আজকেও কি বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে আটকে গিয়েছিলি? নাকি কোন ছেলে নিয়ে পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলি? সত্যি করে বলতো শুনি তুই কি ঐ রাতেও কোন ছেলের সাথে ছিলি? কি রে হারামজাদী চুপ করে আছিস কেন? আ ......রে এত বড় সাহস আবার ঘরের ভিতরে গিয়ে দরজায় খিল দেয়?''
বাবার চেঁচামেচিতে মেজো আপা মিনু রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠে ,''বাবা তুমি আবার চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিলা? মেয়েটা বাড়ি এসে শান্তিতে পা পর্যন্ত রাখতে পারল না আর তুমি পুরা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছো?'' বাবা হিসিয়ে উঠেন ,''মিনু তুই আমার কথায় নাক গলাবি না। নিজে তো লাফাঙ্গাকে বিয়ে করে কপাল পুড়িয়েছিস আর এখন নিপুটাকেও খারাপ বানাচ্ছিস!''
মিনু চিৎকার করে উঠে ,''বাবা তুমি আবার স্বামীকে লাফাঙ্গা বললা? কালকেই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। যে বাড়িতে আমার স্বামীর সম্মান হয় না ঐ বাড়িতে আর এক দিনও না।'' মিনু কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে যায়।
নিপু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এগুলো তাদের বাড়ির নিত্যদিনের ঘটনা। বাবা আর মেজো আপা ঝগড়া করে দুজনে মুখ গোমড়া করে নিজ নিজ ঘরে গিয়ে কপাট দিবে আর তাকে বাড়ির সব কাজ করতে হবে। অন্য দিন তার মেজো আপা রান্নাটা সেরে রাখে কিন্তু আজকে রান্নাটাও সারা হয়নি। তারমানে সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এখন তারই রান্না করতে হবে। কিন্তু ফ্লোরে পা দিতেই কোকিয়ে উঠে সে। সারা দিন রোদের মধ্যে হেঁটে পায়ে ঠোস পড়েছে তার। তবু ছোট কাপড়ের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে যায়। পায়ে হেঁটে রিকসার খরচ বাঁচিয়েছে। একদিনেই জমেছে পঞ্চাশ টাকা। এভাবে আর কয়েক দিন জমাতে হবে। তাহলে কিছু টাকা জমিয়ে বড় বোনের ছেলেটাকে জন্মদিনে কিছু কিনে দিতে দিবে। গতজন্মদিনে তাকে কিছুই দিতে পারেনি। তাই ছেলেটা গাল ফুলিয়ে বলেছে ,''খালামনি তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না। কখনো কিছু কিনে দাও না।'' আর তাছাড়া মেজো বোনের স্বামীও এক বছর পর বিদেশ থেকে আসবে। সে জন্যও বাড়িতে ভালো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে চায় সে। তারা না হয় ডাল আর ভর্তা দিয়ে খেয়ে দিনের পর দিন পার করে দিতে পারে কিন্তু দুলাইভাইয়ের জন্য তো ভালো কিছু রান্না করতে হবে। নয়ত তাদের বাড়ির দুর্নাম হবে। বোনটিকে তার খোটা শুনতে হবে ''তোমার বাবা বাড়ি জামাই আদরও করতে জানে না।''
তার বোনকে কোন কথা শুনতে হোক চায় না নিপু। এমনিতেই বোনটি তার অনেক দুঃখী। তারমত মিনুর গায়ের রঙও কালো। শ্যামা বর্ণও নয়, একদম যেন রাতের মত আঁধার কালো। কিন্তু দুলা ভাই একদম ধবধবে সাদা। প্রেমের বিয়ে তাদের। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন কালো বর্ণ বলে তার বোনকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেনি। উঠতে বসতে শ্বাশুড়ি তাকে খোটা শোনাতো ,'' এই কালা মাইয়া আমার পোলাডারে তাবিজ কইরা বিয়া করছে। কত স্বপ্ন ছিল চান্দের মত বঊ আনুম পোলার জন্য। কিন্তু এইটা কি বিয়া কইরা আনলো! এ তো পাতিলের তলার কালি!''
মিনু শুনে চুপচাপ চোখের জল ফেলতো আর স্বামী শাহেদের দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকতো। অসহায় চোখে তার জিজ্ঞাসা ,'' আমি কি তোমাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছি? নাকি তুমি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছো? তোমার মায়ের কথার প্রতিবাদ কেন করছো না!'' মিনুর স্বামী যেন বোবা হয়ে গেছে। তার বিয়ের আগের সব উৎসাহ উদ্দীপনা যেন শেষ হয়ে গেছে। দিনের পর দিন মিনু ঐ বাড়িতে শত নোংড়ার কথার কষাঘাতের পরও পরে রইত স্বামীর মুখে দিকে চেয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর স্বামী চাকরীর কথা বলে চলে যায় বিদেশ। তাকে বলে যায় বিদেশ থেকে ফিরে তাকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠবে। নতুন করে সংসার বাঁধবে সেখানে। আর বিদেশ যাচ্ছে তো এত ভাবার কি আছে! সপ্তাহে অন্তত একবার তাকে ফোন করবে সে।
বিদেশ গিয়ে স্বামী নিয়মিত যোগাযোগ করলেও শ্বশুরবাড়িতে থাকা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার কাছে শ্বাশুড়ির খোঁচা দেয়া কথা অসহ্য লাগতে থাকে। একদিন অতিষ্ট হয়ে সেও দুটো কথা শুনিয়ে দেয় শ্বাশুড়িকে।ওমনি শ্বাশুড়ির বাড়ির মাথায় তুলে কান্নাকাটি ,''পোলা আমার কোন দিন মুখের উপর কথা কয় নাই। আর পোলার বউ মুখে মুখে তর্ক করে! এই ছিল আমার কপালে!'' তারপর সে গোছাগাছ করে চলে আসে বাপের বাড়িতে।
একদিন নিপু তাকে জিজ্ঞাসা করে ,''আপা, দুলাভাই যদি আর ফেরত না আসে তুই কি খুব কষ্ট পাবি?'' মিনু ধমক দিয়ে বলে,'' তোর দুলাভাই ওমন লোকই না নিপু। পাড়ার লোকের কথা কান দিস না। ওরা তো বলেছিল আমার মত কালো মেয়েকে কেউ কোনদিন বউ করে ঘরেই তুলবে না! দেখেছিস কত সুন্দর স্বামী পেয়েছি আমি? তুইও সুন্দর স্বামী পাবি নিপু। কালো মেয়েদের স্বামী সুন্দর হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য।'' নিপুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সুখের স্বপ্নগুলো তার কাছে দুঃস্বপ্ন মনে হয়। কিছুদিন আগে একছেলে তাকে দেখতে এসে তার বান্ধবীকে পছন্দ করে গেছে। লজ্জায় অভিমানে সে দুদিন দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে। পরে আবার তাদের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে বান্ধবীর বাড়ি এক রাত থেকেও এসেছে সে। তার সব চেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা! সে না থাকলে কি চলে! আর এই নিয়ে তার বাবা পুরো বাড়িতে কি তুলকালাম কান্ডই না বাঁধিয়েছিল।
অবশেষে তার দুলাভাইয়ের বিদেশ থেকে ফেরার দিন নির্দিষ্ট হয়। আর নিপুর মনের শংকা কেটে যায়। নাহ তার দুলাভাই ফিরে আসছে। তার দুলাইভাই অন্যদের মত নয়। নিপু তার জমানো টাকা নিয়ে বাজার করতে যায়। পোলাউয়ের চাল, বড় দেখে কয়েকটা মুরগী আর ফলমূল কিনে আনে। বড় আপাকেও দাওয়াত করেছে সে। মেজো দুলাভাইয়ের ফেরা উপলক্ষ্যে বাসায় ছোটখাট অনুষ্ঠান করতে চায়। বহুদিন পর উৎসবের আমেজে ভরে যায় নিপুর মন। কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে তার। বাজারগুলো হাতে নিয়ে হেঁটে চলেছে তারমনে হচ্ছে যেন উড়ে চলেছে।
কিন্তু তার এই খুশি বহুক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাড়ি ফিরে দেখে মিনু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার গলা থেকে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ বেড়োচ্ছে। গলায় চিকন ফুলা দাগ দগদগে হয়ে আছে। মিনু গলায় দড়ি দিতে চেয়েছিল। একটা চিঠি এসেছে তার নামে ,''মিনু আমি মায়ের পছন্দে আবার বিয়ে করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। ইতি শাহেদ''। দূরে বসে মিনুর বাবা গজগজ করছে ,''আমি ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু জানোয়ারটার! ওর নামে নারী নির্যাতন মামলায় কেইস দিমু।''
নিপুর দিকে চোখ পড়তেই ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে মিনু ,'' নিপু বাবার কথায় কান দিস না। বাহিরের দরজাটা খোলা রাখিস। তোর দুলাইভাই এই এল বলে!'' মিনুর ঠোটে উম্মাদের হাসি।
বিষয়: বিবিধ
১৯৪৫ বার পঠিত, ৫৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গল্পের হাত ভালো। চালাতে থাকুন আর নিয়মিত হউন। তয় বুইড়া চাচা ভালো?
আর আমি তো নিয়মিতই। তবে কোন বুইড়া চাচার খোঁজ আমার জানা নেই।
শুভেচ্ছা জানবেন।
লেখাটা সুন্দর হয়েছে।
এবারের বইমেলায় আপনার কোন বই আসবে নাকি? ?
বইমেলায় বই আসবে কিনা নিশ্চিত নই। এক উপন্যাস মেলার জন্য রেডি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লেখা এগোচ্ছে না।
সুন্দর থাকুন।
সুন্দর থাকুন।
গল্প কিন্তু দারুন হয়েছে।
ভালো থাকুন।
ভালো থাকুন।
আপনার মন্তব্য সব সময়ই অনুপ্রেরণা দেয়।
আমার একটা প্রশ্ন খুবই জানতে ইচ্ছে হয় অধিকাংশ শাশুড়িদের আল্লাহ্ কি দিয়ে বানিয়েছেন !
শালা গান্ডু ফর্সা ছেলেটা কি গায়ের রং ধুয়ে পানি খাবে !
সত্যি লেখাটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল ।
আসলে প্রতিহিংসা মানুষকে কতটা নিচে নামিয়ে দেয় তার খোঁজ বেশির ভাগ সময়ই মানুষের কাছ থাকে না। কিছু শাশুড়ি/বউ তাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
ধন্যবাদ লেখটির পড়ে আন্তরিক মন্তব্যের জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন