স্মৃতিতে বশির আহমেদ (ভিডিওসহ )
লিখেছেন লিখেছেন তারেক ২০ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:২২:৪৮ দুপুর
দরজা খুলে দিয়ে হাত বাড়ালেন তিনি । বললেন- আসো, ভেতরে। 'তুমি' করে বল্লাম, কিছু মনে করলে না তো। হেসে বল্লাম- 'আপনি' বললেই অস্বস্তি হতো। হাসতে হাসতে বললো- ইয়াংম্যান , পড়া শোনা কি চলছে, না শেষ। বল্লাম চলছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে ঘরে ডেকে নিয়ে বসিয়ে সঙ্গীতের আলাপ জুড়লেন। ডাকলে দুই সন্তান হোমায়রা ও রাজা বশিরকে। তিনি প্রিয় শিল্পী বশির আহমেদ। আমার কাঁচা হাতে লেখনীর প্রথম দিকের ঘটনা।
২০০১ সালের শুরুর দিকে। মোহাম্মদপুরের বাস স্ট্যান্ড থেকে রিকশায় সরাসরি বশির আহমেদের বাসা। সে সময় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গীতের আলাপন অনুষ্ঠানে যেতাম। সে কারণে সঙ্গীতের কিছু বেসিক বিষয়ে ধারণা ছিল। তাই আলাপটা জমে উঠছিল। বশির আহমেদ বললেন, এই যুগেও ঠুমরি, দাদরা নিয়ে কথা- এ শুনে আমার অবাক লাগছে। আজকাল তো সাংবাদিকরা পপুলার শিল্পীদের নিয়ে কথা বলেন, বেশি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কথা তুললে নাক শিটকায়, সবাই। অথচ এই ভাটি বাংলা কিন্তু সঙ্গীতের অসাধারণ জায়গা। আমাদের অনেক দূর যাবার কথা ছিল। পারিনি। এ জন্য আমরাই দায়ি! প্রিয়মুখ- বিনোদন পত্রিকাটির রিপোর্টার হিসাবেই আমার তার বাসায় যাওয়া। সে সময় তার সম্পর্কে ব্যাপক ভিত্তিক কোনো ধারণা আমার ছিল না।
বাসায় ঢুকলেই এক সঙ্গীতময় পরিবেশ। হারমোনিয়াম, তানপুরা, ঢোল, তবলা, গিটার- অনেক রকমের বাদ্য যন্ত্র। বাসায় স্ত্রী মিনা বশির ছিলেন না। ছেলে রাজা ও মেয়ে হোমায়রার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রাজার ব্যস্তা ছিল, কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে চলে গেলেন। বশির আহমেদ জানালেন- সন্তানদের আসলে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন। একদিকে প্রথাগত শিক্ষা আরেক দিকে সঙ্গীত। সঙ্গীতই তাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হবে তা কিন্তু নয়। তারা সঙ্গীত চর্চা করবে-শুদ্ধ সঙ্গীতের ধারা বয়ে বেড়ানোর জন্য। কলকাতায় বেড়ে ওঠার গল্প শোনালেন। জানালেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলীর সঙ্গ পাওয়ার কথা। বললেন সঙ্গীত মনের প্রশান্তি আনে। জনপ্রিয়তা অর্জনের চেয়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসারে কাজ করেছেন বড়ে গোলাম আলীরা।
বশীর আহমেদ ও হোমায়রা বশিরের সাথে অনেকক্ষন আড্ডা হলো। বশীর আহমেদের বেড়ে ওঠা, সঙ্গীতের নানা দিক, রাগ ঘরানার সঙ্গীত চর্চা বিষয়ে চলমান সময়ের শিল্পীদের অনীহা, রাতারাতি তারকা হওয়ার ধান্ধা, কম জানা লোকের সঙ্গীত পরিচালনা- এ সব বিষয় জানতে পারলাম। হোমায়রা নামটা সে সময় আমার প্রথম শোনা। তাই দুবার আমাকে এটি কতার বলতে হয়েছে। নামের অর্থটাও তিনি বলেছিলেন। এখন মনে পড়ছে না। রাজার গল্পও করলেন। অনেক্ষণ ধরে আলাপ-আপ্যায়ন। বশির আহমেদ সম্পর্কে হোমায়রার কাছে আরো অনেক জানা হলো। বিশেষ করে 'অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন ছিঁড়ে যায়'- গানটি নিয়ে বশীর আহমেদের উচ্ছ্বাস আমাকে মুগ্ধ করলো। একজন শিল্পীই বলতে পারেন তার কোন গানটি আসলেই গান হয়ে উঠে। বশীর আহমদে খুবই আত্ম বিশ্বাসী শিল্পী।
হোমায়রা জানালেন ভারতের খ্যাতিমান শিল্পীরা বশির আহমেদকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন। ভালোবাসতেন। পরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এক আড্ডায় জেনেছিলাম- 'আয় খুকু আয়' গানটি বাংলা সিনেমার জন্য গেয়েছিলেন হেমন্ত বাবু। তার কাছে সিনেমার গানটি গাওয়ার অফার নিয়ে গেলে হেমন্ত বাবু বলেছিলেন, যে দেশে বশির আছে, সে দেশে আমাকে কেনো ডাকছো তোমরা। তবে শেষ পর্যন্ত হেমন্ত বাবু গানটি গেয়েছিলেন। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে প্রেমময় বাংলা গানের শ্রোতােদের মাতিয়ে রেখেছে বলেই হোমায়রা জানিয়েছেন। সে সময়টাতে আসলে এত জনপ্রিয় গান নিয়ে আমার ভাবনা ছিল না। মূলত ব্যান্ড গানের প্রতি আমার টান ছিল প্রচণ্ড। সে কারণে এ সব গান আমার কানে নতুন মনে হচ্ছিলো। বাসায় ফিরে পুরনো রেকর্ড নিযে বসেছিলাম। শুনছিলাম তার গান। সম্ভবত তার বাসা থেকে ফেরার পর সঙ্গীতা বা সাউন্ডটেকের পাটুয়াটুলির হেড অফিস থেকে হোমায়রা ও বশির আহমেদের গানের ক্যাসেট পেয়েছিলাম।
সেখান থেকে অন্য রকম এক বশির আহমেদকে আবিষ্কার করি। হোমায়রাকে নিয়ে আমার কয়েকটি রিপোর্ট ছিল- প্রিয়মুখে। একটা ইন্সেটারভিউও ছাপা হয়েছিল। সব রিপোর্ট তার ভালো লেগেছিল তা কিন্তু নয়। তবে খারাপ লাগেনি বলে তার 'রহমান রহমান হকে' সিএ কোর্সের সহপাঠি শফিক ভাই মারফত জেনেছিলাম। শফিক ভাই তার বিষয়ে আমাকে বিভিন্ন বিষয় জানাতেন। অনেক আড্ডার পর ফিরে বশির আমহেদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। বশির আহমেদ ও মেয়ে হোমায়রা বশির আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বললেন, শুধু রিপোর্ট না, এমনিতেই সময় পেলে চলে এসা। আড্ডা হবে। তোমরা তরুণরাই কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিবে।
আমি অন্তত তাই মনে করি। ভালো থেকো। পরে মাঝে মধ্যেই তাকে বাসার ফোনে কল করতাম। বছর দেড়েক পরে সংস্কৃতি বিষয়ক রিপোর্ট লেখালেখি বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসাবে কাজ শুরু করলে যোগাযোগটা থেমে যায়। কিন্তু বশীর আহমেদ- নামটা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো তিনি সব সময় গান নিয়েই আছেন। সংস্কৃতি কর্মীর নামে রাজনীতির জোয়ারে ভাসতেন না। বলতেন সঙ্গীতই তার জীবনের অভীষ্ট। এটা নিয়েই তার জীবন কাটুক, সেটিই তার প্রত্যাশা। এর মধ্যে আজ সকালে যখন বশির আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পড়লাম-খুব মন খারাপ হলো। খুব। পরকালে আপনি শান্তিতে থাকুন। আপনার সঙ্গীতের সাথে আমাদের বাঁধন থাকবেই।
আল্লাহ এই দেশ তোমারি দান, আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।
আল্লাহ
আল্লাহ!
এই দেশ তোমারই দান
কৃতজ্ঞ আমরা তোমার কাছে
রেখো আমাদের মান।।
পাখীদের গুঞ্জন
শিশুদের কল্লোল
সূর্যের দীপ্তি
ফুল শাখে হিল্লোল
কোকিলের কুহু কুহু তান
এই সব তোমারই দান।।
বাতাসের সৌরভ
আকাশের নীলিমা
সবুজের গৌরব
আবিরের লালিমা
নদীনীর ঐ তান
এই সব তোমারই দান।।
বিষয়: বিবিধ
২৩৩৫ বার পঠিত, ৬৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোষ্ট ষ্টিকি কয়রে দিন মডু ভাই
আল্লাহ তার ভালো কাজের জন্য উত্তম যাজা দিন
সুবিধা বঞ্চিত গানের পাগল এসব জাত শিল্পীরা এভাবেই দেশ জাতিকে দিয়ে যায় তাদের কঠোর পরিশ্রমে গড়া সাংস্কৃতিক ভুবন। বশীর আহমেদের কন্ঠ গান আর অবিব্যক্তি এক সুরে গাথা। পয়সার জন্য এরা গাইতেন না। তাই এদেরকে কেউ কিনতে পারতোনা। ক্ষণজম্মা এসব মানুষগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতির উজ্জল নক্ষত্র। এদের গাওয়া গানের সুর আজীবন আমাদের কানে বাজবে। তাঁর কন্ঠে সুরের যাদুই অন্যরকম।
ধন্যবাদ এ মহান শিল্পীকে নিয়ে আপনার ম্মৃতিচারণের জন্য। অনুভুতিতে আঘাত লাগার জন্য এতটুকুই যথেস্ট।
ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না'ইলাহে'রাজেউন । আমরা শোকাহত । আপনার পোস্টএর মাধ্যমে তাহার পরিবারের সবার প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি ।
অনেক ধন্যবাদ
সে কথা তুমি যদি জানতে...
অসাধারণ এক শিল্পীকে হারালো সুস্থ্য সংস্কৃতি! অনেক অন্নেক দোয়া রইলো মরহুমের জন্য! মহান রাব্বুল আ'লামীন তাঁকে তাঁর মাগফিরাত দিয়ে ধন্য করুন, ক্ষমা করে দিন, জান্নাত দান করুন, আমীন...
এটার উনার গাওয়া গান, জানতাম না/ আল্লাহ উনাকে জান্নাত দিক
আল্লাহ তার ভালো কাজের জন্য উত্তম যাজা দিন
“অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়,
মিছে তারে শিকল দিলাম রাঙা দুটি পায়।........”
কিংবা
“ডেকোনা আমারে তুমি কাছে ডেকোনা,
দূরে আছি সেই ভালো নিয়ে বেদনা......”
“যারে যাবি যদি যা, যারে যাবি যদি যা,
পিঞ্জর খুলে দিয়েছি, যা কিছু কথা ছিল বলে দিয়েছি.....”
হৃদয়ে হাহাকার তোলা এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের অমর শিল্পী বশির আহমেদ।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন মরহুমকে ক্ষমা করে দেন।
এটা মনে হয় ভাইজান মাহমুদুন্নবী গেয়েছেন
আল্লাহ আপনাকে হায়াতে তইয়াবা দান করুক , অন্তত আমাদের ব্লগের জন্য
দেখাইতাম তোমারে প্রিয়,
দেইখতাম পাইত্তাম কত,
এই গানটি এখনও কানে বাজে, তিনি বহু বড় গুনিজন আছিল। জানিনা হেই গুনের কদর ঐ জগতে আছে কিনা।
ওনার তো লম্বা লম্বা পাগলা জেম্সের চুল নেই,
ফাটা চেড়া তালি জোড়া পেন্ট পড়েনা,
"হই হই লই লই ধরি আচাড় মার " নামক গান গাইনাই,
তার সু কর্মের বিনিময়ে তার আত্মা ষুখী হউক এই দোয়া করি।
বাংলাদেশে একসময় এই ধরনের সুন্দর গানগুলি হিট হতো এবং সিনেমাতেও ব্যবহত হত। কিন্ত তার মত শিল্পিরা এখন আর মিডিয়ার ছায়ায় নাই।
‘অনেক সাধের ময়না আমার...’ গানটি আমার খুব প্রিয়।
মহান রাব্বুল আলামিন উনাকে বেহেশত নসীব করুন । (আমীন)
আমরা হয়তো বশির আহমেদ কে পাবো না , কিন্তু আমরা সবাই মিলে হয়তো উনার স্মৃতি টুকু ধরে রাখতে পারি ।
নিয়তি কে মেনে নিতে হয় , কিন্তু কিছু নিয়তি মানতে খুব কষ্ট হয় । হয়তো বশির আহমেদ এই রকমই একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন ।
হে আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করো, আমিন
ধিক এই দালাল মিডিয়া গুলোকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন