ইসলামী ব্যাংকিং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
লিখেছেন লিখেছেন জুনাইদ হোসেন সবুজ ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:৪১:৩৮ সকাল
গল্প ১ :
একজন লোক একটি ধারালো ছুরি দিয়েএকটি মুরগী জবাই করে রান্না করল এবং আপনাকে খাবারের দাওয়াত
দিল ।আপনি সে দাওয়াত রক্ষা করে খাবারে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন কি না?
এর উত্তর হবে দুই ধরনের ।
একজন ঈমানদার উত্তর দিবেন যে, মুরগী যে লোক জবাই করেছে, সেযদি ঈমানদার লোক হয় এবং
আল্লাহর নামে মুরগীটি জবাই করে থাকে, তাহলে সে মুরগী আপনি খেতে পারবেন।
আর সে লোক যদি অমুসলিম হয় এবং আল্লাহর নামে জবাই না করে থাকে, তাহলে তা খাওয়া হালাল হবে না। এখানে বস্তুবাদের
দৃষ্টিতে উভয়জবাইর মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকলেও ঈমানেরদৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
গল্প ২ :
একজন পুরুষ একজন নারীর সাথে যৌনকর্ম করল; ফলশ্রুতিতে একজন সন্তান জন্মলাভ করল। অপর একজোড়া নারী- পুরুষ ইসলামী পদ্ধতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একই কর্ম করল ওসন্তান জন্মলাভ করল। উভয় কাজ কি সমান হল এবং কেউ কি বলতে পারবে এখানে মৌলিক পার্থক্য কোথায় ?
আসল কারণ হল 'আনুগত্য'।
যে আল্লাহর আনুগত্য করবে, সে পুরষ্কার পাবে আর যে নাফরমানী করবে, সে শাস্তি ভোগ করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মুসলিমরা এক দারুণ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এটা মূলত এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা। যারা ইসলামকে dominant force হিসেবে দেখতে চান না, তাদের একটি কৌশল হল ইসলামের স্বীকৃত বিষয়াবলী বা ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে কোন প্রচেষ্টার ব্যাপারে মুসলিমদের মাঝে দ্বিধা এবং সংশয়ের সৃষ্টি করা। আমাদের ঈমানের দুর্বলতা ও জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারা এ ব্যাপারে শতভাগ সফল হন বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তাই খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ক্বুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলাম পালন বা ইসলামকে সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণের যে কোন প্রচেষ্টা মুসলিমদের দ্বারাই সমালোচিত হয় সবার আগে। ইসলামী ব্যাংকিং এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা, বিভ্রান্তি রয়েছে অনেক একনিষ্ঠভাবে ইসলাম পালনকারীর মাঝেও।
ইসলাম সুনির্দিষ্ট জ্ঞানের ধর্ম। এখানে সন্দেহ, হলেও হতে পারে জাতীয় অনুমানের কোন অবকাশ নেই। তাই আমাদের যে স্বভাবটির মাধ্যমে আমরা অজান্তেই ইসলামের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করি, তা হল জ্ঞান ছাড়া ইসলাম নিয়ে কথা বলা। একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে চিকিৎসা নিতে কেন যাব না সেটা আমরা খুব ভালভাবে বুঝি কিন্তু আলেমের কাছ থেকে সুশৃখংল উপায়ে দ্বীন শিক্ষা না করে থাকলে ইসলাম নিয়ে কেন কথা বলা যাবে না, তা আমাদের অনেকেরই মাথায় ঢোকে না।
ইসলামী অর্থনীতি একটি অত্যন্ত গতিশীল ও গভীর বিজ্ঞান যা সম্যকরূপে উপলব্ধির জন্য অর্থনীতির নানা অংশ ও একই সাথে উসূল আল ফিকহ বা ইসলামী আইন Derivation এর মূলনীতি সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। জ্ঞান ছাড়া শুধু নিজস্ব সীমিত এবং পক্ষপাতমূলক অভিজ্ঞতা বা স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে মন্তব্য করলে তাতে মুসলিমদের অপকার বৈ উপকার হবে না। আরেকটি বিষয় হল, দুটো বিষয় আপাত দৃষ্টিতে সদৃশ মনে হলেও তা আসলেই এক হয়ে যায় না বা তাদের ব্যাপারে শরীয়াহর দৃষ্টিভঙ্গিও এক হয়ে যায় না। যেমনঃ বিয়ে ছাড়া এবং বিয়ের মাধ্যমে সন্তান হওয়ার মাঝে এমনিতে তেমন কোন পার্থক্য নেই। বিয়ে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু মেয়ের অভিভাবকের উপস্থিতিতে সামাজিকভাবে এই কয়েকটি শব্দের উচ্চারণই সামষ্টিক জীবনে বৈপ্লবিক পার্থক্য ডেকে আনে। তাই একটি সুন্নাহ, আরেকটি ব্যভিচার যার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং এর স্বাতন্ত্র্য বুঝতে হলে এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা ইসলামী ব্যাংকিং এর বিষয়টি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে আলোচনা করব, অবশ্যই স্কলারদের থেকে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে মুক্ত হয়ে এবং দল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ইনশাল্লাহ।
এক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হল ইসলামী ব্যাংকিং মু’মালাতের (1) অংশ। অর্থ্যাৎ এ ব্যাপারে প্রাথমিক নিয়ম হল তা হালাল যদি না ইসলামের মৌল নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। তাই এ সংক্রান্ত কোন বিষয় যদি কাফিরদের উদ্ভাবিতও হয় কিন্তু ইসলামের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর বলে বিবেচিত হয়, তবে তা থেকে অনৈসলামিক উপাদানসমূহ দূর করে তাকে হালাল করার প্রচেষ্টার মাঝে দোষের কিছু নেই বরং এর মাধ্যমে ইসলামের যুগোপযোগিতা ও চিন্তা গবেষণার প্রতি সমর্থন প্রতিভাত হয়ে উঠে।
ইসলামী ব্যাংকিং কি?
ব্যাংক একটি আর্থিক মধ্যস্ততাকারী প্রতিষ্ঠান যা সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারীর মাঝে কার্যকর সেতুবন্ধনের কাজ করে পুঁজির দক্ষতাপূর্ণ বণ্টনে সাহায্য করে। Financial Intermediation অর্থ্যাৎ যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ আছে কিন্তু নিজেরা খাটানোর মত সুযোগ/যোগ্যতা/ মানসিকতা নেই, আর যাদের ব্যবসায়িক দক্ষতা/ অবকাঠামো আছে কিন্তু যথেষ্ট পুঁজি নেই, তাদের মাঝে সমন্বয় সাধনের এই কাজটি যুগে যুগে হয়ে এসেছে। ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখন এই কাজটি করে। সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার অনৈসলামিক উপাদানসমূহ সরিয়ে বিভিন্ন ইসলামী অর্থনৈতিক পদ্ধতির দ্বারা অনুরূপ কাজ যখন কোন প্রতিষ্ঠান করে, তখন তাকে ইসলামী ব্যাংক বলে। এখানে উল্লেখ্য যে ইসলামী ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় সংগ্রহের যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করে তা নতুন আবিষ্কৃত কোন পন্থা নয়। একদম প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিমরা যেভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করত, এখনও সেই পদ্ধতিই আধুনিক যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আরও Formal & Structured উপায়ে প্রয়োগ করা হয় মাত্র।
আজকাল ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার ব্যাপারটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে, আর আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার অধীন নেই। এটা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মত নয় যে না করলে আমাদের জীবন স্থবির হয়ে যাবে না। যাদের জীবিকা অর্জনের মূল উৎস ব্যবসা নয় তারা হয়তবা চাইলে ব্যাংকের সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লেনদেন না করেও চলতে পারেন, কিন্তু যারা ব্যবসা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। তাই একটি আধুনিক সমাজে ব্যাংকের অবস্থানের ব্যাপারে কথা বলার সময় শুধু নিজের কথা চিন্তা না করে একটি সামষ্টিক অর্থনীতির কথা চিন্তা করতে হবে, বিবেচনায় আনতে হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কথা।
(চলবে)
(1)
ইসলাম মানুষের জীবনের কাজগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করেছেঃ
ইবাদাত (যা কেউ মুসলিম হওয়ার কারণে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করে - নামায, রোযা, কুরআন পাঠ ইত্যাদি )
মু’মালাত (যা কেউ মানুষ হওয়ার কারণে জৈবিক প্রয়োজনে করে- খাওয়া, ঘুম, চাকরি ইত্যাদি)
ইসলামে সকল ইবাদাতের একমাত্র উৎস হল ওহী।তাই এক্ষেত্রে starting assumption হচ্ছে সবকিছু হারাম যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল শিখিয়ে গেছেন, তা ব্যতীত। কেউ যদি আপনাকে বিশেষ কোন নামায শেখায় (যেমনটি আমার আরবী টিচার আমাকে শিখিয়ে ছিলেন)তবে মূল নিয়ম হচ্ছে তা নিষেধ, যতক্ষণ না আপনি প্রমাণ পাচ্ছেন যে এটা সহীহ সুন্নাহ তে আছে, সাহাবীরা করেছেন!
অন্যদিকে মু’মালাতের ব্যাপারে starting assumption হচ্ছে সবকিছু হালাল যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করে গেছেন, তা ব্যতীত। কেউ যদি আপনার সামনে কোন খাবার নিয়ে আসে, তবে মূল নিয়ম হচ্ছে তা জায়েজ, যতক্ষণ না আপনি প্রমাণ পাচ্ছেন যে এটা সহীহ সুন্নাহ বা কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকিং এর আদর্শগত ভিত্তিঃ
ইসলামী ব্যাংকিং এর আদর্শগত ভিত্তি ইসলামী অর্থনীতি, যা দ্বীন ইসলামের সাথে সম্পর্কহীণ কিছু নয়, বরং এর একটি অংশ মাত্র। অর্থনীতির তিনটি মৌলিক প্রশ্ন- What to Produce, How to produce and For whom to Produce এর উত্তর ইসলামী অর্থনীতি খোঁজে ঐশী নির্দেশনার মাঝে, প্রচলিত অর্থনীতির মত Trial & Error পদ্ধতিতে নয়।
ইসলামী অর্থনৈতিক মতাদর্শের কয়েকটি মূলনীতি উল্লেখ করলেই পার্থক্যটি স্পষ্ট হবে।
প্রচলিত অর্থনীতি হল অসীম চাহিদা সীমিত সম্পদ দিয়ে কার্যকরভাবে মিটানোর উপায়।(Effective Allocation of scarce resources to meet unlimited demand) অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতি অনুযায়ী মানুষের চাহিদা অসীম হলেও সব চাহিদা মিটানোর যোগ্য নয়। সমাজে ফেন্সিডিল বা পর্ণোগ্রাফির বিপুল চাহিদা থাকলেই ইসলামী রাষ্ট্র তা উৎপাদন করা শুরু করবে না। আবার ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী সম্পদ সীমিত নয়। আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়েছেন কিন্তু তাদের ন্যায্য চাহিদা মিটানোর মত সম্পদ দিয়ে দেন নি-এই ধারণা আল্লাহর প্রজ্ঞা, দয়াশীলতা তথা তাওহীদের দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। (W.F.O র তথ্যও এই বক্তব্য সমর্থন করে যে পৃথিবীতে ক্ষুধা সমস্যার কারণ খাদ্যের অভাব নয়) কিন্তু তাহলে এত দারিদ্র্য কেন? কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর। দুনিয়াতে পরীক্ষাস্বরূপ আল্লাহ সবার হাতে সমান সম্পদ না দিয়ে আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে সেই সম্পদ ব্যবহার করা যায়। মানুষ যখন সেই নীতিমালা অনুসরণ করবে তখন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান অনিবার্য।
ইসলামী অর্থনীতির আরেকটি মূলনীতি হল সম্পদের মালিকানা নিয়ে এর দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের অংশ হিসেবে সম্পদের মালিকানা আসলে আল্লাহর। তাই সম্পদ উপার্জন, বণ্টন, ব্যয় সব ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে, জবাবদিহিতার ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে।
ইসলামী অর্থনীতির তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বাস্তবে প্রয়োগ করে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।যেমন ইসলামী ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ইত্যাদি। তাই ইসলামী ব্যাংকের সাথে প্রচলিত ব্যাংকের প্রথম পার্থক্য আদর্শগত-যা থেকে জন্ম নেয় অন্যান্য কার্যপদ্ধতিগত পার্থক্যের।
ইসলামী ব্যাংকের কার্যপদ্ধতিঃ
ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়াহ মেনে চলে-একথাটি ব্যাপক দ্ব্যর্থবোধক। কারণ শুধু সুদমুক্ত থাকাটাই শরীয়াহর একমাত্র দাবী নয়।ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদমুক্তভাবেও BAT (Brithish American Tobacco) বা অনুরূপ কোন সংস্থার সাথে লেনদেন করতে পারবেনা।
তারপরও ইসলামী ব্যাংকের মূল বৈশিষ্ট্য সুদ পরিহার করা।তাই ইসলামী ব্যাংকের
কার্যক্রম বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে সুদের সংজ্ঞা কি?[1]
সুদ কিঃ
সুদের সংজ্ঞা বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রা (Currency)র ধারণা। ইসলামী অর্থনীতিতে টাকা বা মুদ্রা কোন পণ্য নয়, কারণ তা সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। একটি পণ্য (ধরুন মোবাইল) এর সাথে টাকার পার্থক্য হল টাকা আপনি সরাসরি খেয়ে বা পরে ফেলতে পারবেন না। একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কোন পণ্যে পরিণত করে তবেই ব্যবহার করতে পারবেন।( টাকা দিয়ে একটা বার্গার কিনে তারপর খেয়ে ফেললেন) আর যেহেতু এটা পণ্য নয়, তাই এটা আপনি বেচতে পারবেন না, বেচে কোন লাভও করতে পারবেন না। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলাম প্রচলিত অর্থনীতিতে সুদের যে সংজ্ঞা- Price of credit- তার মূলে কুঠারাঘাত করেছে কারণ টাকা ধার দেয়া কোন পণ্য নয় যে তার দাম নিবেন।
যারা সুদের পক্ষে সাফাই গান, তারা অনেকে বলেন টাকা ধার দেয়া একটি সার্ভিস, সুদ হল এই সার্ভিস চার্জ। কিন্তু ইসলামে অর্থের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, তা হল এটি মালে ফানি বা Fungible Goods। Fungible Goods হল সেটাই যা একবার ব্যবহার করলেই নিঃশেষ হয়ে যায়। অর্থ্যাৎ আপনি যদি কাউকে এমন কোন জিনিস ধার দেন, তবে তার পক্ষে ঐ একই জিনিস ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। তাকে ফেরত দিতে হবে অনুরূপ কিছু। যেমন আপনি কাউকে বার্গার ধার দিলে সে ফেরত দেয়ার সময় আরেকটি অনুরূপ বার্গার দিবে। প্রথম বার্গারটি ফেরত দেয়া সম্ভব নয় কারণ ব্যবহারের পর তা আর অবশিষ্ট নেই। ১০০ টাকাও এমন। ফেরত দিতে হবে আরেকটি সমমূল্যের নোট, যেটা ধার দেয়া হয়েছিল, সেটা নয়।
আর Non Fungible Goods হল যা ব্যবহারের পরও অবশিষ্ট থাকে যেমন বাড়ি, গাড়ি, মোবাইল ইত্যাদি। আপনার মোবাইলের সেটটি যদি কাউকে এক মাসের জন্য ধার দেন, তবে এটা সম্ভব যে এক মাস ব্যবহার করার পর সে ঐ মোবাইল সেটটিই ফেরত দিবে। এখন, কোন বস্তু Non Fungible হলেই শুধু আপনি তাকে ভাড়া দিতে পারবেন, নতুবা নয়।
তাহলে আমরা দেখলাম মুদ্রা বা টাকা Fungible Goods হওয়াতে আপনি একে ভাড়া দিতে পারবেন না, পণ্য না হওয়াতে বিক্রিও করতে পারবেন না। তাহলে টাকা বাড়ানোর উপায়টা কি? ইসলাম টাকা অলস ফেলে রাখতে উৎসাহ দেয় না, টাকা অলস ফেলে রাখলে আপনাকে যাকাত দিতে হবে যা ক্রমান্বয়ে আপনার টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেবে।
টাকা বাড়ানোর একমাত্র এবং একমাত্র বৈধ উপায় হল একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। নিচে এটা চিত্রের সাহায্যে দেখানো হল-
(১) টাকা ------------পণ্য (Fungible/ Non Fungible Goods) বিক্রি---------টাকা
(২)টাকা--------------পণ্য (Non Fungible Goods Only) ভাড়া--------টাকা
এভাবে টাকাকে একটি চক্রের মাধ্যমে প্রবাহিত করে আপনি তাকে বাড়াতে কমাতে পারেন। তা না করে যদি আপনি সরাসরি টাকার লেনদেনে কম বেশি করেন, তবে তা হবে সুদ।
[1] আমি যখনই কোন মানুষকে এই প্রশ্নটি করি, তখনই তারা বলেন মাসে মাসে নির্ধারিত (Fixed) একটা পরিমাণ দেয়াই হল সুদ। প্রতিউত্তরে যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে বাড়িভাড়ার পরিমাণতো নির্ধারিত, সেটা কেন সুদ নয়? তখন যে বাক্যাংশটি যোগ করা হয় তা হল লাভ ক্ষতি যাই হোক, তারপরও যদি দিতে হয়, তবে তা সুদ। এগুলো আসলে সুদের কোন সংজ্ঞা নয়। কারণ যারা বাণিজ্য অনুষদে পড়াশোনা করেছেন, তারা জানেন যে সুদের হার পরিবর্তনশীল (Floating) হতে পারে। আবার কেউ যদি কাউকে ১,০০,০০০ টাকা ধার দিয়ে বলেন যে ১ বছরের মাঝে ফেরত না দিতে পারলে ১০০০ টাকা বেশি দিতে হবে, তবে তাতে লাভ ক্ষতির কোন সম্পর্ক নেই, তাও এটা সুদ।
টাকা বাড়ানোর একমাত্র এবং একমাত্র বৈধ উপায় হল একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। নিচে এটা চিত্রের সাহায্যে দেখানো হল-
(১) টাকা---------------পণ্য (Fungible/ Non Fungible Goods) বিক্রি -----------টাকা
(২)টাকা ----------------পণ্য (Non Fungible Goods Only) ভাড়া -------------- টাকা
এভাবে টাকাকে একটি চক্রের মাধ্যমে প্রবাহিত করে আপনি তাকে বাড়াতে কমাতে পারেন। তা না করে যদি আপনি সরাসরি টাকার লেনদেনে কম বেশি করেন, তবে তা হবে সুদ। সুদের এই অভিনব সংজ্ঞা আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং তা নিম্নোক্ত হাদিস থেকে গৃহীত-
আবূ সাইদ আল-খুদরী-রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু- থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেছেন-
সোনার সাথে সোনা, রূপার সাথে রূপা, গমের সাথে গম, যবের সাথে যব, খেজুরের সাথে খেজুর এবং লবণের সাথে লবণ বিনিময়ের ক্ষেত্রে সমান সমান এবং হাতে হাতে বিনিময় হওয়া উচিৎ। এরূপ বিনিময়ে যে বেশি বা কম দেয় বা নেয়, সে সুদী কারবার করে। এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই সমান।[1] (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এমন লেনদেনের অর্থ কি? কোন স্বাভাবিক মানুষ কেন এতে লিপ্ত হবে? এমন লেনদেন করার পেছনে যদি কোন যুক্তিই না থাকে, তবে তা নিষিদ্ধই বা করা হল কেন? কিন্তু কেউ যদি হাদিসটি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেন, এবং মুদ্রার অবিশেষায়িত রূপ (Non standardized Nature of money) এর কথা বিবেচনায় রাখেন, তাহলে বুঝবেন যে হাদীসে উল্লখিত পণ্য গুলো আসলে তখন মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত। হাদিসটি আসলে ইসলামে মুদ্রার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিচ্ছে!!!!!!!!!!!!!!!
এই নিষেধাজ্ঞার সীমারেখা কি শুধু এই ছয়টি পণ্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নাকি- এ নিয়ে ফকীহদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হল যে সোনা ও রূপা বাদে বাকি চারটি পণ্যের ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়( Cause of Judgment) হবে এদের ওজন বা পরিমাণ, তা ছাড়াও এটা খাদ্য যোগ্য হতে হবে।
আর সোনা ও রূপার ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় হচ্ছে মূল্য। [2]
তাই যে পণ্য ও উল্লেখিত ছয়টি পণ্যের বিচার্য বিষয় (খাদ্য যোগ্য এবং ওজন করা হয় বা খাদ্য যোগ্য এবং পরিমাপ করা হয় বা মূল্য হিসেবে পরিশোধ করা হয়) একই হবে তারাও উক্ত নিষেধাজ্ঞার অধীনে পড়বে।
এখন সুদের সংজ্ঞা বুঝতে হলে আমাদের নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে-
(১) যদি একই পণ্য হয় তবে লেনদেন সমজাতীয় ও নগদে হতে হবে। তা না হলে সুদ হবে।
যেমন গমের সাথে গম- একই প্রকার, পরিমাণ ও নগদে লেনদেন হতে হবে।
(২) যদি পণ্য একই না হয় কিন্তু তাদের বিচার্য বিষয় একই হয় তবে পরিমাণ অসমান হতে পারবে, কিন্তু লেনদেন নগদে হতে হবে।
যেমন এক কেজি গমের সাথে তিন কেজি খেজুর লেনদেন করা যাবে, কিন্তু সাথে সাথে হতে হবে।
(৩) যদি পণ্য একই না হয় এবং এদের বিচার্য বিষয়ও ভিন্ন হয় তবে অসমান পরিমাণ এবং বাকীতে লেনদেন দুটোই বৈধ।
যেমনঃ সোনার সাথে গমের লেনদেন।
এই শেষোক্ত কেস এ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ভুমিকা প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে একটি পণ্য ও আরেকটি মূল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। যে কোন একটি প্রদানে বিলম্ব করা যাবে। দুটোই নয়।
যদি পণ্য সরবরাহ বিলম্বিত হয়, মূল্য আগে পরিশোধ করা হয় তবে তাকে বলে বাই সালাম, আর যদি মূল্য পরে শোধ করা হয়, পণ্য আগেই সরবরাহ করা হয় তবে তাকে বলে বাই মুরাবাহা।
[1] উপরের হাদিসটি আমার সীমিত জ্ঞান মোতাবেক আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হাদিস।
[2] এটা বিস্ময়কর লাগতে পারে যে সোনা ও রূপার ক্ষেত্রে আলাদা কেন? আমরা আমাদের সমকালীন উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি যে দুই টাকার কয়েন ও দুই টাকার নোটের ওজন আলাদা হলেও এদের বাজারমূল্য একই। অর্থ্যাৎ সোনা ও রূপার বৈশিষ্ট্য অন্য চারটি পণ্য থেকে একটু আলাদা।
সুদের শ্রেনীবিভাগঃ
উপরোক্ত আলোচনার পর আমরা যাব সুদের স্রেনীবিভাগে। সুদ দুই প্রকারঃ
রিবা আন নাসিয়াহঃ
সময়ের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে/ শর্ত হিসেবে মূলধনের সাথে যে বৃদ্ধি হয় তাকে বলে রিবা আন নাসিয়াহ। এর উৎপত্তি ঋণ। কেউ যদি ১০০০০০ টাকা ধার দেয় এই শর্তে যে এক বছর পর ফেরত দেয়ার সময় ১১০০০০ টাকা দিতে হবে, তবে এই অতিরিক্তটা হল রিবা আন নাসিয়াহ।
ঋণ গ্রহীতাকে অতিরিক্ত কিছু টাকা দেয়ার বিনিময়ে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়া হলেও সেটা হবে রিবা আন নাসিয়াহ।
রিবা আল ফদলঃ
হাতে হাতে লেনদেনের সময় যদি সমজাতীয় পণ্য কম বেশি করা হয় তবে রিবা আল ফদল হবে।
উদাহরণঃ টাকা ভাংতি করার সময় আপনি টাকার পরিমাণ কম বেশি করতে পারবেন না বা পুরান টাকা বদলিয়ে নতুন টাকা দেয়ার জন্য কোন সার্ভিস চার্জ দিতে পারবেন না।
তৃতীয় একটি প্রকারঃ
রিবার একটি অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন রূপ হল ঋণ দিয়ে তা থেকে উপকার নেয়া। সেটা যে শুধু অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে হতে হবে তা নয়। আপনি যদি ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নিতে চান বা তার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেতে চান ( সুপারিশ করানো ইত্যাদি) তবে তা বৈধ হবে না।[1] এখন ইসলামী ব্যাংকের উদ্দেশ্যই যেখানে বৈধ উপায়ে মুনাফা অর্জন, তাই এর পক্ষে ঢালাওভাবে ঋণ (কর্জে হাসানা) দেয়া সম্ভব নয়। কর্জে হাসানা একটি সেবামূলক পদ্ধতি যার প্রয়োগ আমাদের দেশে খুবই কম।
ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে টাকা বৃদ্ধি করে?
ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা বৃদ্ধি করে মূলত তিনটি উপায়ে-
১) কেনা বেচা
২) ভাড়া
৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা
১) কেনা বেচাঃ
ইসলামী ব্যাংকগুলো মূলত বাই সালাম[1] এবং বাই মুরাবাহা[2] পদ্ধতিতে গ্রাহকদের সাথে ব্যবসা করে। তা কিভাবে প্রচলিত ব্যাংকের থেকে আলাদা হল? নিচের উদাহরণ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হবে-
আপনি একটি প্রচলিত ব্যাংকে গিয়ে বললেন আপনার ৫০০০০০ টাকা লাগবে।তারা জানতে চাইবে যে কেন- আপনি বললেন আপনার পাইপের ব্যবসা আছে এবং আপনি তার কাঁচামাল কিনতে চান। তারা যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে (আসলেই আপনার ব্যবসা আছে নাকি, টাকা ফেরত দেয়ার মত সামর্থ্য আছে নাকি ইত্যাদি)আপনাকে ৫০০০০০ টাকা দিবে, আপনি সেই টাকা খাটিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর সুদ সহ তাদের ৫৫০০০০ টাকা ফেরত দিবেন।
আপনি যদি একটি ইসলামী ব্যাংকে গিয়ে বলেন যে ৫০০০০০ টাকা লাগবে।তারাও জানতে চাইবে যে কেন- আপনি বললেন আপনার পাইপের ব্যবসা আছে এবং আপনি তার কাঁচামাল কিনতে চান। তারা যেটা করবে সেটা হল যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর আপনার কাছে জানতে চাইবে আপনি কোথা থেকে, কি ধরণের পাইপ কিনতে চান। আপনার চাহিদা জানার পর ইসলামী ব্যাংক আপনার অর্ডারকৃত পণ্য দোকান থেকে নগদে কিনবে এবং আপনার কাছে লাভসহ ধারে [3]বেচবে।আপনি সেই মাল দিয়ে ব্যবসা করে ব্যাংককে মালের মূল্য পরিশোধ করবেন-৫৫০০০০।
দেখুন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকের কাছে ৫০০০০ টাকা বেশি যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কিভাবে প্রথমটি সুদ আর দ্বিতীয়টি লাভ?
প্রথম ক্ষেত্রে লেনদেন হচ্ছে টাকার সাথে টাকা। আপনার হাতে ব্যাংক টাকা দিচ্ছে।
আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে লেনদেন হচ্ছে মালের সাথে টাকা। ইসলামী ব্যাংক প্রথম ক্রেতা, আপনি দ্বিতীয়।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর এই মোডটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়। তাই আমাদের নিচের বিষয়গুলো খুব ভালমত বুঝতে হবে।
প্রথমত,
এক্ষেত্রে একটি শরীয়াহ ইস্যুটি খুব সতর্কতার সাথে নিশ্চিত হতে হয়- সেটা হল ব্যাংক আসলেই পণ্যটির প্রথম ক্রেতা কিনা এবং মালিকানা সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা।কারণ মালিকানার প্রকৃত হস্তান্তর না হলে সে লেনদেন বৈধ হয় না।ব্যাপারটি যেন কাগজে কলমের মাঝে এমনভাবে সীমাবদ্ধ না থাকে যে প্রকারান্তরে গ্রাহককে পণ্যটি ক্রয়ের জন্য ধার দেয়া হচ্ছে। আর এখানেই ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানবীয় ধর্মীয় উপাদানগুলোর অপরিহার্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যদি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকে, তারা নিজেরাই ইসলামী ব্যাংকিং এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো না বুঝেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের যদি তাকওয়া না থাকে তবে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যায়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাঝে শরীয়াহ প্রতিপালনের মানের পার্থক্যটাও এখান থেকেই আসে।
দ্বিতীয়ত,
কোন জিনিস নগদে লেনদেন হলে একরকম দাম আর ধারে দিলে (হোক এক কিস্তি বা একাধিক)বেশি দাম নির্ধারণ করা বৈধ। কিন্তু এখানে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে ক্রেতা বাকিতে কিনবেন না নগদে কিনবেন তা অবশ্যই চুক্তি সম্পন্ন করার সময়ই নির্ধারিত হয়ে যেতে হবে। কোন জিনিস একটি দামে বেচলেন, তারপর বাকিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়ার জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করা হল-সেটা বৈধ হবে না। এর সারমর্ম হল কোন বস্তুর দাম একবারই নির্ধারিত হবে, আর সেটা চুক্তি সম্পন্ন করার সময়ই।আর এ কারণেই নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কোন বস্তুর দাম শোধ করা হলে ক্রেতাকে Discount দেয়ার প্রচলিত পদ্ধতি শরীয়াহ সম্মত নাকি সে ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। গ্রহণযোগ্য মতটি হল একদম সময় হিসাব করে পূর্বনির্ধারিত হারে কম দেয়া যাবে না, তবে অনির্ধারিতভাবে, দৈব চয়ন পদ্ধতিতে কিছু কম রাখা যেতে পারে উপহার হিসেবে, যাতে ক্রেতা সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে উৎসাহিত হন।
তৃতীয়ত,
বেচা কেনার ক্ষেত্রে যে দায়ের সৃষ্টি হয় তা গ্রাহক পণ্যটি নিয়ে লাভ করল না ক্ষতি করল তার উপর নির্ভরশীল নয়।[4] অনেক গ্রাহক অভিযোগ করে থাকেন যে ইসলামী ব্যাংক ক্ষতির ভাগীদার হয়না। এক্ষেত্রে অবশ্য লক্ষণীয় যে ব্যাংকের সাথে তার চুক্তির স্বরূপ কি ছিল। যদি তা বাই বা ইজারা মোড হয়ে থাকে, তবে ব্যাংকের দায় নেয়ার কথাও না।
[1] যদি পণ্য সরবরাহ বিলম্বিত হয়, মূল্য আগে পরিশোধ করা হয় তবে তাকে বলে বাই সালাম
[2] যদি মূল্য পরে শোধ করা হয়, পণ্য আগেই সরবরাহ করা হয় তবে তাকে বলে বাই মুরাবাহা
[3] বাই মুয়াজ্জাল হল ধারে বিক্রি করা, বাই মুরাবাহা হল লাভে বিক্রি করা। ইসলামী ব্যাংকগুলো দুটো পদ্ধতির সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে।
[4] এ বিষয়টি আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, আপনি দোকান থেকে একটি মোবাইল ধারে কেনার পর যদি আপনার মোবাইলটা চুরি হয়ে যায়, তবুও আপনাকে দোকানে দাম ঠিকই পরিশোধ করতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে টাকা বৃদ্ধি করে?
ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা বৃদ্ধি করে মূলত তিনটি উপায়ে-
১) কেনা বেচা
২) ভাড়া
৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা
২) ভাড়াঃ
এক্ষেত্রে ব্যাংক কোন মেশিনারীস বা অন্য কোন Non Fungible Goods কিনে তা গ্রাহকের কাছে ভাড়া দেয়।
৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাঃ
ইসলামী ব্যাংক মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রাহকের সাথে ব্যবসা করে থাকে। এই দুই পদ্ধতির [1]সারমর্ম নিচে চিত্রের সাহায্যে নিচে দেখান হল-
ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়াঃ
ঋণ দিয়ে যেহেতু অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না, তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর পক্ষে কার লোন, হোম লোন এগুলো দেয়া সম্ভব নয়। তারা যেটা করে সেটা হল ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়া। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক ও গ্রাহক অংশীদারী ভিত্তিতে কোন পণ্য কেনে। ধরুন একটি মোটর সাইকেলের দাম ২০০০০ টাকা। আপনি ১০০০০ টাকা দিলেন, ব্যাংক দিল ১০০০০ টাকা। মোটর সাইকেলটির মালিকানা ৫০% আপনার , আর বাকিটা গ্রাহকের। পুরো মোটর সাইকেলটা এখন আপনি যদি বাজার দরে কাউকে ভাড়া দেন, তাহলে এটার মাসিক ভাড়া হবে ধরুন ১০০০০ টাকা। ব্যাংক পুরো মোটর সাইকেলটি আপনাকেই ভাড়া দিবে। [2] যেহেতু ব্যাংক এর ৫০% র মালিক সেহেতু আপনি তাকে ভাড়া দিবেন ৫০০০ টাকা। আর সাথে মাসে মাসে ব্যাংকের অংশের কিছু টাকা শোধ করবেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনার মালিকানার অনুপাত বাড়তে থাকবে, ফলে প্রদেয় ভাড়ার পরিমাণও কমতে থাকবে। আরেকটি ভিন্ন চুক্তিতে ব্যাংক এই মর্মে গ্রাহকের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে যে গ্রাহক যদি তার দায় নির্ধারিত সময়ের মাঝে পরিশোধ করে দেয়, তবে ব্যাংক বস্তুটির মালিকানা তাকে দিয়ে দেবে।[3]
অনেকের মনে হতে পারে যে এখানে শর্তযুক্তভাবে একাধিক চুক্তি একটি চুক্তির মাঝে করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়, এটি একই চুক্তির বিভিন্ন অংশ।
[1] আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পোর্টফোলিওর প্রায় পুরোটাই বাই মোড দ্বারা পূর্ণ। লাভ ক্ষতির ভিত্তিতে এই অংশীদারিত্বের ব্যবসার মাঝেই ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রাণশক্তি ও স্বাতন্ত্র্য নিহিত। কিন্তু তা খুব কম করাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত বা সন্দিহান করা খুব সহজ হয়।
[2] মাল যে গ্রাহককেই ভাড়া দিতে হবে এমন নয়, তৃতীয় পক্ষকেও দেয়া যেতে পারে।
সঞ্চয়কারীদের সাথে ইসলামী ব্যাংকের সম্পর্কঃ
ইসলামী ব্যাংক নিয়ে দ্বিধা সংশয়ের অন্যতম মূল উৎস হল বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। [1]সঞ্চয়কারীদের মূল অভিযোগ যে ইসলামী ব্যাংকও লাখে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেয়, প্রচলিত ব্যাংকও তাই করে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায় থাকল?
ইসলামী ব্যাংকের সাথে অন্যান্য ব্যাংকের পার্থক্যটা নির্ধারিত পরিমাণ[2] দেয়াতে নয়, বরং টাকাটা নিয়ে ব্যাংকগুলো কি করে, টাকার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটাতে। আর কিসের নির্ধারিত পরিমাণ সেটা হল বিবেচ্য। যদি লাভের নির্ধারিত অংশ হয় এবং মূলধন সুরক্ষার নিশ্চয়তা না দেয়া হয় তবে সমস্যা নেই। কারণ লাভ অনির্ধারিত, তাই তার নির্ধারিত অংশও অনির্ধারিত।
ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে মুদারাবা চুক্তি- যার স্বরূপ আমরা আগেই চিত্রের সাহায্যে দেখিয়েছি। অর্থ্যাৎ এখানে গ্রাহকরা পুঁজি সরবরাহ করেন, ব্যাংক সেটা বিনিয়োগের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে খাটিয়ে যে লাভ করে তা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করে নেয়। ব্যবসায়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা থেকে তারা একটি অনুমিত পরিমাণ গ্রাহকদের বলে দেয়। এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে গ্রাহকদের কাছে উল্লেখিত শতকরা অংশ একটি অনুমিত মান, যা বছর শেষে সমন্ব্য় সাধন করা হয়। এখন এই পরিমাণ যখন বছর বছর হেরফের হয়, তখন পার্থক্যটা এত সামান্য হয় যে তা অনেকসময় চোখেই পড়ে না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে একজন গ্রাহকের একাউন্ট ১০-১৫ টাকার কমবেশি আসলে বিপুল অংকের লাভ-ক্ষতির ফলাফল যা লাখ লাখ গ্রাহকের মাঝে ছড়িয়ে (Spread) গিয়ে সামান্য আকার ধারণ করেছে।
ইসলামী ব্যাংকগুলো কি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত হতে পেরেছে?
এই জনপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর হল না। ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিধায় তারা দুটি ক্ষেত্রে সুদমুক্ত লেনদেন করতে পারে না-
১) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে যে বাধ্যতামূলক সঞ্চিতি, (SRR) এবং Foreign Currency Clearing Account এ জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার উপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ দেয়।
২) বিদেশী ব্যাংকগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে Nostro Account থাকে, সেটা চলতি হিসাব হলেও Overnight lending থেকে তারা সেখান থেকে সুদ পায়।
তবে ইসলামী ব্যাংকগুলো কল মানি মার্কেটে অংশগ্রহণ করে না, দেশীয় সুদী ব্যাংকে একান্ত প্রয়োজনে আকাউন্ট খুলতে হলে চলতি হিসাবে লেনদেন করে, যথেষ্ট পরিমাণ তারল্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যেন আন্তঃব্যাংক ঋণ না করতে হয়। আর নিতান্ত অপরিহার্য হলে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করে অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের সাথে, মুদারাবা পদ্ধতিতে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যাপারে আরেকটি অভিযোগ হল যে তারা খেলাপী গ্রাহকের উপর ক্ষতিপূরণ আদায় করে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচ্য যে গ্রাহক কি আসলেই অসমর্থ নাকি এটা তার স্বভাবগত সমস্যা। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা প্রবল। খেলাপী গ্রাহক, যারা গড়িমসি করে দেনা শোধ করছেন না, [3]তাদের কাছ থেকে দ্রুত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক অস্থায়ীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। এটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার একটি প্রকার। শরীয়াহ বিশেষজ্ঞরা বা বিচারপতিরা পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য ব্যবস্থাও নিতে পারেন। তবে এধরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করার এখতিয়ার ব্যাংকের হাতে না থেকে তৃতীয় পক্ষের হাতে থাকে যারা ঠিক করেন যে কে সঙ্গত কারণে দেন শোধে দেরী করেছে আর কে গড়িমসির কারণে করেছে।
কিন্তু এইসব উৎসের কোনটি থেকে আসা অর্থ ব্যাংক কখনো তার মূল আয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলে তা গ্রাহকদের বা শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বণ্টিত হয় না। এই আয় ব্যাংক শরীয়াহ কাউন্সিলের নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় করে।
[1] এ সংক্রান্ত একটি জরিপে আমি দেখেছি যে গ্রাহকদের ইসলামী ব্যাংকের স্বাতন্ত্র্য জিজ্ঞেস করা হলে সাধারণ গ্রাহকরা সঠিক উত্তর দিতে পারেন না কিন্তু বিনিয়োগ গ্রাহকরা এ ব্যাপারে খুব স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করেন। এর একটি কারণ হল তারা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের সাথে সুপরিচিত।
[2] আমরা আগেই দেখিয়েছি যে নির্ধারিত হলেই যে সুদ হবে তা নয়।
[3] হাদীসের পরিভাষায় যা একটি জুলুম
সুদের এই পরিমাণ কি ইসলামী ব্যাংকের অন্য সকল কার্যক্রমকে বাতিল করে দেয়?
আমরা আমাদের পুরো আলোচনায় দেখানোর চেষ্টা করেছি যে যেসব কার্যক্রম ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনাধীন, সেগুলোতে শরীয়াহ প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ইসলামী ব্যাংক।সুদ আসে তাদের নিয়ন্ত্রাধীন নয় এমন উৎস থেকে।অনেকেই আছেন যারা একে এক গ্লাস দুধের মাঝে এক ফোঁটা বিষের সাথে তুলনা করেন এবং বলেন এর ফলে পুরো দুধটাই বিষাক্ত হয়ে যায়।
এমতাবস্থায় তাদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন যে সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যখন সুদভিত্তিক তখন আমাদের করণীয় কি হতে পারে? ইসলামী ফিকহ শাস্ত্র শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে ফয়সালা দিয়েই ক্ষান্ত থাকে না, বরং সেই পরিস্থিতিতে কি করণীয়, সেটাও বলে দেয়। আমি শুরুতেই বলেছি যে এখন ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে আমরা অনেকটাই বাধ্য। তাই যারা উপরোক্ত মত পোষণ করেন, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেন করেন!!!!এখানেই আমার আপত্তি। তারা যদি বলতেন যে তারা আপোষহীণ এবং বালিশের তলায় টাকা রাখেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রমান্বয়ে তাদের টাকা হাওয়া হতে থাকলেও তাদের কিছু এসে যায় না বা তাদের টাকা নিরাপদে রাখার জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন তারা অনুভব করেন না, তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু তাদের ‘বিকল্প ব্যবস্থা’ কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান নয় নিম্নোক্ত কারণে-
১)কোন স্কলাররা এমনটা অনুমোদন করেন কিনা আমার জানা নেই। তারা সাধারণত যেসব স্থানে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান নেই, সেখানে অপরিহার্য ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেনের অনুমতি দিয়েছেন, অন্যথায় নয়। [1]সুদী ব্যাংকের দারোয়ানের চাকরিও যেখানে হারাম সেখানে তাদের সাথে লেনদেন কিভাবে বৈধ হতে পারে?
২) আপনি যদি ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিহার করে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন চালিয়ে যান, তাহলে আগামী ৫০ বছরেও সুদভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান হবে না।কিন্তু আমরা সবাই যদি ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হই তাহলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন সম্ভব। সেক্ষেত্রে গ্রাহক চাহিদার চাপে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সেইসাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়ম বেছে নিতে বাধ্য হতে পারে।
৩) প্রচলিত ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেন সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে (যারা ব্যবসা করেন না), কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির কল্যাণে এটা কোন সমাধান নয়।
৪) সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন ছাড়া উপায় নেই একথা বলার অর্থ হল আল্লাহ মুসলিমদের এমন একটি সময়ে রেখেছেন যখন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার সমতুল্য পাপ থেকে বাঁচার কোন উপায় রাখেন নি। কিন্তু এটা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর পরিপন্থী। কারণ আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না।
৫)আমরা অবশ্যই এমন পন্থা অনুসরণ করব যাতে আল্লাহকে পরকালে বলতে পারি যে আল্লাহ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম অনুধাবন, তাদের শরীয়াহ প্রতিপালনের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ, অন্যদের ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে উৎসাহিত করা------এগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টার উদাহরণ নাকি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে সন্দিহান হয়ে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা সর্বোচ্চ চেষ্টা----তা বিবেচনার ভার পাঠকদের উপর রইল।
৬) যারা হালাল হারামের কোন বাছ বিচার না করে অর্থ উপার্জনের নেশায় উন্মত্ত এবং আর যারা সুদী ব্যাংকের হাই প্রোফাইল চাকরি, শেয়ার বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ- সব কিছু থেকে বিরত থেকে নিজের অত্যন্ত কষ্টে উপার্জিত টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখছেন সুদ থেকে বাঁচার আশায়, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেনকে হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদেরকে যে একই কাতারে ফেলা হচ্ছে, আর বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যারা অর্থনীতির এত ঘোরপ্যাঁচ বুঝেন না, কিন্তু হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চান, তাদেরকে গোলকধাঁধার মাঝে ফেলা হচ্ছে, তার দায় কে নিবে?
এখানে উল্লেখ্য যে ইসলামী ব্যাংক হলেও তার সাথে ঢালাওভাবে আর্থিক সাহায্য সংক্রান্ত লেনদেনের পক্ষপাতী আমিও নই, অর্থ্যাৎ আর্থিক সাহায্য নিয়ে এ.সি, গাড়ি এসব বিলাস সামগ্রী কেনার আগে আমাদের একবার চিন্তা করা উচিৎ যে এসব সামগ্রী কেনার জন্য আর্থিক সাহায্য নেয়া আমার জন্য শরীয়াহ সম্মত কিনা। কারণ ইসলামে আর্থিক সাহায্য নেয়া খুব পছন্দনীয় কোন কাজ নয়, রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত ঋণ থেকে আশ্র্য় চেয়ে দুআ করতেন। সমাজ থেকে সুদের উচ্ছেদ করতে হলে আমাদের আরও অনেক সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে, বিলাসিতাকে অপরিহার্য প্রয়োজন হিসেবে আখ্যায়িত করার মানসিকতা দূর করতে হবে।
[1] বিশেষত যখন সুনির্দিষ্ট কোন জ্ঞান ছাড়াই স্রেফ সন্দেহের বশে আপনি আপনার এলাকার ইসলামী ব্যাংকগুলোকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
ব্যাংক ব্যবস্থাই কি একটি কাফির/ তাগূতী সিস্টেম, যা ইসলামীকরণই শরীয়াহসম্মত নয়?
ইসলামী ব্যাংকের বিরোধিতাকারীদের মাঝে আরেকটি দল আছেন যারা মত পোষণ করেন যে Fractional Reserve System এর উপস্থিতি কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই একটি তাগূতী সিস্টেম, কেউ কেউ একে দাজ্জালের সিস্টেমের সাথে তুলনা করেন। কাগুজে মুদ্রার (Paper money) ধারণাকেই তারা রিবার একটি প্রকার বলে ম্নে করেন। শেষোক্ত এই মতটি (কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার নিজেই রিবা) ইসলামী অর্থনীতির আলোকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে যদি কেউ কাগুজে মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস পড়েন। ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার অন্তর্নিহিত মূল্য (Intrinsic Value) থাকা উচিৎ (যেমন সোনা, রূপা ইত্যাদি) এবং বাস্তব সম্পদ হওয়া উচিৎ (Real Asset) । আজকের টাকার মত নয়, যার পুরো মূল্যটাই আরোপিত[1] ও তা একটি আর্থিক সম্পদ (Financial Asset)।
কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে যে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের মাঝে যে প্রচ্ছন্ন রিবা রয়েছে তা থেকে বাঁচার উপায় কি? ইসলামিক খিলাফাহকে যেমন আমরা শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করি, তেমনি সোনা রূপাকেই আমরা আসল মুদ্রা হিসেবে মনে করি। কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কি আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব? যেসব রাজনৈতিক দল ইসলামী ব্যাংককে তাগূতী সিস্টেম বলে তার সাথে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন, তারাও সুদী ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেন করার চাইতে উন্নততর কোন বিকল্প বা সমাধান দিতে পারেন নই।অথচ Fractional Reserve System সম্পর্কে পড়াশোনা আমাকে এই ধারণাই দেয় যে বাজারে অর্থের (Fiat money) যোগান দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম নিয়ামক হল Current Account.
আমাদের করণীয়ঃ
এত লম্বা আলোচনা থেকে আমাদের করণীয় পরিষ্কার- ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তাদের মাঝে চাপ প্রয়োগ করা। একটি ইসলামী ব্যাংকের মান যাচাই এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত চলকগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-
১) শরীয়াহ বোর্ডের সদস্য কারা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তারা কতটুকু কঠোর?
২) ব্যাংকের কর্মচারীরা কতটুকু ইসলামিক। তারা নিয়মিত সালাত আদায় করে নাকি, মহিলা কর্মচারীরা পর্দা মেনে চলেন নাকি, নারী পুরুষের অবাধ এবং অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা হয় নাকি এবং সবচেয়ে বড় কথা হল তারা সুদের পাপের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে নাকি! সুদের প্রতি ঘৃণা একজন ইসলামী ব্যাংকারের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। [2]
৩)ব্যাংকের কর্মচারীরা ইসলামী অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত কিনা এবং এটাকেই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি মনে করেন কি না।
৪) ব্যাংকের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না।
উপসংহারে বলা যায় ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। আর সেটার চরম অভাব আমাদের দেশে রয়েছে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতার কারণে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে সচেতনতা ব্যাংকগুলোকে সেবার মান বৃদ্ধি করতে বাধ্য করবে। আল্লাহ আমাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন, আর সেই সাথে অন্যের প্রচেষ্টাকে সমালোচনা না করে উদ্যোগী মুসলিম হবার মত মানসিকতা দান করুন। আমীন।
মোঃ জুনাইদ হোসেন
অফিসার ,শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক
বিষয়: বিবিধ
১৬১০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন