অন্যায়-অসঙ্গতি : মুক্তির পথ
লিখেছেন লিখেছেন জুনাইদ হোসেন সবুজ ২৮ মে, ২০১৩, ০৭:৫৮:১৬ সকাল
বিশ্বের সর্বত্র ব্যক্তির নামের পরে তার অর্জিত ডিগ্রি লেখা হয়ে থাকে, তা সে ডিগ্রি অ্যাকাডেমিক বা অনারারি যে পদবির হোক। ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেমন ডাক্তারÑ যারা মানুষের সেবায় নিয়োজিত এবং শিক্ষকÑ যারা উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ পিএইচডি কিংবা দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন প্রফেসর পদবি। ইউরোপ-আমেরিকায় কিন্তু এটার প্রচলন দৈনন্দিন জীবনে দেখা যায় না। তারা যত্রতত্র, সভা-সমিতিতে বা সামাজিক জীবনে তাদের ডিগ্রি ফলাও করে প্রকাশ করেন না। ১৯৬২ সালে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেতে যাই। তখন নামের আগে পদবি লেখা হতো না। দীর্ঘ দিন পর দেশে ফিরে এসে দেখছি এক নতুন দৃশ্য। নামের আগে অ্যাকাডেমিক ও পেশাগত পরিচয়। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখেছি সেই ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেকে প্রচার করছেন। ভাঁজ করা বিজনেস কার্ডে লম্বা ফিরিস্তি পাওয়া যায়। এতে লেখা আছে, তিনি কতগুলো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সহসভাপতি, সেক্রেটারি, সদস্য, ডাইরেক্টর, কোন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, ব্যবসায় সমিতি, হকার সমিতি, কোন পাড়ার খেলার কাবের সভাপতি ইত্যাদি। এসব বহুল পরিচিত ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই কিন্তু ট্যাক্স (কর) দেন না বা তাদের কোনো ‘টিন’ নম্বর নেই। এনবিআর কর্তৃপক্ষ ভাঁজ করা এসব কার্ডওয়ালাদের খোঁজখবর খুব একটা রাখেন না। তাদের লক্ষ্য উচ্চমধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজন।
আমরা উচ্চ বা সর্বোচ্চ মহাসম্মানিত পদের মর্যাদা রাখতে জানি না। পদে যাওয়ার বা শপথ নেয়ার আগে কখনো চিন্তা করি না, আমি এ পদের যোগ্য কি না। সেই পদের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হবে কি না। উচ্চপদে কিছুকাল থেকে বা মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর যখন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসেন, কারো কারো স্মরণ থাকে না, এখন কী করা উচিত, কোথায় যাওয়া উচিত ইত্যাদি। কেন আমরা সর্বোচ্চ পদের মর্যাদা রক্ষা করতে জানি না? অথচ ওই সব ব্যক্তি উচ্চশিক্ষিত দেশী ও বিদেশী অনেক সম্মানজনক ডিগ্রি মেধায় ও শ্রমে অর্জন করেছেন।
মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনের হার্লে স্ট্রিটে কিং অ্যাডওয়ার্ড দ্য সেভেন্থ হসপিটাল ফর অফিসার্সে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। আমরা অনেকেই তার সাথে দেখা করতে যেতাম। আমার দায়িত্ব একটু বেশি ছিল; কারণ তিনি আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে Law of Equity and Trust পড়িয়েছেন এবং আমি তদানীন্তন পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলাম। এক দিন বিকেলে পাশের কেবিনের একজন রোগী সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে তার ঘরে ঢুকতেই বিচারপতি চৌধুরী চমকে উঠলেন। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি নিজেই পরিচয় দিলেন, My Name is Dingle. আমার মুখ দিয়ে অজ্ঞাতে বেরিয়ে গেলÑ I know, you are Sir Dingle Foot, the Lord Chancellor of Her Majesty’s Ministry of Law. আমার স্যারের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। হাতের ইশারায় বসতে বললেন। এই ফুট পরিবার ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রখ্যাত। তার ভাই Michael Foot, Sir Hugh Foot প্রমুখ। অথচ কথায়, ব্যবহারে, চালচলনে এরা কত নম্র, কত বিনীত, সরল। কয়েকবার অনুষ্ঠান ও সেমিনারে দেখা হয়েছে Professor A.J.P Taylor-এর সাথে। তিনি Indian History-র ওপর পৃথিবীর অন্যতম সেরা জ্ঞানী ব্যক্তি। নিজেকে সদা পরিচয় দিয়েছেন This is Taylor প্রফেসর বা ডক্টর বলে পরিচয় দেননি নিজের।
আমাদের শপথ গ্রহণকারী সম্মানিত ব্যক্তিরা শপথ নেয়ার সময়ে শপথের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব ও দায়িত্ব কতটা উপলব্ধি করেন, জানি না। সাংবিধানিক প্রায় সব পদের জন্য শপথ নেয়া দরকার । সাংবিধানিক পদ : ১. রাষ্ট্রপতি, ২. প্রধানমন্ত্রী, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার, ৫. সংসদ সদস্য, ৬. প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিরা, ৭. প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার, ৮. মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ৯. চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকমিশন এবং সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য। শপথের ভাষা কিন্তু একইÑ ‘আমি… … …, সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী … … … রাষ্ট্রপতি বা সরকারের… … … হিসেবে… … … পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব : আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
সাথে আছে গোপনতার শপথ (বা ঘোষণা)। শপথ বাক্যের শব্দগুলো অর্থ ও তাৎপর্য বিবেচনায় না নিয়ে আমরা অহরহ শপথের পরিপন্থী কাজ করে চলেছি। রাজনীতিবিদদের কথা বাদই দিলাম। কারণ এরা সস্তা কিছু বাক্যের ফুলঝুরি ছড়িয়ে এবং কিছু কৌশল অবলম্বন করে সরলপ্রাণ ভোটারদের আকৃষ্ট করে থাকেন। ভোটে জিতে তা সব কিছু ভুলে যান। এরা অধঃস্তন কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে অনেক বেআইনি ও নিয়মবহির্ভূত কাজকর্ম করিয়ে নেন।
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঝানু আমলা দিয়ে যেসব অরাজনৈতিক পদ অলঙ্কৃত হয়, সেসব পদে অনিয়ম বা বিধিবহির্ভূত কিছু ঘটতে দেখলে খুব দুঃখ পাই। যেমন- নির্বাচন কমিশনারদের বিধি অনুসারে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি ভুলে গিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মাধ্যমে অবাধ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করাই দায়িত্ব। তাদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ নির্বাচনে কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ুব্ধ বা পরাজিত ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রে সেসব বিষয় নিষ্পত্তি হয় নির্বাচিত প্রার্থীর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর। তার ওপর আছে কিছু আজ্ঞাবহ বিচারক, যাদের নিযুক্ত করা হয়েছে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে। যোগ্যতা, মেধা নিরপেক্ষতা এখন অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাসনে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চপদে আসীন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না। তারা নানা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সুষ্ঠু তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সর্বস্তরে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ ও পদায়ন হচ্ছে। ফলে শাসনব্যবস্থা এক রকম অচল হয়ে পড়েছে। সিনিয়র আমলারা বলেছেন, নিয়মরীতিবহির্ভূত আদেশ পালন করলে সরকার বদল হলে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বলা প্রয়োজন, মন্ত্রীরা লিখিত নির্দেশ নয়, মৌখিক নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
বাস্তবে দেশ পরিচালিত হয় অভিজ্ঞ, সৎ, নিষ্ঠাবান, অরাজনৈতিক সিনিয়র কর্মকর্তাদের দিয়ে। মন্ত্রীরা আসেন কয়েক বছরের জন্য নিজ নিজ এজেন্ডা নিয়ে। কিন্তু আমলারা স্থায়ীভাবে কর্মকর্তা থাকেন এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যান। ব্রিটেনে মন্ত্রী দেশের স্বার্থপরিপন্থী নির্দেশ দিলে কৌশলে তা বিলম্বিত করা হয় অথবা ফাইল চাপা দেয়া হয়। মন্ত্রী চাইলেই সবকিছু করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয় নীতি পরিপন্থী কোনো নির্দেশ সিনিয়র আমলারা পালন করেন না। রীতিনীতি উল্লেখ করে এবং কৌশলে ওই সব নির্দেশ স্থগিত রাখা হয়।
রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে, জনগণের আশা-আকাক্সা পূরণার্থে আমলাদের সঠিক ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করা উচিত। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা প্রায় সময়েই নিজেদের দলীয় কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। এমনকি কোনো কোনো দল অতি কৃতজ্ঞতাবশত দেশীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশীদের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে, দেশপ্রেমিক নিঃস্বার্থ আমলাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তবে বাইরে ও ভেতরের চাপে আমলারা যে প্রভাবিত হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এখানেও চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের প্রয়োজন।
অব্যাহত অপশাসনে বা কার্যত একদলীয় শাসনে দেশের পরিস্থিতি কী? চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, হল, নদী, খাসজমি ও কোরবানির পশুর হাট দখল, ইভটিজিং, প্রতিবাদী প্রফেসর হত্যা, মা হত্যা, অসহনীয় দ্রব্যমূল্য, যানজটে সময় নষ্ট, জ্বালানির বিপুল অপচয় ইত্যাদি কারণে দেশবাসী হতাশ হয়ে গণতন্ত্রের নামে প্রহসনমূলক শাসনের অবসান কামনা করছে। এমনকি সরকারের সিনিয়র নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বলতে বাধ্য হচ্ছেন, দলীয় কর্মী ও ক্যাডারেরাই সরকারের সব সফলতা ধূলিসাৎ করে দেবে। প্রধানমন্ত্রী এক কথা বলছেন, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে হয়তো সরকার অপ্রকাশ্যে অন্য নির্দেশ দিচ্ছে বলে জনমনে সন্দেহ। আজ্ঞাবহরা গানের সারিন্দার মতো বলছেনÑ‘আইনশৃঙ্খলা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন উন্নত।’
এ দেশে গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচিত সরকার। নির্বাচন মানে কারচুপি। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে এসে বিরোধী দলের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন। স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়ে দেয়ার পর ১৯৯১-এর নির্বাচনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পরিচালিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেছিলেন, ‘সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। এ সরকারকে এক দিনও শান্তিতে থাকতে দেবো না।’ শুরু হলো সংসদ বর্জন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের পর আওয়ামী লীগ তার পূর্ববর্তী সরকার যে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও দুর্নীতি করেছিল তার কয়েক গুণ করল। বিএনপি সংসদ বর্জন করে দিলো। একদলীয় ‘গণতন্ত্র’ চলল পাঁচ বছর। ২০০১ সালে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে নানা কৌশল করতে থাকে। বিচারপতিদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর এবং আপিল বিভাগের বিচারপতি এম এ আজিজকে ডেপুটেশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। বিচারকদের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। সুচতুর আওয়ামী লীগ এই ভুলের সুযোগ নিলো। সহিংস আন্দোলন শুরু হলো পুরোদমে এবং বেশ কিছু প্রাণ গেল। লগি-বৈঠার আন্দোলনের মাধ্যমে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ল্যাং মেরে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন গং রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলেন। এই সরকার দুর্নীতি দমনের নামে বেশ ধুমধাড়াক্কা শুরু করে দেয়। তাদের টার্গেট প্রথমে ছিল দুই নেত্রী এবং মন্ত্রীরা। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতি মামলা শুরু হয়। তারপর আওয়ামী লীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করে সম্পদের সঠিক হিসাব না দেয়ায়। অনেকে দেশত্যাগ করে রক্ষা পান এবং বেশ কিছু সাবেক মন্ত্রী ও নেতা দুর্নীতির দায়ে কিংবা সম্পদের সঠিক হিসাব বিবরণ না দেয়ায় গ্রেফতার হলেন।
পর্দার আড়ালে শুরু হয় আলোচনা। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মুলা। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় একজনকে ‘সাইজ’ করা এবং অপরজনকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতায় বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই ফর্মুলা অনুসারে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতায় বসল। ক্ষমতায় বসেই (হয়তো শর্ত মোতাবেক) তারা নানা রকম গোপন চুক্তির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। জনগণের দুর্ভোগ, দুঃখদুর্দশা, নিরাপত্তা, আইনের শাসন বা প্রয়োগ হচ্ছে না। মানুষ এক চরম অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ছেই; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সঙ্কট এবং অসহ্য যানজট তো আছেই। দেখে গেছে, গণতান্ত্রিক সরকার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু করলে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পরিবর্তন চায় এবং পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে গেলেই তৃতীয় পক্ষের শাসনকে আহ্বান জানায়। সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘উদ্ধারকারী’ সেজে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও নিরাপত্তাহীন ও মজলুম জনগণ নবাগত সরকারকে অভিনন্দন জানায়। এমনকি বিরোধী দল ও শান্তিপ্রিয় মানুষ সেই পরিবর্তনের সমর্থনে মিছিল করে। বর্তমান সরকার এর পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য আইন পাস করলেও অনেকের আশঙ্কা, বর্তমান পরিস্থিতি আরো এক ওয়ান-ইলেভেনের জন্ম দিতে পারে।
আমাদের রাজনীতিবিদদের এক দল অপর দলকে অপবাদ দিয়ে থাকে। দলের নামের সাথে উপসর্গ ব্যবহার করে থাকে। যেমন প্রো-আমেরিকান, প্রো-ইন্ডিয়ান, প্রো-পাকিস্তানি, প্রো-চাইনিজ, প্রো-রাশিয়ান ইত্যাদি। সত্য, মিথ্যা, ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, মশকারা বা উসকানি যে অর্থেই এসব ব্যবহার করা হোক না কেন, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে। তখন জাতীয়তাবোধ গৌণ হয়ে যায়। সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে এহেন প্রবণতা এমনিভাবে গেঁথে যায় যে, দলীয় নীতি অনুসরণ করে একে অপরকে বিভিন্ন দেশের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং এতে প্রায়ই সহিংস দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। অনেক ‘প্রো’র কথা শুনি তবে ‘প্রো-বাংলাদেশী’ বেশি লক্ষ করা যায় না। জনগণ আমাদের দেশের সৈনিকদের প্রো-বাংলাদেশী মনে করে। বিভিন্ন সঙ্কটকালে তারা কালক্ষেপণ না করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে উদ্ধারকার্জে অংশ নিয়ে থাকেন। তা দল-বর্ণ নির্বিশেষ সবাই স্বীকার করে থাকেন। সামরিক শাসনামলে প্রথমে বেশ কিছুকাল সামরিক বাহিনী জনগণের প্রশংসা অর্জন করে, যতক্ষণ না আর্থিক বা ক্ষমতার লোভলালসায় আকৃষ্ট হয়। আমাদের দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এত দৃঢ়মূল যে পারিপার্শ্বিকতার কারণে প্রায় বেশির ভাগই দূষিত হয়ে যায়। বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক বাহিনীকে যত কম জড়িত করা যায় তত ভালো।
নির্বাচিত সরকারপ্রধানেরা বা সরকারি দল যেভাবে বারবার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু করেছে, তাতে দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ, চরিত্রবান এবং সাহসী একজন শাসকের প্রয়োজন বোধ করেন, যিনি লোভলালসার ঊর্ধ্বে থেকে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত না করে দেশে একটি সুষ্ঠু সিস্টেম প্রবর্তন করে যাবেন।
অপচয়, দুর্নীতি এবং ব্যক্তিসম্পদের পাহাড় ভাঙতে পারলে, আমাদের খনিজসম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারলে বিদেশী সাহায্য ব্যতিরেকেই দেশ পরিচালনা করা সম্ভব। সরকারের এই কমিটমেন্ট থাকলে জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
বাস্তবতা খুব কঠিন। ৪০ বছরের অনিয়ম ও অরাজকতা পূর্ণ এবং বিধিবিহীনভাবে পরিচালিত অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বের একটি ছোট দেশে আইনের শাসন ও নিয়মনীতি প্রয়োগ করা সহজ নয়। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক স্বার্থান্বেষী দল আর দুর্ধর্ষ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যা মাফিয়ায়পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাথে আছে ভেতর ও বাইরের শক্তিশালী উসকানিদাতারা।
শরফুল ইসলাম খান
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বিষয়: বিবিধ
১২৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন