শতাব্দী ( থেমে থাকা সময়ের গল্প )
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৭ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৩১:৫৬ সকাল
বর্ষা তার দিন শেষ করেছে, শীত তার শুষ্কতাকে তার কাছে রেখে দিয়েছে, শরৎ এসেছিল কিনা স্মরণে নেই, তবে আজ যে দখিনা বাতাস বইছে এটা ফাগুনের আগমনবার্তা। কোকিলের স্বর মাঝে মাঝে হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করেছে, পুষ্পকলি প্রস্ফুটিত হবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে, সবার মনে আজ নতুন রঙ, এই রঙ সবাইকে উৎফুল্ল করে তোলে, মনহীন মানুষের মনে মন আনে, অতি শোকাহত এর আগমনে হৃদয় থেকে শোকের পাহাড় ছুঁড়ে ফেলে, কথিত আছে বসন্তের আগমনে হৃদয়ের কিশলয়গুলো উড়ু উড়ু করে। এমনি এক দিনে রাহমানবাড়িয়া শহরের মাঝে জমিদার গোছের এক বাড়ির জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। তার চোখ মায়াবী, অজস্র ইতিহাস তার চোখে, তার চোখের ভাষার কথা বলা আমার সাধ্যে নেই। তবে ক্ষীণ চেষ্টা করা দোষনীয় নয়। বলা যেতে পারে এভাবে, বর্ষা তার সমস্ত মুখমণ্ডলকে সিক্ত করে দিয়েছে আর শীত সব সিক্ততা মুছিয়ে দিয়েছে তবে সে পায় নি তার চোখে প্রবেশের অধিকার। চোখ মায়াবী হলেও তার মুখাবয়ব অন্য কথা বলে। চোখের একটু নিচেই তার নির্ঘুম রাতের কালসিটে দাগ। ঠোঁট দুটো শুকনো, চওড়া কপালটায় কোন ভাজের রেখা নেই, অথচ সমস্ত মুখাবয়বটি দেখলে মনে হবে- একটা পাথরের ফ্রেমে দুটি তরল বৃত্ত ছলছল করছে।
এভাবেই তাকিয়ে থাকে সে প্রতিদিন, সকালে আর বিকালে। রোজকার মত সেদিন বিকালে তাকিয়ে ছিল সে। সামনের মাঠে খেলা করছে অনেক ছেলেরা। একটা মাঠকে ছয়-সাতটা অলিখিত ভাগে বিভক্ত করে ক্রিকেট খেলছে সবাই। এ বিস্তৃত জগতে এদেশের ছেলেদের ঠাই মেলা ভার। অতিরিক্ত জনবসতিতে পূর্ণ এদের জগত। গায়ে গা লাগিয়ে তোলা হয়েছে দালান-কোঠা কিংবা কুঁড়ে ঘর কিংবা মাটির ঘর। তিল পরিমান জাগা পাবার জো নেই। তো যাই হোক, এদেশের জনবসতির কথা বলতে গেলে আমার আর কিছুই বলা হবে না। রমণীটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি দেখছে এটাই এখন যথাযথ প্রশ্ন।
কোন পথচারী যদি তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভালোভাবে লক্ষ করে তবে নিশ্চিত করে সে বলতে পারবে তার দৃষ্টি কোন দিকেই নেই। রাস্তার পরেই ব্যস্ত মাঠের দিকে তার দৃষ্টি নেই। আবার আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির দিকেও না। আসলে তার দৃষ্টি উদাসীনতায় ভরা।
একসময় পিছন থেকে তার মা তাকে বলে, “খেয়েছিস?”
২২-২৩ বছরের মেয়েটি এবার পিছন ফিরে চিরায়ত শাড়িপরা তার বিধবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার আগের মূর্তি ধারন করে। তার বিধবা মা ইতিমধ্যে তার উত্তর পেয়ে গেছে। আর কোন কথা না বলে তিনি চলে গেলেন। একটু পরেই আসল তার সদ্য বিবাহিতা চাচাতো বোন, দু’মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার। মুখে হাসি নিয়ে প্রবেশ করে সে, তবে তাকে (মেয়েটি) দেখে তার মুখের হাসি উবে গেল।। আস্তে করে গিয়ে সোফাতে বসল। তারপর চোখ মুছে মেয়েটির কাছে আসল। তার চোখে স্পষ্ট নোনা জল। তার মুখের পরিবর্তনটা দুপুরের উদ্দীপ্ত সূর্যকে হঠাৎ মেঘে ঢাকার মত।
“আপু কেমন আছেন?”
প্রশ্নের উত্তরে চাচাতো বোনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করল কিছুক্ষণ সে। চাচাতো বোনটি মেয়েটির কাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠের খেলা দেখল কিছুক্ষণ। তারপর যখন সাঝের প্রার্থনার সংকেত ভেসে আসলো, সে (চাচাতো বোন) চলে গেল।
মেয়েটি জানালা বন্ধ করে তার প্রার্থনা শেষ করল। প্রার্থনা শেষ করে টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারে বসে থাকে সে। একদৃষ্টিতে দেখতে থাকে টেবিল ল্যাম্পের আলো। কতটা সময় পার হল তা খেয়াল করার সময় নেই তার। খেয়াল ফেরে যখন তার ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া চাচাতো ভাইটি তার সামনে একটি খাতা রাখে। কলমটি খাতার উপর রাখা। কাটাকাটি করা অংকটি এক টান দিয়ে কেটে সঠিক সমাধান করে দেয় সে। ছোট্ট ভাইটি জানে তার আপুর কি যেন হয়েছে, কি যে হয়েছে তা আজো জানে না সে। সে শুধু অবাক চোখে তার আপুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
এরপর যে এসেছিল সে ছিল তার এক সহপাঠী। শহরের সবচেয়ে নোংরা মেয়ে ছিল সে। তার প্রেমলীলা এবং অবাধ মেলেমেশার কথা জানত না এমন কেউ ছিল না। তার বর্তমান অবস্থা ‘She is a gentle lady’। তার পতি একটা মোটা অংকের বেতনের সরকারী চাকুরীজীবী। যদিও সন্দেহ আছে এ বিষয়ে কেননা তার পতির বেতনের চাইতে হয়তো আরো কিছু আছে যা আরো মোটা অংকের। এরা আছে বলেই আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, তারা ঘুষ খায়। আর তারা এ কথায় লজ্জা না পেয়ে ডানপাশে শুধু শুন্য যোগের প্রতিযোগিতায় নামে।
যাই হোক, সে এসেছিল কয়েক ভরি স্বর্ণ ঝুলিয়ে। তার চোখে মুখে খুশির ছাপ। সে এসেই মেয়েটিকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগল। তার সুখময় জীবনের কথা বলতে লাগল। তাকে(মেয়েটি) বলে তার মত প্রফুল্ল হতে, বলে সব ভুলে যেতে। উত্তরে মেয়েটির নির্বাক দৃষ্টি ছাড়া কিছুই পেল না সে। গত তিন বছরে এরকম সাক্ষাৎ আরো হয়েছে, তাই এরকম আচরণে বিরক্ত না হয়ে তাকে দু’চারটি উপদেশ দিয়েই উঠে পড়ল।
রাতে চাঁদ উঠেছে, মেয়েটি জানালা খুলে চাঁদের আলোয় হাঁটু মুড়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের শুভ্র আলো তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। এটা ছিল গভীর রাতের কথা। তার বড় ভাই যে কিনা অতীতে উচ্ছৃংখল-মাতাল ছিল, সে ঘরের দরজায় এসে একটু উঁকি দিয়েই চলে যায়।
রাত আরো গভীর হয়, হঠাৎ মেয়েটির পাশে থাকা সেলফোনটার আলো জ্বলে ওঠে। কোন রিংটোন সেট করা অথবা ভাইবারেট ও করা ছিল না। তবে আলো জ্বলার সাথে সাথে চাঁদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা আস্তে আস্তে তোলে। একটা নাম ভাসতে দেখা যায় স্ক্রিনে। ত্রিশ সেকেন্ডের ঠিক আগ মুহূর্তে কল রিসিভ করে মাথা নিচু করে। প্রতি সপ্তাহেই একবার আসতো কলটি। সামান্য হ্যালো শব্দটাও বলে না মেয়েটি, অপর প্রান্ত থেকেও কোন কথা ভেসে আসে না। শুধু ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কানে চেপে ধরে কাঁপতে থাকে সে। শুধুমাত্র এই মুহূর্তেই তার পাথুরে আর কঠিন মুখাবয়বটা বর্ষণে সিক্ত হয়। তের মিনিট পর কলটি কেটে যায়, ব্যতিক্রম হয় নি কখনো এ নিয়মের।
উঠে দাঁড়িয়ে জানালার সিক ধরে আবার তাকায় চাঁদের দিকে মেয়েটি, তার দৃষ্টিতে এখন শুধুই আতঙ্ক।
বিষয়: সাহিত্য
৩০৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন