ইলিশের আকাল, দায়ী কারা ? আঞ্চলিক নয়, জাতিয় সমস্যা

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নতরী ০১ জুন, ২০১৩, ১০:২৮:২৭ রাত





চাঁদপুর কে বলা হতো ইলিশের শহর। এই ভরা বর্ষায় ইলিশের মোকাম গুলো থাকতো কোলাহল পূর্ণ। আজকে ইলিশের মোকামগুলো তে পিন পতন নিরবতা। হাজার হাজার জেলে সহায় সম্বল বিকিয়ে দিয়ে জাল তৈরি করেও নদী থেকে লোকশান দিয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। শত প্রচেষ্টার পরেও মেঘনায় ইলিশের স্বাভাবিক আমাদানী ঘটানো যাচ্ছে না। জেলেরা ভাবছেন তারা বোধহয় মাছ ধরা ভুলে গেছেন। কি এমন কারণ ঘটল যাতে মেঘনা এবং পদ্মার সংঙ্গম স্থল চাঁদপুরে ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে। আমরা যারা স্থানীয় সাংবাদিক তারা এ বিষয়ে একাধিক লেখা লিখেছি কিন্তু আসল সত্য লেখার মতো পরিবেশ আমরা পাচ্ছি না। আমাদের জেলার একজন শক্তিশালী মন্ত্রী এবং তার সিন্ডিকেট গোটা মিডিয়াকে দমন করার দারুন কিছু কৌশল বাস্তবায়ন করে নিয়েছেন। এই বিষয়ে পরে আসছি। মেঘনার বালু মহলের হরিলুট ও ইলিশ শূন্যতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমি আমার কৈশরের একটি স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই, তাহলে আপনারা হয়তো কিছুটা হলেও উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, কি পরিমান শূন্যতা এবং হতাশা আমাদের মাঝে বিরাজ করছে।

ছোট বেলায় পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষ করে আমাদের এক দুর সম্পর্কের আতœীয়র বাড়িতে আমরা বেড়াতে গেলাম। তারা সম্পর্কে আমাদের মামা হন। পেশায় তারা সবাই ছিল প্রভাবশালী জেলে। নিজেরা নদীতে যাওয়ার সাথে সাথে প্রচুর পরিমান দাদন তারা দিয়ে রেখেছিলেন। ফলে জেলে এবং নদীতে তাদের একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল মাছের মোকামে। তাদের জালের বিশাল গোডাউন আমার চোখে এখনো ভাসছে। কি বিশাল পরিমান জাল নিয়ে তারা নদীতে নামতেন তা বর্ননা করার মতো ভাষা জ্ঞান আমার নেই। তখন কিন্তু নদীতে কোন ঝাটকা বিরোধী অভিযান ছিল না। ঝাটকা শব্দটি তখন ছিলো না বললেই চলে। সাধারন জেলেরা বড় মাছ ধরেই কুল পেতনা সেখানে ছোট মাছের বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ কোথায়।

একদিন আমরা দুই ভাই আবদার করলাম যে তাদের সাথে নদীতে মাছ ধরা দেখতে যাবো। তাদের বিশাল মাছের ট্রলার গুলোর যে সৌন্দর্য্য ছিল এখন আর নদীতে সেই ধরনের ট্রলার আপনি খুজে পাবেন না। সমুদ্র অঞ্চলে হয়তো এরকম কোন ট্রলারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বর্তমানে মেঘনা বা পদ্মার মাঝে এই জাতীয় ট্রলার বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে যারা সমুদ্রে যান তারা ছাড়া আর বাকিরা কেবল মাত্র ছোট খাটো নৌকা নিয়েই মাছ ধরতে বের হন। তাদের সেই বিশাল নৌকা গুলো আগের মতো দেখা যায় না। যাই হোক, কথা মতো আমরা ট্রলারে উঠে বসলাম। ট্রলার যথারিতী আমাদের কে নিয়ে ছুটে চলল। ইলিশের নগরীতে বাস করি কিন্তু জীবন্ত ইলিশ কখনো দেখা হয়নি, এবার ইলিশ মাছ হাত দিয়ে জাল থেকে বের করতে পারবো, বিষয়টি ভাবতেই কেমন যেন উৎফুল্ল হচ্ছিলাম। যে মামাদের সাথে ছিলাম তারা আমাদের আনন্দের মাত্রা আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়ে জানালেন যে, দুপুরের খাবার আমরা শুধু মাত্র ইলিশ ভাজা দিয়েই খেতো পারবো, তাও আবার নদী থেকে সদ্য তোলা মাছ দিয়ে। ইলিশ মাছের প্রতি তাও আবার কড়া ভাজা মাছের ওপর আমার প্রচন্ড আগ্রহ। ভাবতেই ক্ষিধা বেড়ে যেত। এখন অবশ্য মাছের সেই স্বাধ আর তেলের পরিমান নেই বললেই চলে। এক সময় এমন হতো যে, পাড়া বা মহল্লার কোন ঘরে ইলিশ মাছ ভাজা হলে গোটা পাড়ার সকল বিড়ালেরা টের পেয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানের ইলিশ মাছ ভাজার সময় ঘরের কোনে পড়ে থাকা বিড়ালটিও টের পায়না বললেই চলে।

তারা তাদের জাল গুলো বিছিয়ে দিয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক অপো করলো। এর পর আসলো সেই মহেন্দ্র ন যার অপোয় আমরা দুই ভাই সেই সকাল থেকে রোদে পুরেছি। একে একে জালগুলো যখন ট্রলারে টেনে তোলা হচ্ছিল, তখন জালের মাঝে ইলিশের ঝাক দেখে আমি তখন আনন্দে আতœহারা। আমরা দুই ভাই তখন মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভুলে গেলাম যে, আমরা এই প্রথম নদীতে মাছ দেখছি। ইলিশের গায়ে সূর্যের আলোতে যে অপরূপ আভা তৈরি হয়েছিল তা যেন আমার চোখে এখনো ভাসছে। প্রচুর পরিমান ইলিশ তোলা হলো। ইলিশের একেকটির ওজন ছিল দুই থেকে তিন কেজি গড়ে। এর মধ্যে কয়েকটি ইলিশ খুব বড় বড় ছিল যেগুলো দুপুরের খাবারের জন্য ট্রলালের মধ্যেই ভাজা শুরু হলো। আমরা যে থালা গুলোতে ভাত খেয়েছি তা ছিল মাটির তৈরি। ইলিশের একটি টুকরো যখন আমাদের থালাতে রাখা হলো তখন দেখা গেল যে, মাছের টুকরোর কারনে নিচে ভাত দেখা যাচ্ছিল না, পুরো থলেতে মাছের একটি টুকরো রাখা যাচ্ছিল না। সেই দিন আমরা দুই ভাই এতো পরিমান ইলিশ ভাজা খেয়েছি যে, নদী থেকে ফেরার পরে আমার সাথে থাকা বড় ভাই আর ইলিশ মাছ খেতে পারেনি। ইলিশ তার অন্তর থেকে এমন ভাবে ফিরে গেছে যে, আজো অব্দি সে ইলিশ খেতে পারে না। ইলিশ খেতে গেলে তার সমষ্যা হয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরে তারা আবার জাল ফেলতে শুরু করল। প্রথম বারে তারা বিপুল মাছ পেয়েছিল। একজন বলছিলেন যে, তারা এখন ইলিশের চাকের মধ্যে অবস্থান করছেন, তাই এই সুযোগ তারা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। কথা মতো আবারও জাল ফেলা হলো। এবার যেই জালগুলো ফেলা হয়েছিল সেগুলো বিশেষ ধরনের জাল ছিল। আগের বারের জালগুলো কিছুটা রিপেয়ারীং করে পরবর্তিতে নদীতে ফেলতে হবে। তাই এবার তারা নতুন জাল ফেলছেন। নদীতে জাল বিছিয়ে দেওয়ার আধ ঘন্টা পরে আমরা অনুভব করলাম যে, আমাদের ট্রলারটি কেমন যেন দণি দিকে চলে যাচ্ছে। বাতাস কিন্তু দণি দিক থেকে উত্তরের দিকে বইছে, সেই হিসেবে আমাদের ট্রলার উত্তরে যাওয়ার কথা কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। বিষয়টি সবাই প্রথমে বুঝতে পারে নি। কিন্তু যখন তারা খুব ভালো করে খেয়াল করলেন যে, তাদের জালে এতো বিশাল এক ইলিশের চাক ধরা পরেছে যে, তারা সবাই চেষ্টা করলেও জাল টেনে উপরে তুলতে পারবেন না। বেশিন দেরি করলে হয়তো মাছের প্রেসারে জাল সহ ট্রলার নদীতে ডুবে যেতে পারে। প্রচন্ড গতিতে ইলিশের চাকটি আমাদের জালকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয় টি আচ করতে পেরে জেলেরা তাড়া তাড়ি নিজেদের জাল কেটে দিতে লাগলেন। এক এক করে সবগুলো জাল তারা কেটে দিয়ে ভাটির দিকে ট্রলার ঘুরিয়ে দিলেন। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমরা মাছগুলো তুলতে পারলাম না কেন। মামা জবাব দিলেন যে, এতো বিশাল মাছের চাক যে, আমরা একশ মানুষও যদি জাল টানা শুরু করে দেই, তাতেও আমাদের কোন লাভ হবে না, বরং মাছের টানে নিজেদের ট্রলারটি হাড়াতে হতে পারে। জাল হাড়ালে জাল করা যায় কিন্তু ট্রলারের কোন তি করা যাবে না।। তাছাড়া যে পরিমান মাছ তারা প্রথম বার পেয়েছিল তাতেই নাকি সব খরচ বাদ দিয়ে এরকম তিনগুন জাল কেনা যাবে। বাড়িতে এসে যখন আমি বিস্ময় নিয়ে সবাইকে এ ঘটনা খুলে বললাম তখন আমি বুঝতে পারলাম যে এতে তারা কেউই অবাক হননি কারণ এধরনের জাল কেটে দেয়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে।

আমি আশা করছি পাঠক হয়তো কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইবেন যে, সেই মাছের চাক এখন নেই কেনো। কি তার কারণ। যদিও সরকার মেঘনার চর আলেক জেন্ডার থেকে চর দুখিয়া পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলকে অভয়ারন্য ঘোষনা করে বিশেষ একটি সময়ে মা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে এবং সারা বছরের মধ্যে তিন মাস ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে দিয়ে ইলিশের প্রজাতিকে রক্ষার চেষ্টা করতে চাচ্ছেন। এরি অংশ হিসেবে জেলা কোস্টগার্ড বাহিনী প্রায় বত্রিশ কুটি টাকার জাল পুরিয়েছে বলে পত্রিকা মারফত জানা গেছে। এই বিশাল পরিমান জাল কিন্তু এমন সব জেলেদের যারা বিভিন্ন আড়ৎ থেকে বা কোন মহাজন থেকে চড়া সুদে লোন নিয়ে করেছেন। তাদের কে এই পরিনতি ভোগ করার কিছু কারনের মধ্যে একটি হলো যে, নিষিদ্ধ গোষিত মাসেও দলিয় পরিচয়ে বিভিন্ন জেলেরা কোষ্ট গার্ড এবং স্থানীয় সিন্ডিকেটের সাথে আতাত করে জাটকা ব্যাবসার পসরা সাজিয়ে বসেন। যাল ফলে দরিদ্র জেলেদেরকে এক প্রকার ঝুকি নিয়ে পেটের দায়ে এই অপরাধ করতে হচ্ছে। সরকারের এত সব চেষ্টাও বুমেরাং হয়ে ফল হচ্ছে তার উল্টো। দিন কে দিন মাছের পরিমান কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে মেঘনায় এখন আর সেই রকম জাল নেই। কিছু দিন আগে আমাদের স্থানীয় আলোকিত চাঁদপুর পত্রিকায় ইলিশের মন লাখ টাকা শিরোনামে এই বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন আলোকিত চাঁদপুরে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এবং ব্যাবস্থাপক মোঃ মাসুদ আলম। প্রতিবেদকের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি যে তথ্য দেন তাতে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ”বর্তমানে মৌসুমে চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশের দেখা মিলছেনা। শত শত জেলে দিন ও রাতে নদীতে ইলিশ আহরনের চেষ্টা চালিয়ে অধিকাংশ জেলে ফিরছে খালি হাতে। যত সামান্য ইলিশ পেলেও তার দাম আকাশচুম্বী। নদী তীরবর্তী এলাকার আড়ৎগুলো ১ কেজি ওজনের বেশী একটি ইলিশের বর্তমান মূল্য আড়াই হাজার টাকা। প্রতি মন ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ল টাকা দরে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার হানাচর ইউনিয়নের হরিণা ফেরিঘাট এলাকায় কিছু কিছু জেলে যত সামান্য ছোট ছোট ইলিশ আড়তে বিক্রি করছে। দীর্ঘ সময় অপো করে দেখাগেছে অনেকেই ইলিশ না পেয়ে ফিরছে খালি হাতে। হরিণাঘাটে ইলিশ জেলেদের শত শত নৌকা ঘাটে বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। একাধিক জেলের সাথে আলাপ করে জানাগেছে, মেঘনায় প্রতিদিন একই নৌকায় ৫ থেকে ৭জন জেলে ইলিশ শিকারে নামে। সারাদিন মেঘনায় চষে বেড়ালেও দেখা মিলেনা কাংখিত ইলিশের। মাঝে মধ্যে ২/১টি পেলেও তা সাইজে অনেক ছোট। তবে রাতের বেলায় কিছু কিছু জেলে ১ কেজি কিংবা তার চেয়ে বেশী ওজনের ইলিশ পায়, তাও খুবই কম। ”।

ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাবসার কাজে আমাকে প্রায় জেল দণি অঞ্চলে যাতায়াত করতে হয়। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন আড়ৎের দরজায় বড় বড় তালা ঝুলতে দেখে বুঝতে পারলাম যে, ভর মৌসুমেও ব্যাবসায়ীরা ইলিশ শূন্যতায় ভুগছে। জেলার বিশাল একটি অংশ এই নদীর সাথে সম্পর্কিত। হাজার হাজার জেলে এমন রয়েছেন যারা কেবল মাত্র মাছ ধরার ওপর জিবীকা নির্বাহ করে থাকেন। ইলিশের এই আকালে জেলেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখলাম, জেলার মাছের মোকাম গুলো এখন খা খা করছে। মাছ শূন্যতায় ভুগছে আড়ৎ গুলো। এক এক কেজি মাছের দাম পড়ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। কিছুটা ছোট সাইজের মাছ ধরা পড়লে তাও এক হাজার টাকা কেজির নিচে নয়। এ অবস্থায় সাধারন মানুষতো দুরে থাক অনেক উচ্চ বিত্তরাও ইলিশ কিন্তু ইতস্ত করছেন। যারা বড় বড় ইলিশের আশায় মোকাম গুলো তে ফোন করছেন তারাও হতাশ হচ্ছেন। এই অবস্থায় কি করা দরকার সে বিষয়ে আলোচনা করার আগে আমরা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করছি। এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই সমাধানের বিরাট অংশ নিহীত রয়েছে বলে আমরা মনে করছি।

১. নদীতে মাছের আকাল রোধে সরকারের নিষেধাজ্ঞা কোন কাজে আসছে না কেন ?

২. অভ্যায়ারন্য ঘোষনার পরেও কি করে অসংখ্য জেলে মা মাছ ধরার সুযোগ পায় ?

৩. নদীর নাব্যতায় এমন কি সমষ্যা হয়েছে যেখানে মাছেরা তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।

৪. মাছের এই আকাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে সরকার কে বহু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকার গুলো এর কয়টি পরামর্শ বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়েছেন।

প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরাও খোজার চেষ্টা করি কিন্তু সঠিক উত্তর মনে হয় এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়।

গবেষকরা মাছের এই আকালের জন্য কিছু উদ্ভেগপূর্ণ তথ্য দিয়ে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের দেয়া সে সকল তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের জেলেদের কে তিন মাস নদীতে নামতে দেয়া হয় না। ঝাটকা বিরোধী অভিযান পরিচালিত করা হয়। বিপুল পরিমান কারেন্ট জাল জব্দ করা হয় এবং যথারিতী পুরিয়ে ফেলাও হচ্ছে কিন্ত ইলিশের সুদিন যেন আর ফিরছে না। একটি বিশাল অঞ্চল কে মাছের নিরাপদ আশ্রম হিসেবে ঘোষনা করেও মা ইলিশকে মেঘনা মুখি করা যাচ্ছে না। ইলিশের বংশ রায় বিশেষ কিছু সময়ে মাছ ধরা স¤পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

গত বছরের তুলনায় এবার ইলিশ উৎপাদন হয়েছে চার ভাগের এক ভাগ। আমরা স্থানীয়রা সেই ইলিশ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। দু চারটা বড় ইলিশ যদিও বা ধরা পরে, তাও আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে, আর আমাদের জন্য থেকে যায় টেম্পু খ্যাত ছোট ইলিশ।

আমাদের মেঘনার এই হাল কিন্তু আমাদের হাতের কামাই। বিষয়টি যদি আমি ব্যাখ্যা না দেই তাহলে হয়তো লেখাটিই অস¤পূর্ণ থেকে যাবে। চাঁদপুুরের মেঘনা কেবল ইলিশের জন্যই বিখ্যাত এমন নয়। আমাদের মেঘনায় রয়েছে বিশাল এক বালু মহল। এই বালু মহলকে ঘিরে চলে দারুন এক ব্যবসা। বি এন পি মতায় থাকা কালিন সময়ে তাদের এমপি ও পাতি নেতাদের দখলে ছিল এর ব্যবস্থাপনার ভার। বর্তমানে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পরে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একান্ত লোকজনের তৈরি সিন্ডিকেট সেটার দেখ ভাল করেন। প্রায় প্রতিদিন ল ল টাকার বালু বেচা কেনা হয় এখানে। নিন্দুকের অবশ্য বলেন যে, এর একটি বিশাল একটি অংশ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিদিন পেয়ে থাকেন। জেলার পত্রিকাগুলো এই বিষয়ে কোন রিপোর্ট করার সাহস করবে না। কারণ হচ্ছে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনায় সামান্য বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হলে সেটাকে আইন সিদ্ধ করে নিয়েছেন আমাদের ক্ষমতাসিন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা দাবি করেন যে, কোর্টের অনুমতি নিয়ে তারা বালু মহল থেকে বালূ উত্তোলন করছে। অথচ হাইকোট যে পরিমান বালু উত্তোলন করার নির্দেশ দিয়েছেন সে পরিমান বালু উত্তোলন করতে সময় লাগে মাত্র চার ঘন্টা। অথচ পাচঁ বছর ধরে বালূ উত্তোলন হচ্ছে। এই কাজটি কে জায়েজ করে দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্দ করে দেওয়া হয়েছে কয়েকভাবে।

এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে জেলার সাংবাদিকদের নেতৃত্ব্যদানকারী প্রতিষ্টান প্রেস কাবকে বিপুল পরিমান টাকা অনুদান দিয়ে, নিজের পছন্দের কয়েক জন সাংবাদিক কে প্রেস কাবের নেতা নির্বাচিত করে এটিকে সিন্ডিকেটের অফিস হিসেবে ব্যাবহার করে ুদ্র মিডিয়াগুলো কে নিয়ন্ত্রন করা হচেছ। যেসব পত্রিকা সাহস দেখানোর চেষ্টা করেছেন সেগুলোর সার্কুলেশান বন্দ করে দেওয়া হয়েছে ঠুনকো অযুহাতে। গোটা চাঁদপুরের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারন জনগন ও ভালো করে জানেন যে, চাদপুরের সকল কর্মকান্ড কারা নিয়ন্ত্রন করেন এবং কিভাবে করেন। জেলার লোকজন বিশ্বাস করে যে, জেলায় দুটি সরকার ব্যাবস্থা রয়েছে। একটি জেলা প্রশাসক অন্যটি আওয়ামী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব্যে আছেন আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ার খাস লোক। তাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গোটা চাঁদপুরের বানিজ্য। সাধারন একটি যৌতুকের মামলা নিতে গেলেও স্থানীয় থানাগুলোকে এই সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়।

এই সিন্ডিকেটের ক্ষপ্পরে পড়ে আমাদের জেলার কয়েক শত নিরিহ মানুষ তাদের বাপদাদার ভিটে মাটি ছাড়া হয়েছেন। কেউ কেউ পানির দরে সিন্ডিকেটের কাছে নিজের জমি বিক্রি করে দিয়ে কোন রকমে জানটা বাচিয়েছেন। মেঘনার বালু মহল তো এখন হরিলুটের আস্তানা। এখানে কোন আইন নেই, নেই দেশের মানুষের স্বার্থ্য। এই বালূ মহল থেকে দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকার ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে। এর একটি বিশাল অংশ ভোগ করছে আওয়ামী সিন্ডিকেট।

আমরা স্থানীয় সাংবাদিকরা এ জাতীয় অনাচারের বিরুদ্ধে চাইলেও লিখতে পারছি না। আমাদের স্থানীয় পত্রিকাগুলো এক ধরনের সেন্সরশীপের মধ্যদিয়ে কাজ করছে। মন্ত্রী এবং তার স্থানীয় গডফাদারদে নেতৃত্ব্যে করা সিন্ডিকেটের ভুমিকা এতোটাই উগ্র যে, কারো পইে সম্ভব হচ্ছে না বাস্তবতা তুলে ধরার। চামচামী করে পত্রিকা গুলো টিকে আছে। যদি মেঘনার বুকে ইলিশের সেই সুদিন কে ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে একে জাতীয় সমষ্যা হিসেবে ঘোষনা করা এখন সময়ের দাবি। পাশা পাশি দল মত নির্বিশেষে সকল ব্যক্তিবর্গেল সাথে আলাপ আলোচনা করে, বিশেষজ্ঞদের সম্বনয়ে একটি প্যানেল করে মেঘনার বুক থেকে সকল অনাচার কে দুর করতে হবে। ঝাটকা নিধনের নামে অমানবিক কাজ বন্ধ করতে দল মত ভুলে স্বিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় সেটা নয়, দেশের সম্পদ লুট পাট হবে এটাই এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিন্তু সর্বনাশা কথা হচ্ছে এই যে, প্রতিনিয়ত ড্রেজিং করার মধ্যদিয়ে বিশাল বালু অংশকে কেটে নেওয়া হচ্ছে, যার কারনে মেঘনার ভাঙ্গন দিন দিন বেড়ে চলছে এবং একারনে নদীর নাব্যতা এক মুখি হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীর পুর্ব দিকের বিশাল অংশ ভেঙ্গে নদীর গতি পথ কে পাল্টে দিচ্ছে। তাছাড়া শান্ত নদীর তলদেশে বিশাল তৎপরতা ইলিশের নিরাপদ যাতায়াত কে বাধাগ্রস্ত করছে।

অন্যদিকে পহেলা মার্চ থেকে পুরো এপ্রিল জুড়ে নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করলেও সেটা যেন কাজগে কলমে সাধারন জেলেদের জন্য করা হয়। কয়েক জন জেলের সাথে আলাপ করলে তারা বিষয়টি আমাদের নজরে আনেন। তারা দাবি করেন যে, দুই মাস নদীতে নামতে না দিয়ে সরকার আমাদের জন্য যেটুকো রিলিফ বরাদ্ধ করে তার বিশাল অংশ চলে যায় দলিয় লোকজনের ঘরে, যাদের বেশির ভাগের পেশা কোন অবস্থায় মাছ ধরা নয়। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দলিয় লোকজন কে এসব রিলিফ বিলি করে থাকেন। জেলেরা যেটুকো সামান্য পায় তাতে তাদের কোন অবস্থায় সংসার চলে না। অন্যদিকে সাধারন জেলেদের কে নদী থেকে তুলে দিয়ে দলিয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তালিকা করে কোষ্টগার্ডের সহায়তায় কেবল মাত্র দলিয় জেলেদের কে নদীতে মাছ ধরার সুযোগ করে দিয়ে স্থানীয় সিন্ডিকেট কুটি কুটি টাকার ঝাটকা নিধন করে থাকে। যার ফলে সাধারন জেলেরা বাধ্য হয়েই অবৈধ জেনেও ঝাটকা নিধনের কাজে লেগে যান। এভাবে তারা নিজেদের পেটের তাগাদায় দেশের অমিত মৎস শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতেও দ্ধিধা করছেন না। তাদের ভাষায়, যে দেশে ইনসাফ নাই, সে দেশে আল্লাহর নেয়ামত দিন কে দিন কমতে থাকে। গরিব জেলেদের জাল পুরিয়ে দিয়ে নিজেদের দলের নেতাকর্মীদের নদীতে নামিয়ে দিয়ে ঝাটকা ধরার যে মহানিধনযজ্ঞ চালু করে তার পরিনতিতেই মেঘনায় ইলিশের আকাল দেখা দেয়।

দলিয় বিবেচনায় কিছু লোককে নদীতে নামিয়ে দিয়ে ব্যাপক পরিমানে ঝাটকা নিধনের মাধ্যমে ইলিশের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধার সুষ্টি করে ইলিশের প্রজাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। ইচ্ছে মতো মা মাছ নিধনের কারনে ইলিশের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যহত হচ্ছে। সাথে যোগ হয়েছে নদী ভাঙ্গন। এই ভাঙ্গনকে ঘিরে রয়েছে আমাদের নেতা নেত্রীদের বিশাল এক বানিজ্য। ভাবটা যেন এমন যে, এই নদী ভাঙ্গন তাদের জন্য আল্লাহর রহমত। এক দিকে নদীর দুপারে ভাংগন তৈরির কাজ করছেন, অন্যদিকে ভাংগন রোধ করার জন্য একনেকে তহবলি বরাদ্দ নিয়ে নিজেদের পকেট ভড়ছেন।

মেঘনায় অবৈধ বালূ উত্তোলনের কারনে এর দু পাশে ব্যাপক ভাংঙ্গন শুরু হয় এবং নদী তার স্রোত কে হাড়িয়ে ফেলে। স্বাভাবিক ভাবে মাছেরা তাদের গতি পথ হাড়িয়ে ফেলে। এভাবে মেঘনার ইলিশের সহজ সরল যাতায়াতে আমরা নিজেরা বিশাল এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে মেঘনাকে ইলিশ শূন্য করায় বিপুল ভুমিকা রেখেছি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। ইলিশ এখন তার গতি পথ পাল্টে দিয়েছে। ভরা মৌসুমে ইলিশের এই আকালে চাঁদপুরের হাজার হাজার জেলেরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। ইলিশের মোকাম এবং এর সাথে জড়িত আরো হাজার হাজার পরিবার অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে।

দেখা যায় যে, নিষিদ্ধ অভিযান চলা কালে দলিয় পরিচয়ের কারনে এক শ্রেণীর জেলে প্রকাশ্যে অবাধে ঝাটকা নিধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নিরীহ জেলেরা দিনের পর দিন মানবেতর জীবন যাপন করে। সরকারী ঘোষিত তাদের প্রাপ্য হক পর্যন্ত তারা ঠিক মতো পায় না। এ অবস্থায় জেলেদের মধ্যে এক ধরনে ােভ বিরাজ যা তাদের কে ঝাটকা নিধনে উদ্ভদ্ধ করে তোলে। সর্ব শেষে আমরা একটি কথাই বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের পাপের কারনেই তার বরকত কে তিনি উঠিয়ে নিয়েছেন। এ সমষ্যা থেকে উত্তরনের জন্য আমাদের উচিত হবে মেঘনার পরিবেশের ভারসাম্যতা আনা এবং নদীতে ইনসাফ কায়েম করা। অন্যায় ভাবে দলীয় পরিচয় দিয়ে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ করতে হবে। আল্লাহর এই নেয়ামতকে সবার জন্য সমান ভাবে উন্মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় কেবল মাত্র ওপর ওয়ালার ব্যাবস্থা গ্রহনের আশায় বুখ বেধে আবার সেই ইলিশের জোয়ার দেখার অপো করা ছাড়া আমরা সাধারন মানুষ আর কিইবা করতে পারি।

বিষয়: বিবিধ

৪৬৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File