‘কোরআনের কথা বলা অপরাধ হলে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে রাজি’

লিখেছেন লিখেছেন জুনাইদ হোসেন সবুজ ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:২১:১৩ সকাল

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গতকাল ট্রাইব্যুনালে মামলার যুক্তি উপস্থাপন শেষে কাঠগড়ায় থেকে এ কথা বলেন।

সেদিন তখনকার চেয়ারম্যান নিজামুল হকের প্রশ্নের জবাবে আমি যা বলেছিলাম—আমার বিরুদ্ধে আনীত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শতাব্দীর জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। আল্লাহর কসম! আমার বিরুদ্ধে রচনা করা চার সহাস্রাধিক পৃষ্ঠার প্রতিটি পাতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেকটি বর্ণ মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কোনো এক দেলোয়ার শিকদারের করা অপরাধগুলো আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যার পাহাড় রচনা করেছেন।

মাওলানা সাঈদী বলেন, আজ আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে আপনাদের সামনে বলতে চাই, সরকার ও তার রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক চিত্রিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের হত্যাকারী, লুণ্ঠন, গণহত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারী দেলোয়ার শিকদার বা ‘দেলু’ বা দেইল্যা রাজাকার আমি নই। আমি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় জন্মভূমি এই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে চিরচেনা পবিত্র কোরআনের একজন তাফসিরক, কোরআনের পথে মানুষকে আহ্বানকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

তিনি বলেন, সেই যৌবনকাল থেকেই শান্তি ও মানবতার উত্কর্ষসাধনে পবিত্র কোরআনের শ্বাশ্বত বাণী প্রচার করার লক্ষ্যে নিজ জন্মভূমি থেকে শুরু করে বিশ্বের অর্ধশত দেশে গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত ভ্রমণ করেছি। সেই আমি আজ ৭৩ বছর বয়সে জীবনসায়াহ্নে এসে সরকার ও সরকারি দলের দায়ের করা ‘ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানার’ হাস্যকর ও মিথ্যা মামলায় গত ২৯ জুন, ২০১০ থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে মানবেতর অবস্থায় দিনাতিপাত করছি। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস!

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ৪২ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোনো বিষয়েই কোনো মামলা ছিল না। সামান্য একটি জিডিও ছিল না। গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বদান্যতায়, মহানুভবতায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ আমি ১৭টি মামলার আসামি। সেই জুন, ২০১০ থেকে অদ্যাবধি কথিত মানবতাবিরোধী ২০টি অপরাধের অভিযোগসহ ১৭টি মামলা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সরকার আমাকে তাদের এক রাজনৈতিক তামাশার পাত্রে পরিণত করেছে, যা আজ দেশবাসীর কাছে মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতোই স্পষ্ট।

মাওলানা সাঈদী বলেন, যে ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আজ আপনাদের সামনে আমি দণ্ডায়মান, সেগুলো সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই সাজানো। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর বা পাড়েরহাটে পাক বাহিনী যা ঘটিয়েছে, সেসব কাহিনী সৃজন করে চরম মিথ্যাবাদী ও প্রতারক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তার সহযোগীরা নীতি-নৈতিকতার মূলে পদাঘাত করে আমার নামটি জুড়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী, মৃত্যুর পরের আজাবে বিশ্বাসী, পরকাল ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিতে বিশ্বাসী কোনো মুসলমানের পক্ষে এত জঘন্য মিথ্যাচার আদৌ সম্ভব নয়। তদন্ত কর্মকর্তা এবং সহযোগীরা তাদের সৃজিত অভিযোগগুলো প্রমাণের জন্য কয়েকজন বিতর্কিত চরিত্র ভ্রষ্ট ও সরকারি সুবিধাভোগী দলীয় লোক ছাড়া সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কাউকেই হাজির করতে পারেননি।

তিনি বলেন, এতত্সত্ত্বেও প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচার প্রক্রিয়ার সমাপ্তি টেনেছেন। তিনি আইন-কানুন, ন্যায়বিচারের শপথ, অভিযুক্ত হিসেবে আমার বক্তব্য প্রদানের প্রাপ্য অধিকার প্রদান কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি, বরং তিনি রায় ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় মহান রাব্বুল আলামিনের হস্তক্ষেপের ঘটনা। আজ সেই একদা সমাপ্তকৃত বিতর্কিত মামলার পুনঃসমাপ্তির দ্বিতীয় আয়োজন। কিন্তু আমি আগের মতো একই উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, মামলা যেনতেন প্রকারে শেষ করার সেই একই ত্রস্ততা।

মাওলানা সাঈদী আরও বলেন, এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৃত বিবেচনায় আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলার রায় প্রকাশ করে গেছেন। সাবেক চেয়ারম্যান মিডিয়ায় প্রকাশিত স্কাইপ সংলাপকে মেনে নিয়ে অন্যায় ও বেআইনিভাবে পরিচালিত বিচারকাজের সব দায়ভার বহন করে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বিদায় হয়েছেন। ষড়যন্ত্র ও অন্যায়ভাবে বিচারকাজ পরিচালনার বিষয়টি তার স্কাইপ কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যানের বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে উঠে এসেছে, কীভাবে সরকারের চাপে পড়ে, সুপ্রিমকোর্টের জনৈক বিচারপতির প্রলোভনে পড়ে, তথাকথিত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ডিকটেশন অনুযায়ী বিচারকাজ পরিচালনা করে এবং তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে প্রসিকিউশনের সঙ্গে অবৈধ যোগসাজশে বিচারকাজ পরিচালনায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আদালতের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে আমার পক্ষের সাক্ষীর অগ্রিম তালিকা জমা দিতে বাধ্য করে সেই তালিকা প্রসিকিউশন এবং তাদের মাধ্যমে সরকার, সরকারি দল ও স্থানীয় প্রশাসনকে সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সাক্ষীদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতে হাজির না হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিসহ নানা ধরনের অনিয়ম ও বেআইনি কর্মপন্থার মাধ্যমে গোটা বিচারকাজটি কলুষিত করেছেন।

তিনি বলেন, সাবেক চেয়ারম্যানের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে সেইফ হাউস স্ক্যান্ডাল, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আমার সাক্ষীকে ডিবি পুলিশ কর্তৃক অপহরণ ও গুম করার স্ক্যান্ডাল, ১৫ সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে তদন্ত কর্মকর্তার জবানে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করার স্ক্যান্ডালের মতো বিষয়গুলোও আমার মামলায় প্রভাব বিস্তার করে আছে। তিনি বলেন, এতসব ষড়যন্ত্র ও স্ক্যান্ডালজর্জরিত প্রসিডিংসকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের মাধ্যমে মূলত সাবেক চেয়ারম্যান নিজেই পরিত্যক্ত ও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে দিয়ে গেছেন। সুতরাং সেই পরিত্যাজ্য বিষয়ের ওপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে নির্ভর করা যেতে পারে কীভাবে!

মাওলানা সাঈদী বলেন, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সাবেক চেয়ারম্যানের মতামত বা রায় তার কথোপকথনেই প্রকাশিত হয়েছে। স্কাইপ সংলাপে তিনি স্বীকার করেছেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সঙ্গে আইনের খুব একটা সম্পর্ক নেই। আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত এই মামলাটি দেশি দরবারের মতোই। তার ভাষায়, ‘সাঈদীর কেইসটা ডিফারেন্ট। এই সাঈদীর কেইসটার লগে আইনের সম্পর্ক খুব বেশি না। এডা আমাদের দেশি দরবারের মতোই।’ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যানের প্রকাশিত এই মতামত বা মন্তব্যের পর এই মামলা চলার নৈতিক অবস্থান কোথায় থাকে? বিদায়ী চেয়ারম্যান আমার মামলাটি আদ্যোপান্ত পরিচালিত করে একে যে দেশি দরবারের সঙ্গে তুলনা করেছেন, তার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। দেশি এই দরবার তথা গ্রাম্য সালিশি অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের ছোট-খাটো ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে। খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধ নিয়ে সালিশ বা দরবার হয় না।

তিনি বলেন, বিদায়ী চেয়ারম্যানের ভাষায়, ‘সরকার গেছে পাগল হইয়্যা, তারা একটা রায় চায়।’ চেয়ারম্যান সাহেব ঠিকই বুঝেছিলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সরকার আমাকে ঘায়েল করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কতগুলো ঘটনা সাজিয়ে, জঘন্য ও ন্যক্কারজনক কিছু অপবাদ দিয়ে আমার বিচারের নামে প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য কোনো সাক্ষী নেই, আমার কোনো সংশ্লিষ্টতাও নেই। সুতরাং ট্রাইাব্যুনাল গঠন করে বিচার বিচার খেলা কেন, দরবার করে মিটমাট করলেই তো চলে। এটিই ছিল সাবেক চেয়ারম্যানের রায়।

মাওলানা সাঈদী বলেন, রাজনীতিতে আমার তালিকাভুক্তি ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে। উদ্দেশ্য পবিত্র কোরআনের মর্মবাণী ও আদর্শের প্রচারকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাইরে আমার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তত্পরতায় সময় ব্যয় একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য। সংকোচনহীনভাবে বলতে গেলে, রাজনীতির জটিল সমীকরণের বিষয়ে আমার অজ্ঞতা এবং সময়ের অভাবহেতু প্রচলিত রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার অবস্থান একজন অ্যামেচার রাজনীতিবিদের পর্যায়ে।

তিনি বলেন, বরাবরই আমার বিচরণ ছিল কোরআনের ময়দানে। জনগণকে কোরআনের দাওয়াত পৌঁছানোই ছিল আমার কাজ। আমার তাফসির মাহফিলগুলোতে হাজারো লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করে। এসব মাহফিল থেকে অসংখ্য অগণিত মানুষ সঠিক পথের দিশা পেয়েছে, নামাজি হয়েছে। এটাই কি আমার অপরাধ? দেশ-বিদেশের লক্ষ-কোটি মানুষ আমার ওপর আস্থা রাখেন, আমাকে বিশ্বাস করেন, আমাকে ভালোবাসেন। আমি সাঈদী লক্ষ-কোটি মানুষের চোখের পানি মিশ্রিত দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত। এই ভালোবাসাই কি অপরাধ? বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমি কোরআনের দাওয়াত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি, এটাই কি আমার অপরাধ? আমি কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি, এটাই কি আমার অপরাধ? মাননীয় আদালত, এটা যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে এ অপরাধে অপরাধী হয়ে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি রাজি আছি।

মাওলানা সাঈদী বলেন, আমি আমার সারা জীবন নাস্তিক্যবাদী ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে কোরআন ও হাদিসের আলোকে বক্তব্য দিয়ে এসেছি। আমার মাহফিলে জনতার ঢল নামে। আমার মাহফিলে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ কিচ্ছা-কাহিনী শুনতে আসেন না। কোরআনের দাওয়াত ও রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ জানতে আসেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও একত্ববাদ এবং কোরআনের বিপ্লবী দাওয়াত প্রচারে আমি অকুণ্ঠচিত্ত। আমার এ দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত এটিই আমার দৃঢ় অবস্থান। এর কোনো হেরফের হওয়ার নয়। সরকার এটি অবগত, বিধায় তাদের ইসলামবিদ্বেষী মিশন বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে আমাকে বিতর্কিত ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিশ্চিহ্ন করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

তিনি বলেন, ১৯৯৬-০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে কিংবা ’৭২ থেকে ’৭৫ মেয়াদকালে ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের ইসলামবিদ্বেষী বর্তমান অবস্থান ছিল না, বিধায় আমাকে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণ খুঁজে পায়নি। কিন্তু এবার ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ জোট বেঁধে আমাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মহানায়ক হিসেবে আবিষ্কার করেছে।

তিনি বলেন, আমাকে বিদেশ যেতে আটকে দেয়ার জন্য, পবিত্র রমজান মাসে, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর পর পিরোজপুরে প্রথমবারের মতো আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ দুটি খুনের মামলা দায়ের করা হলো। রমজান মাসে পবিত্র মক্কা-মদিনা যেতে না পেরে আমি মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত মেহেরবানিতে পবিত্র হজের মাত্র দু’সপ্তাহ আগে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আমাকে রাজকীয় মেহমান হিসেবে হজ পালনের জন্য দাওয়াতপত্র ও যাতায়াতের টিকিট পাঠালেন। আমি দুটি খুনের মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে হজ পালনে মক্কা শরিফ পৌঁছলাম। হজের দু’দিন পরে মিনা কিং প্যালেসে বাদশাহ লাঞ্চের দাওয়াত দিলেন। বাদশাহর সঙ্গে করমর্দন হলো, কুশল বিনিময় হলো, পাশাপাশি টেবিলে খানা খেলাম। আমার মনে কোনো দুর্বলতা থাকলে আমার জন্য এটা খুবই সহজ ছিল বাদশাহকে বলে সৌদি আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া। কিন্তু মাননীয় আদালত, আমি তা করিনি। হজে সব কাজ সমাধা করে দেশে ফিরে এসেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। মাননীয় বিচারপতিরা কারও নির্দেশে বা চাপে পড়ে অথবা আদর্শিক শত্রু ভেবে কারও প্রতি অবিচার করবেন না। তারা আল্লাহ তায়ালা এবং নিজের সুস্থ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকেই সিদ্ধান্ত নেবেন। মাননীয় আদালত, আমি আমার সে বিশ্বাস হারাতে চাই না।

মাওলানা সাঈদী আরও বলেন, স্কাইপ ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যাওয়ার পর এ বিচারের ওপর দেশবাসীর মতো আমার আস্থাও শূন্যের কোঠায়। তথাপি পুনর্গঠিত এ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিরা শুধু ও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অনুভূতি থেকে আপনারা আপনাদের সুবিবেচনা ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে এ মামলা নিষ্পত্তি করবেন। এ বিষয়ে আমি আশাবাদী হতে চাই, আস্থাশীল হতে চাই। সব শেষে আবারও রাজাধিরাজ, সম্রাটের সম্রাট, সব বিচারপতির মহাবিচারপতি আকাশ ও জমিনের সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র অধিপতি, মহান আরশের মালিক, সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নামে শপথ করে বলছি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ আমি করিনি। আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চারিতার্থ করার জন্য এবং আমাকে তাদের আদর্শিক শত্রু মনে করে সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমার বিরুদ্ধে শতাব্দীর জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যা এ মামলা পরিচালনা করেছেন। তাদের বর্ণিত জঘন্য মিথ্যাচার সত্য হলে আমার মমতাময়ী মায়ের ইন্তেকালের পর তার জানাজা এবং এর ঠিক ৮ মাস পরেই আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান রাফীক বিন সাঈদীর জানাজায় ঢাকা, খুলনা ও পিরোজপুরে লাখো মানুষের সমাগম হতো না। জানাজায় মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নিতেন না। আমার মা ও ছেলের লাশকে গোপনে গভীর রাতে ৫-১০ জন লোক নিয়ে জানাজা করে দাফন করতে হতো।

মাওলানা সাঈদী বলেন, আমি আমার এলাকায় তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছি। এতে স্বনামখ্যাত অন্তত ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য দিনরাত নিঃস্বার্থ পরিশ্রম করেছেন, গোটা পিরোজপুরবাসী এর সাক্ষী। তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশনের বক্তব্য সত্য হলে এসব বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের মান-মর্যাদা ধুলায় ধূসরিত করে আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে নির্বাচনী পরিশ্রম করতেন? হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক আমাকে ভোট দিতেন?

তিনি বলেন, আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা, তার সহযোগী প্রসিকিউশন এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদাতাদের হেদায়েত কর। আর হেদায়েত তাদের নসিবে না থাকলে তাদের সবাইকে শারীরিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে সেরকম অশান্তির আগুনে দগ্ধীভূত করো—যেমনটি আমাকে, আমার পরিবারকে এবং বিশ্বব্যাপী আমার অগণিত ভক্তকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আর জাহান্নাম করো তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা।

হে মহান রাব্বুল আলামিন! সব ধরনের চাপ এবং কারও নির্দেশ পালন বা কাউকে খুশি করার ঊর্ধ্বে উঠে শুধু তোমাকে ভয় করে এবং বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে ন্যায়বিচার করার তওফিক দান করো। আমি আমার সব বিষয় সেই মহান আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি, যিনি আমার কর্মবিধায়ক এবং তাঁকেই আমি আমার একমাত্র অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছি। সাহায্যকারী হিসেবে মহান আরশের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই আমার জন্য যথেষ্ট। আমাকে কিছু কথা বলতে দেয়ায় আপনাদের ধন্যবাদ।

দেখা হবে জান্নাতে : গতকাল মামলার কার্যক্রম শেষে কাঠগড়ায় থাকা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী উপস্থিত আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মিজানুল ইসলামের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আমার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। অনেক ত্যাগ করেছেন। আল্লাহ যেন আপনাদের হেফাজত করেন। মাওলানা সাঈদী এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যারা তিলকে তাল বানাননি তাদেরও আল্লাহ যেন হেফাজত করেন। ইনশাল্লাহ দেখা হবে জান্নাতে।

বিষয়: বিবিধ

১৩৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File