নবী (স) চরিত্রের ওপর আনা অভিযোগ গুলোর মধ্যে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য, তার জবাব - ২।
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নতরী ১২ জুন, ২০১৩, ০৭:৪১:২৪ সন্ধ্যা
প্রশ্ন : বুখারি শরিফ অধ্যয়ন করার সময় তালাক সংক্রান্ত অধ্যায়ের একটি হাদিস জ্ঞানের স্বল্পতা হেতু বুঝতে পারিনি। তাই মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্য আপনার সাহায্য নেয়া জরুরি মনে করছি। আশা করি, আপনি ব্যস্ততা সত্ত্বেও জবাব দিয়ে উপকৃত করবেন। হাদিসটি তালাক সংক্রান্ত অধ্যায়ে "কোন্ কারণে তালাক দিলে তা বৈধ। তালাক দেয়ার সময় স্বামীর কি স্ত্রীর মুখোমুখি হওয়া জরুরি?" শিরোনামে বর্ণিত হয়েছে। করাচিস্থ নূর মুহাম্মদ প্রকাশন...ীর প্রকাশিত বুখারি শরিফের অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত এ হাদিসের ক্রমিক নম্বর ২৪ এবং বর্ণনাকারী সাহাবি আবু উসাইদ র.। হাদিসের বক্তব্য হলো, রসূল সা, জনৈক 'জাওনিয়া' নামের মহিলার সাথে একাকী এক বাগানে সাক্ষাৎ করেন। প্রথমে রসূল সা. বলেন : "তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করো।" এর জবাবে মহিলা অত্যন্ত অশ্রাব্য কথাবার্তা বলে। এ হাদিস থেকে আমার মনে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলো জন্ম নিয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক ভালোভাবে বুঝিয়ে এর ব্যাখ্যা করবেন :
১. রসূল সা. উক্ত মাহিলা জাওনীয়ার কাছে বাগানে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন এবং কি উদ্দেশ্যে?
২. প্রথমে তাঁর সাথে দু'জন সাহাবি ছিলেন। পরে তিনি একাকী মহিলার কাছে গেলেন। এর কারণ কি?
৩. রসূল সা. মহিলাকে বললেন, "তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করো।" এর ব্যাখ্যা কি?
৪. জাওনীরা বললো : "কোনো রাণী কি বাজারী লোকদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে?" [অর্থাৎ পারেনা।] সে এ কথা কেন বললো?
৫. রসূল সা. কি মহিলাকে এ ধরণের কথা বলেছিলেন? রসূল সা. কর্তৃক এ ধরণের কথা বলা তো যারপর নাই অশোভন আচরণ। ইমাম বুখারি সাহেব এ ধরণের হাদিস তাঁর গ্রন্থে কেনো লিখলেন! এটা কি রসূল সা.-এর সাথে বেয়াদবি নয়?
৬. জাওনীয়া যদি রসূল সা.-এর স্ত্রী হতো, তাহলে রসূল সা. একাকী বাগানে যেতেন না, সেও তাঁর সাথে এরকম ভাষায় কথা বলতোনা এবং তিনি তাকে প্রবোধ ও সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তার গায়ের উপর হাত বুলাতেন না। এই হাদিসের ব্যাখ্যা কি?
৭. জাওনীয়া আল্লাহর আশ্রয় চাইলে রসূল সা. তাকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিলেন। এর উদ্দেশ্যটা কি?
৮. হাদিসের শেষে বলা হয়েছে, রসূল সা, জাওনীয়াকে দু'খানা সাদা কাপড় ও কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বিদায় দিলেন। এর অর্থ কি?
৯. হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনুবাদক বলেছেন, জাওনীয়া রসূল সা.-এর স্ত্রী ছিলো। কিন্তু বিয়েটা হয়েছিল তার অজান্তে কেবল তার অভিভাবকের উদ্যোগ। এটা কি সম্ভব হতে পারে? এখানে এ কথাটাও ভেবে দেখার মতো যে, জাওনীয়া উদ্দেশ্য কি? আর তাকে আত্মসমর্পণ করতেই বা বলবেন কেনো? তাছাড়া এটাও জানাবেন যে, জাওনীয়ার সাথে রসূল সা.-এর বিয়ে কখন কোথায় হয়েছিল? কোন্ কোন্ ব্যক্তি সাক্ষী ছিলো।
সর্বশেষ কথা হলো, ইমাম বুখারি এই হাদিস নিজের গ্রন্থে সন্নিবেশিত করলেন কেন? এতে মুসলিম উম্মহর কি লাভ হয়েছে? আশা করি এ হাদিসের সকল দিক সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেবেন, যাতে অপপ্রচারকারীদের সমুচিত জবাব দিতে পারি।
জবাব : বুখারির যে হাদিসের বিবরণ আপনি চিঠিতে দিয়েছেন, তাতে অবাক হবার বা আপত্তি তোলার মতো কোনো ব্যাপারই নেই। ব্যাপার শুধু এতোটুকুই, যে মহিলার কথা এ হাদিসে বলা হয়েছে, সে এবং তার পিতা সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তার পিতার ইচ্ছে অনুসারে তিনি তাকে বিয়ে করেন। প্রতীয়মান হয়ে যে, এই মহিলা নিজের পিতার ইচ্ছেকে সম্মান দেখাতে বিয়েতে রাজি হলেও বিয়েটা তার মনোপুত ছিলনা। এর ফল দাঁড়ালো এই যে, রসূল সা. যখন তার সাথে একান্তে মিলিত হতে গেলেন, তখন এই হতভাগী তার অশোভন কথাবার্তা দ্বারা জানিয়ে দিলো, সে এই বিয়ের বন্ধন বহাল রাখতে ইচ্ছুক নয়। রসূল সা. যখন তার প্রকৃত মনোভাব জানতে পারলেন, তখন কালবিলম্ব না করে তার সাথে বৈবাহিক বন্ধন ছিন্ন করে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বিদায় করে দিলেন। যে ঘটনা নিয়ে আপনার এই সুদীর্ঘ প্রশ্নত্রের অবতারণা, এই হলো তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
আপনি বুখারির যে অনুবাদ পড়েছেন, তার টীকায় যদি এ কথা লেখা থেকে থাকে যে, জাওনীয়ার পিতা তার অজান্তেই তার বিয়ে দিয়েছিল, তবে সেটা ভুল। কেননা সাবালিকা মেয়ের বিয়ে তার অনুমতি ছাড়া হতে পারেনা। উপরে আমি যে বিবরণ দিয়েছি, সেটাই প্রকৃত ঘটনা। রসূল সা. এই মহিলার কাছে বিয়ের আগেই গিয়েছিলেন - এ ধারণা ভুল। যে হাদিসটির উপর আপনি নিজের সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করেছেন, তার আগের ও পরের হাদিসগুলোও যদি আপনি পড়তেন তাহলে বোধ হয় আপনার মতে এতো প্রশ্ন জন্ম নিতোনা। পূর্ববর্তী হাদিসে বলা হয়েছে, "রসূল সা. যখন স্বীয় স্ত্রীদের একজনের কাছে গেলেন, তখন সে আল্লাহর আশ্রয় চাইলো।" এর সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, এ ঘটনা বিয়ের পরেই ঘটিছিল। আপনি যে হাদিস উদ্ধৃত করেছেন, তাতেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, "রসূল সা. উমাইমা বিনতে শারাহীনকে বিয়ে করেন। অত:পর যখন তার সাথে একান্তে মিলিত হন তখন .............।" আসলে যে মহিলাকে অন্যান্য হাদিসে জাওনীয়া বা ইবনাতুল জাওন (জাওনের মেয়ে) ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তারই নাম হলো উমাইমা। এই মহিলার গোত্রের নাম ছিলো বনু জাওনা।
এই ব্যাখ্যা থেকে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে বাড়িতে বা বাগানে রসূল সা.-এর একাকী যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা আসলে তাঁর বিবাহিত স্ত্রী উমাইমারই বাসস্থান ছিলো। এরপর আপনার এসব প্রশ্নের আর কোনো অবকাশ থাকেনা যে, এই বাগানটা কেমন ছিলো, সেখানে রসূল সা.-এর একাকী যাওয়া এবং ঐ মহিলার সাথে তাঁর এ রকম বাক্যলাপের উদ্দেশ্য কি ছিলো? একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে অবাধে যেতে পারে এবং তার সাথে সব রকমের কথাবার্তা বলতে পারে।
আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, মহিলা এভাবে জবাব দিলো কেন যে, "একজন নারী বাজারী লোকদের কাছে নিজেকে কিভাবে সমর্পণ করতে পারে?" এর সহজ ও সরল জবাব হলো, যে হতভাগা আল্লাহর নবীর মর্যাদা বোঝেনা, সে যদি নবীকে যাদুকর, জ্যোতিষী, মিথ্যাবাদী, পাগল, কবি ইত্যাদি বলতে পারে, তবে সে তাঁকে 'বাজারী' বলতে পারবেনা কেন? মুনাফিকরা নিজেদেরকে 'সম্ভ্রান্ত' আর রসূল সা. এবং হিজরত করে আসা নিষ্ঠাবান সাহাবিগণকে 'ছোট লোক' বলতো। এ ধরণের প্রলাপোক্তিতে অবাক হবার কিছু নেই এবং এতে রসূল সা,-এর মর্যাদাএ খাটো হয়না। এখানে এ কথাও উল্লেখ্য যে, এই মহিলা যে শব্দটি ব্যবহার করেছিল তা ছিলো 'সূফা'। এর অনুবাদ 'বাজারী' করা শুদ্ধ নয়। কেননা 'বাজারী' কথাটার ভেতরে যে তাচ্ছিল্যের ভাব বিদ্যমান 'সূফা' শব্দটিতে তা নেই। আরবিতে 'সূফা' শব্দের অর্থ 'সাধারণ মানুষ'। ইংরেজিতে এর প্রতিশব্দ হলো Commoner।
আপনার সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, ইমাম বুখারি এ হাদিসটি বর্ণনা করলেন কেন এবং এ দ্বারা আপনার কি লাভ হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব এই যে, রসূল সা.-এর ব্যক্তিত্ব আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তিনি স্বয়ং এবং সাহাবায়ে কিরাম পরবর্তী লোকদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজ থেকে শিক্ষা লাভ করতে এবং অন্যদের কাছে তা পৌঁছিয়ে দিতে। এ ব্যাপারে তিনি এতো ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন যে, নিজের ঘরোয়া জীবনের সম্পর্ক এবং দাম্পত্য জীবনের খুটিনাটি বিষয়ও গোপন রাখেননি। সবকিছুই তিনি সহাবিদের সামনে তুলে ধরেছেন। অত:পর সাহাবিগণও প্রতিটি বিষয় অকুণ্ঠচিত্তে এবং কোনো নিন্দা সমালোচনার তোয়াক্কা না করে পরবর্তী লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। রসূল সা. এবং সাহাবায়ে কিরাম যদি চাইতেন, তাঁর একটি কৃত্রিম ও আংশিক ভাবমূর্তি মানুষের সামনে প্রতিফলিত হোক, তাহলে হয়তো এ ধরণের গোপন বিষয় প্রকাশ পেতোনা। কিন্তু প্রতিটি জিনিস অবিকলভাবে ব্যক্ত করে সাহাবায়ে কিরাম তাবেঈন ও হাদিস সংগ্রাহকগণ তাদের সর্বোচ্চ সততা ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত এভাবে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার কোনোটিই রসূল সা.-এর মর্যাদা খাটো করেনা।
প্রশ্নকারীর ভেবে দেখা উচিত ছিলো, যে মহিলার বিয়ে নিজের ও তার অভিভাবকের সম্মতিতে সম্পন্ন হয়েছে। সে যদি পরে সেই বিয়ে প্রত্যাখ্যান করে এবং স্বামীর মুখের উপর বলে দেয়, আমি তোমাকে নিজের চেয়ে নিম্নস্তরের মানুষ মনে করি, তাহলে সাধারণ অবস্থায় স্বামী তাকে জব্দ করার জন্য দাম্পত্যসূলভ সম্পর্ক স্থাপনে তো বাধ্য করবেই, অধিকন্তু উত্তম মাধ্যমও দেবে অথবা ঝুলন্ত রেখে দিয়ে এমন শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করবে যে, রানী মহারানী হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে একেবারেই বের হয়ে যাবে। কিন্তু রসূল সা. তার সাথে এই আচরণ করেননি। তিনি এই মহিলার স্বামীই শুধু ছিলেননা, বরং মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের শাসকও ছিলেন। তথাপি তিনি তার উপর কোনো জোর জবরদস্তি বা বাড়াবাড়ি করেননি। বরং সে যখন নিজের নির্বুদ্ধিতা ও দুর্ভাগ্যবশত নবীর ঘর করতে অস্বীকার করলো, তখন তিনি তাকে তৎক্ষনাৎ আভাসে ইঙ্গিতে তালাক দিয়ে দিলেন এবং কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বিদায় করে দিলেন। এতো ধৈর্য, সহনশীলতা ও মহানুভবতা প্রদর্শন করা কেবল একজন নবীর পক্ষেই সম্ভব। ভাবতে ভাবতে অবাক লাগে যে কতোক লোক এ ব্যাপারেও আপত্তি তোলার চেষ্টা করে।
জবাব দিয়েছেন বিখ্যাত গোমরাহ, ইসলামের দুষমন, মারেফাতের শত্রু (???) মাওলানা মওদূদী (রহ)।
[তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৬৬]
বিষয়: বিবিধ
১৯৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন