যেমন গেলো আমার শুভনববর্ষ!
লিখেছেন লিখেছেন ইক্লিপ্স ১৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:০৪:৩৩ দুপুর
কয়েকদিন ধরেই ইচ্ছে হচ্ছিল একটু গ্রামের দিক ঘুরতে যাবো। নববর্ষের দিন সকালে পেয়ে গেলাম সুযোগ। হোস্টেলে খালা(বুয়া) আসে নি। তাই রান্না হবে না। আমি আর আমার রুমমেট ঠিক করলাম আজ সকাল, দুপুর বাহিরে খাবো। মাঝের সময়টুকু ছায়া সুনিবিড় পথ ধরে ঘুরে বেড়াবো। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে রেডি হয়ে দু জনে হোস্টেল ছাড়লাম। প্রথমে একটি রেস্টুরেন্টে নান আর খাসির মাংস খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমাদের হোস্টেলে কাছাকাছি কোন গ্রাম ভ্রমনের উদ্দেশ্যে। রিকশা নিয়েই ঘোরা যেতো কিন্তু চারিদিকে তিব্র রোদ আর আঠালো রকমের ভ্যাপসা গরম। অন্য দিকে গ্রামের পথে মাঝে মাঝে আসে লক্কড়ঝক্কড় রাস্তা। এখানে রিক্সার স্পিড তো থাকেই না তার উপর হাড়গোড় নড়ে যাবার জোগার হয়। সাত পাঁচ ভেবে আমরা দুই জন একটা সি এন জি নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। যেদিক বৈশাখীমেলা এবং মানুষের কোলাহল গেলাম ঠিক তার উল্টো দিকে। হাইওয়ে খালি দেখে সি এন জি ড্রাইভার খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কয়েকবার তাকে অনুরোধ করে স্পিড কমাতে বললাম।
কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম এক জায়গায় কিছু লোকের জটলা। একটা ছোট ছাউনি দিয়ে ঘেরা কুড়ে ঘরের সামনে ৪-৫জন মিলে একজন বয়স্ক গরীব লোককে ধরে পিটাতে পিটাতে মাটি শুইয়ে ফেলেছে। দূরে একজন মহিলাকে আবার কয়েকজন লোক জোর করে ঠেসে ধরে রেখেছে। দুই তিন জন মিলে ভিকটিম লোকটির কুড়ে ঘরের বাঁশগুলো দা দিয়ে কেটে দিচ্ছে! বুঝলাম তার ছোট ঘরখানি কারো চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। নিজের অজান্তেই চোখ ছলছলিয়ে উঠল। সাথে সাথে আনমনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম আমার পরনে যেই জামা তার দাম কমপক্ষে পাঁচহাজার টাকা হবে ভেবে। পুঁজিবাদি সমাজের ভোগবাদি মানুষগুলোর দলে নিজের অজান্তেই নিজেকে ফেলে দিয়েছে বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। আর যেই লোকটির ঘর ভাঙা হচ্ছে তা বানাতে হয়ত এরকমই টাকা লেগেছে! হয়ত অনেক কষ্টে সারা দিন মুজুরী খাটার পর একটু একটু করে টাকা সঞ্চিত করে তিনি দশ বারোটি বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছিলেন তার ছোটঘরখানি। যা গ্রামেরই কিছু লোক চোখের পলকেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে!
তারা কি একবার ভেবে দেখেছে যে এই সব কোলহে আল্টিমেটলি নিজেদেরই ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের মত গরীব দেশের লোক জন আরো গরীব হচ্ছে। কবে যে এদের এই ধ্বংসাত্মক মানসিকতার পরিবর্তন হবে! আমাদের দেশের লোকদের বহু পুরাতন অভ্যাস কিছু হলেই তারা নিজেদের সম্পদ বিনষ্ট করে। অথচ এই সম্পদ যদি ঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতো তবে হয়ত দেশ জুড়ে এত দারিদ্র্যতা থাকতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এরা সামান্য ঝগড়া হলেই রক্তক্ষয়ী মারামারীতে মেতে ওঠে। আমাদের যখন সার্জারি ওয়ার্ড চলছিল তখন দেখেছি প্রায় রাতেই ওটিতে এ রকম মারামারি করে আসা রোগীদের কাটা শরীরের চিকিৎসা দেয়া হয়। মানুষজন ডাক্তারদের বলে কষাই। তাহলে যারা এভাবে একজন আরেকজনকে মেরে বীভৎস রকম যখম করে একেকজনের শরীর ফেরে ফেলে তারা কি? ডাক্তাররা তো সেই শরীর সেলাই করে, টিস্যু গ্রাফটিং করে সব বীভৎসতা ঢেকে একজন মানুষকে অন্তত দেখার উপযুক্ত করে যাকে দেখে তখন অন্য মানুষেরা ভয়ে শিউরে উঠতো!
যা হোক কিছু দূর যেতে না যেতেই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে আগের ঘটনাটির রেশ মাথা থেকে কেটে গেলো। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটলো আরেকটি এক্সিডেন্ট! এবারের ভিক্টিম আমরা! একটি মোটরসাইকেল তিব্র স্পিডে দেখলাম আমাদের সি এন জি র দিকে ধেয়ে আসছে। ড্রাইভারের আর কিছুই করার ছিল না। হঠাৎ তিব্র ঝাঁকিতে সি এন জি থেমে গেলো। দেখলাম সি এন জি'র মাঝের পার্টিশনটি ভোঁতা হয়ে গেছে। আমার বা পা টা ব্যাথায় চিনচিন করছে। সাথে মনে হচ্ছিল মুখের সামনের পাটির একটি দাঁত পড়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কিছুই হল না। শুধু একটু ব্যাথা পেয়েছি। আমি সি এন জি র থেকে নেমে পড়লাম। দেখলাম হালকা খোড়াচ্ছি। আমার চোখ খুঁজছিল মোটরসাইকেলের আরোহীকে। কারণ এমন এক্সিডেন্টে মারা পড়ার কথা!
দূরে দেখলাম একটি দামি মোটর সাইকেলের বডি পড়ে আছে। তার সামনের অংশ ভেঙ্গে আরো কিছু দুরত্বে পড়ে আছে। একটি অল্প বয়সী ছেলেকে দেখলাম রাস্তার উপর হাটু ভাঁজ করে বসে আছে। পরিধেয় পেন্ট হাটুর কাছ থেকে ভাঁজ ভাঁজ হয়ে ছেরা। তার কতটুকু যখম হয়েছে দেখতে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করতে চেষ্টা করছিলাম কোন রক্তপাত দেখা যাচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার নিজের চোখও আপনাআপনি জলে ঝাপসা। সেভাবে খেয়াল করতে পারলাম না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো কাছে গিয়ে অন্তত একটু পরীক্ষা করে দেখি। হয়ত তেমন কোন সাহায্যই করতে পারবো না, তবুও একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে যতটুকু পারি। যা হোক বাংলাদেশে রাস্তায় রোগী দেখার ব্যাপারে একবার এক স্যার আমাদের কঠোরভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ডাক্তার হয়ে গেলে রাস্তায় কখনো রোগী দেখবে না। কারণ আমাদের দেশের মানুষ বেশির ভাগ সময়ই অবিবেচক। বেশির ভাগ সময়ই তারা বুঝতে চায় না জীবন মৃত্যুর ব্যপারে ডাক্তারদের কোন হাত নেই। তারা জাস্ট সহায়ক। অনেক সময় ডাক্তারদের কোন দোষ না থাকলেও তাদেরকে হেনস্তা করা হয়। আমাদের সেই স্যারকে একবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো পানিতে ডোবা রোগী দেখতে। কিন্তু তিনি পৌঁছানোর আগেই রোগী এক্সপায়ার করেছিলেন। তবুও স্যার ডেড বডিতে মাউথ টু মাউথ ব্রেদিং দিয়েছিলেন। সেটা ছিল জাস্ট রোগীর ইমোশনাল আত্মীয়স্বজনদের জন্য সান্ত্বনা আর স্যারের পিঠ বাঁচানো। এই হল আমাদের দেশের পরিস্থিতি!
কিন্তু এদিকে শুনলাম আমার রুমমেটের ব্যাথায় গোঙানি। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন গ্রাম বাসির সহায়তায় সে দাঁড়িয়ে আছে। আমার যেহেতু তেমন কিছুই হয়নি আমি ভেবেছিলাম সেও ভালো আছে। কিন্তু সি এন জি'র দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম সে যেদিকে বসেছিল সে দিক বেশ ভালোভাবেই থেথলে গেছে। এবার আমি নিজেই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম সে না জানি কতটুকু যখম হয়েছে! তার হাতের কুনুইয়ের কাছে জামা কিছুটা রক্তে ভিজে উঠেছে। হাটুতে জামার উপর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রক্তের দাগ। এমন সময় অন্য একটা সি এন জি এসে দাঁড়ালো আমাদের পাশে। তাতে ছিল একজন মাঝ বয়সী লোক। সে আমাদের সি এন জি র পেছনে তুলে দিয়ে নিজে বসলো সামনে ড্রাইভারের পাশে। রাস্তায় দেখলাম আমার রুমমেট বেশ অস্থির! ভাবছিলাম সে এমন করছে কেন! মাথায় বড় কোন আঘাত পেলো না তো! অনেক সময় মাথায় আঘাত লাগলে মাথার ভেতরে রক্তপাত হয় যা বাহির থেকে দেখা যায় না। এতে মানুষ ইন্টারনাল হেমোরেজ হয়ে মারাও পড়তে পারে। তার এমন কিছু হয় তো! কপালেও দেখা যাচ্ছে সামান্য ছিলে গেছে। সেখান থেকে চিকন রক্তের রেখা। সে বার বার ঠান্ডা পানি খেতে চাইছিল। তাই ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটি সি এন জি থামিয়ে তাকে সেভেন আপ কিনে দেয়। তারপর তিনি আমাদের মেডিকেলের হসপিতালের কিছু আগে নেমে যান। তার সেভেন আপের দামও আমাদের পরিশোধ করা হয় নি। আল্লাহ তাকে এই সাহায্যের উত্তম প্রতিদান দিন।
আমি আগেই আমার বান্ধবীদের ফোন করে রেখেছিলাম- এক্সিডেন্ট করেছি তোরা হাসপাতালে থাকিস। ওরা গেট থেকেই আমাদের রিসিভ করে। স্যার দেখে জানালেন তেমন কিছুই হয়নি। তবুও রুমমেটকে কিছুক্ষণের জন্য কেবিনে ভর্তি করে দিয়ে এলাম যে আরো সিনিওর স্যার এসে এক সময় পরীক্ষা করে দেখবেন।
দুপুরে ফ্রেন্ডদের সাথে খেয়ে রুমে ফিরলাম। মনে মনে আল্লাহ দরবারে হাজার শুকরিয়া 'প্রভু তুমি অল্পতেই বাঁচিয়ে দিয়েছো।' আরো বড় কোন অঘটন ঘটতে পারতো! সাথে সাথে সেই রাস্তার ছেলেটির জন্যও মনে মনে দোয়া করছিলাম। প্রভু তাকেও বাঁচিয়ে রেখো। ভালো রেখো। সে যেন এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে এভাবে অনিয়ন্ত্রিত স্পিডে গাড়ি চালানো কত বড় বিপদে মানুষকে ফেলে দিতে পারে! সন্ধ্যায় রুমমেট ফিরে এলো। সবার সাথে হাস্যরসে মেতে উঠলাম। এভাবেই পার হয়ে গেলো আমার শুভনববর্ষ!
বিষয়: বিবিধ
২৪০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন