কারো বিপদে সমবেদনা জানানো – ইমাম আযযাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)
লিখেছেন লিখেছেন সূর্যের আলো ১২ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:২৩:১২ রাত
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন বিপদগ্রস্তের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে, তাহলে স্বয়ং ঐ বিপন্ন ব্যক্তি সবর করলে যে সওয়াব পায়, সেও অনুরূপ সওয়াব পাবে”। (তিরমিযী)
হযরত আবু বুরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে বলেছেন, “সন্তানহারা মায়ের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন ও সান্ত্বনা দান করলে আল্লাহ জান্নাতের মূল্যবান পোশাক পরিধান করাবেন”। (তিরিমিযী)
হযরত ওমর ইবন হাযম রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘মুমিন তার কোন ভাইয়ের বিপদের সময় সহানুভূতি জানায়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সম্মানজনক জান্নাতী পোশাক পরিধান করাবেন’। (ইবনে মাজাহ)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, ‘তোমাকে কোন বস্তু তোমার ঘর থেকে বের করেছে। তিনি বললেন, আমি এক মৃতের আত্মীয়-স্বজনকে সান্ত্বনা জানাতে গিয়েছিলাম। (আবু দাউদ, নাসায়ী) (এখানে সান্ত্বনা দেয়ার অর্থ সবরের পরামর্শ দেয়া। তাই তা দাফনের পূর্বে বা পরে উভয় অবস্থাতে দেয়া মুস্তাহাব।) ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুমুল্লাহ এর মতে, মৃত্যুর পর থেকে দাফনের পর তিন দিন পর্যন্ত শোক প্রকাশ করা মুস্তাহাব। অন্যান্য ইমামদের মতে তিন দিন পর তাযিয়া করা মাকরূহ। কেননা , এতে তার বেদনার কথা জাগ্রত হয়।
ইমাম নববী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, শুধু দুটি অবস্থাতে তিন দিন পর তা করা যায়।
এক- তিন দিন পর্যন্ত সে অনুপস্থিত থাকলে।
দুই- তিন দিন পর তার সাক্ষাৎ পেলে সবাই একত্রে শোক প্রকাশ করা মাকরূহ। উল্লেখ্য, শোক ও সমবেদনা প্রকাশ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দান, ধৈর্য ধারণের উপদেশ দান, তার দুঃখ, শোক ও বিপদের অনুভূতিকে হালকা করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাই এটি মুস্তাহাব। এটি সৎ কাজের আদেশ দান অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং সততা ও আল্লাহভীতির কাজে সহযোগিতার আওতাধীন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক কন্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এ মর্মে সংবাদ পাঠান, তার এক পুত্র মৃত্যু শয্যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদদাতাকে বললেন, “যাও, একে (কন্যাকে) বল, আল্লাহ যা নেন, তা তাঁর বস্তু, আর যা দেন তাও তাঁর বস্তু। সব কিছু বান্দার কাছে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য গচ্ছিত রয়েছে। তাকে বল সে যেন সবর করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
এক সাহাবীকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরবারে অনুপস্থিত দেখে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, “হে আল্লাহর রাসূল ! তার ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার প্রতি সমবেদনা জানালেন এবং এরপর বললেন, “শোন, তোমার ছেলে সারা জীবন তোমার কাছে থাকুক-এটা তোমার কি অধিক পছন্দনীয় ! না সে তোমার আগে গিয়ে জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকুক এবং তুমি মৃত্যুবরণ করলে সে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিক-এটা পছন্দনীয়? সাহাবী বললেন, সে আমার আগে জান্নাতে গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দিক এটাই কাম্য”। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তাহলে সেটি তোমার জন্য নির্ধারিত হল। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি শুধু আমার জন্য? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “না, সকল মুসলমানের জন্য”। (আহমদ ও নাসায়ী)
হযরত আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে দেখেন এক মহিলা একটি কবরের ওপর উপুড় হয়ে কাঁদছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “হে আল্লাহর বাঁদী, আল্লাহকে ভয় কর ও সবর কর। মহিলা বলল; হে আল্লাহর বান্দা, আমি এক সন্তানহারা জননী। সুতরাং আমি যা করছি তা আমার জন্য অশোভনীয় কিছু নয়”। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় বললেন, তুমি সবর কর। মহিলা বলল, “যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কথা শুনেছি। এবার তুমি যাও”। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছ থেকে চলে গেলেন। এক সাহাবী মহিলাকে দেখে বললেন, এ ব্যক্তি তোমাকে কি বলল ? মহিলা তাঁকে সব কথা জানাল। সাহাবী বললেন, তুমি জান এ ব্যক্তি কে? সে বললঃ না। সাহাবী বললেনঃ সর্বনাশ ! উনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । মহিলা একথা শোনামাত্র দৌড়ে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে দেখা করে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল ! আমি সবর করব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “প্রথম আঘাতের সময় সবর করা উচিত।” অর্থাৎ আকস্মিক বিপদ দেখা দেয়ার সময় সবর অবলম্বন করাই উত্তম। পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই মন শান্ত হয়ে যায়।
হযরত আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু নামক একজন সাহাবীর একটই ছেলে মৃত্যুবরণ করে। তিনি সে সময় বিদেশে ছিলেন এবং ছেলের মৃত্যুর কথা মোটেই জানতেন না। এরপর যখন তিনি বাড়ি এলেন, তাঁর স্ত্রী পরিবারের সবাইকে আগে বলে দিলেন, “তোমরা কেউ ছেলের মৃত্যুর কথা তার কাছে প্রকাশ করো না। যখন যা বলতে হয় আমি তাঁকে জানাব।” এরপর তিনি আবু তালহাকে খাবার দাবারের ব্যবস্থা করলেন। রাতে শোবার পর তাকে বললেন, হে আবু তালহা ! কেউ যদি কাউকে কোন বস্তু ধার হিসেবে দিয়ে, এরপর তা ফেরত চায়, তাহলে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করা কি উচিত ? তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, না। তখন তাঁর স্ত্রী সকল ঘটনা জানিয়ে বললেন, “তাহলে তোমার ছেলের ব্যাপারে সবর কর”। একথা শুনে আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাগান্বিত হয়ে বললেন, তুমি এত বিলম্বে এটা আমাকে জানালে ? এরপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানালে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “গত রাতে তোমাদের আচরণকে আল্লাহ অভিনন্দিত করেছেন”। (বুখারী) হাদীসে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, “সবরের চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ত কোন বস্তু কাউকে দান করা হয়নি”। (মুসলিম)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর এক ছেলেকে দাফন করার পর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন। লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হাসার কারণ কি? তিনি বললেন, আমি শয়তানকে বিমুখ করেছি। যখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শত্রুরা আঘাত করে, তখন তাঁর দাড়ির ওপর দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকা অবস্থায় তিনি বলেন, “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতুম মিনায যালিমীন। হে আল্লাহ ! আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমার কাছে সাহায্য চাই এবং সকল বিষয়ে সাহায্য চাই, আর আমাকে তুমি যে পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছ, এতে আমি সবর চাই”।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যার দু’টি শিশু সন্তান মারা যাবে, সে জান্নাতে যাবে”। মুসলিম শরীফে বর্নিত রয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মৃত সন্তানেরা জান্নাতের সর্বত্রই অবাধে ঘুরে বেড়াবে। একথা শুনে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমার মাতা-পিতা আপনার উপর কুরবান হোক, যদি কারো একটি সন্তান মারা যায় ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে সেও জান্নাতে যাবে। (তিরমিযি) কিয়ামতের মাঠে তারা তাদের পিতা-মাতাকে পেয়ে জাপটে ধরে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ না করিয়ে ছাড়বে না।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, যে ব্যক্তির জীবিত অবস্থায় তিনজন না বালেগ সন্তান মারা যাবে, সে সন্তান তার জন্যে জাহান্নামের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ নাজাত পাবে। একথা শুনে হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু নামক এক সাহাবী বললেন, আমার তো দু’জন মারা গেছে, তারাও কি প্রাচীর হবে ? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হ্যাঁ।
হযরত উবাই ইবন কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার একজন সন্তান মারা গেছে। একজনও কি নাজাতের উসিলা হবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ! একজন হলেও নাজাতের কারণ হবে। তবে তাকে প্রাথমিক অবস্থায় সবর করতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কারো ওপর যখন কোন বিপদ মুসিবত দেখা দেয়, তখন তা হয় তাকে এমন এক গুনাহ থেকে পবিত্র করার জন্যে আসে, যাকে আল্লাহ এ বিপদ ব্যতীত আর কোনভাএ ক্ষমা করবেন না বলে স্থির করেছেন, নতুবা তাকে এমন কোন উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করার জন্যে আসে, যার জন্য সে বিপদ ব্যতীত আল্লাহ আর কোন বিকল্প রাখেননি। হযরত উম্মে সালামা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসিবতে পতিত হয়ে “ইন্না নিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বলবে এবং দোয়া করবে যে, “হে আল্লাহ ! আমাকে এ বিপদ থেকে আশ্রয় দাও এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু বিকল্প দান কর” , আল্লাহ তাকে উপযুক্ত পুরষ্কার ও উত্তম প্রতিদান দান করবেন।
হযরত উম্মে সালামা (রা) বলেছন, “এরপর আমার স্বামী আবু সালামা মৃত্যুবরণ করলে আমি অনুরূপ দোয়া করেছিলাম। এর ফলে আল্লাহ আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মত মর্যাদাবান স্বামী দান করলেন”। (মুসলিম)
ইমাম শা’বী বর্ণনা করেন, বিচারপতি হযরত শুরাইহ (রহ) বলতেন, কোন বিপদে পড়লে আমি চারবার আল্লাহর প্রশংসা করি।
প্রথমবার, এজন্য বিপদটা আরো মারাত্মক হতে পারত কিন্তু তা হয়নি।
দ্বিতীয়, যখন আল্লাহ আমাকে ধৈর্যধারণের ক্ষমতা দান করেছেন।
তৃতীয়, যখন আমাকে “ইন্না নিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়ার তওফিক দান করেছেন।
চতুর্থবার, যখন দেখি যে বিপদটা আমার ইসলাম থেকে পদচ্যুত হয়নি।
বিপদে যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহকে স্মরণ করে, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ। এর বিপরীতে যদি কেউ বিপদে পতিত হয়ে ধৈর্যহীন, অস্থির হয়ে আপন মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করে এবং এ সংক্রান্ত অস্থিরতা প্রদর্শন করে, তাহলে তার প্রতি আল্লাহ অবশ্যই বিরাগ হন, পরিণামে তার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, বিপদের সময় যে রান চাপড়ায় আল্লাহ তার সৎ কর্ম ব্যর্থ করে দেন। ব্যথিত হৃদয়ে নীরবে অশ্রুপাত করা দূষণীয় নয়। দোষ তখন যখন তা অতিমাত্রায় করা হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট থাকা মানুষের নেককার হওয়ার নিদর্শন। আর আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করা বদকার ও পাপাচারী হওয়ার নিদর্শন।
মূলঃ কবীরা গুনাহ – ইমাম আযযাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১০৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন