উপন্যাস: দ্য প্রাইম মিনিস্টার [পর্ব-৪]

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:১৭:৫৩ সকাল

The-Prime-Minister

ওই পাতাগুলো কোথায় গেলো? খুঁজে পাচ্ছি না ক’দিন থেকে। আব্দুল কি বাজে কাগজ মনে করে বাইরে ফেলে দিয়েছে? নাকি আমিই ভুলে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম। নাহ তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না। ভাগ্যিস আমার মনের পাতা হারিয়ে যায় নি। জং ধরা অবস্থায় মনটা পড়ে থাকলেও পাতাগুলো আছে। নাহ! ধুলোবালি পড়ে নি ওই পাতাগুলোতে। অনেক পাতা অবশ্য ঝরে গেছে অকালে।

তাঁর বাসা থেকে আমার বাসা কয়েক মিটারের দূরত্ব, তাই সবই আমি জানতাম। তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন একথা তাঁর বাবা- মা বলছিলেন, আমি ভেবেছিলাম তিনি তো পালিয়ে গেছেন, তবে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি চলে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য পূরণের জন্য। এখন বুঝি, তাঁর কথাই ঠিক, তাঁর কথা ভুল হতে পারে না। অন্ততঃ আমার কাছে নয়।

তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম শাহ্‌ পুত্রশোকে কাতর হলেন। এখানে ওখানে পুলিশ লাগালেন তাঁকে খুঁজে বের করতে। তবে তাঁকে পাওয়া গেলো না। তাঁর মমতাময়ী মা সেলিনা বেগমের চোখের জ্বল জানালার গ্রিলে জং ধরানোর পায়তারা শুরু করে দিলো। তবু তিনি আসলেন না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা, সাত বছর পর তিনি যেদিন ফিরে আসলেন। মুষলধারে বৃষ্টির সেই রাতে সেলিম শাহ্‌ আর সেলিনা বেগম খুশিতে আত্মহারা হলেন। আমি তাঁকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। তাঁকে দেখার জন্য ছাতা হাতে ছোট ভাইয়ের সাথে চলে গেলাম সেই মাঝরাতে। লম্বা, বেশ লম্বা হয়েছেন তিনি, অভিজাত গোঁফ তাঁর চেহারার গাঢ়ত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কাঁপা কাঁপা চোখে আমি তাঁর দিকে কয়েকবার তাকালাম। তিনি আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করে নরম স্বরে বলে, ‘আম্মু, কে এটা? চেনা মনে হচ্ছে।’

সেলিনা বেগম বলেন, ‘তোর সাথে স্কুলে পড়তো।’

আমি একমূহুর্ত আর সেখানে দাঁড়ালাম না। কেননা, বাড়িতে তখন আমার প্যারালাইজড বাবা। আসলে আমার পরিবারের অবস্থা তখন বেজায় খারাপ। মা তো তিন বছর আগে পরপারে গেছেন, তাঁর উপর বাবা দু’বছর থেকে প্যারালাইজড, একটা সড়ক দুর্ঘটনা তাকে অচল হতে হয়েছে। শুধু তাকে নয় তার সাথে একটা পরিবারকে। মামার সহযোগিতায় কয়েকমাস চললেও আমি জানি আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। ছোট এক ভাই আর বোনের দায়িত্ব এখন আমার উপরে। এককথায়, সে সময় আমি অথৈ সাগরে ডুবে ছিলাম, আমি কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তিনি হয়তো এসেছিলেন আমাকে সেই অথৈ সাগর থেকে উদ্ধার করতে।

পরদিন সকালেই স্যুট-কোট পড়ে তিনি আমার বাড়িতে এসে হাজির। আমি সাত সকালে তাঁকে দেখে বললাম, ‘হান্নাহ! আপনি?’

হ্যাঁ, তার নাম হান্নাহ শাহ্‌। তিনিই আমার জীবনের মহান পুরুষ, আমার জীবনের মনীষী।

তিনি বললেন, ‘চলো, আহসান স্যারের কাছে যেতে হবে।’

শীতের সকাল হওয়ায় গায়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে তাঁর সাথে হাঁটতে হাঁটতে চললাম, তিনি পথিমধ্যে কোনো কথা বললেন না। আমিও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমি শুধু একবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছেন?’

তিনি বললেন, ‘আমরা বন্ধু ছিলাম। তুমি শব্দটাই পারফেক্ট।’

আমি সাহস করে বললাম, ‘আচ্ছা তুমি কেমন আছো?’

তিনি বললেন, ‘বেঁচে আছি।’

-মানে?

-বেঁচে থাকটাই জীবনের স্বার্থকতা। প্রতিদিন পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কেউ রোগে কেউ শোকে। কেউ মারছে, কেউ মরছে।

আমি কি বুঝলাম জানি না, শুধু মাথা নেড়ে জানালাম আমি বুঝেছি। আমাদের একটা ভয়ঙ্কর অভ্যাস আছে, আমরা না বুঝেও বোঝার ভান করি, না ভালো থেকেও ভালো থাকার কথা সবাইকে বলি। বুঝা এবং ভালো থাকার মুদ্রাদোষ কবে এ সমাজ থেকে দূর হবে জানি না।

-আচ্ছা হান্নাহ, তুমি এতো বছর কোথায় ছিলে?

-কোনো এক জায়গায়।

একথা বলতেই তাঁর ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি ফোনটা বের করে প্রথমে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। তারপর কানে ধরে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন, তারপর বললেন, ‘শিশিশি! চুপ এসব কথা আমি শুনতে চাই না। কন্টাক্ট ফাইনাল হয়ে গেছে। তুমি ঠিক করেই জানো আমি আমার কথার খেলাপ করি না, সেটা আমার বিপরীতে গেলেও। রিকিকে কমপ্লিট করতে বলো কাজটা।’

ওপাশের কথা শুনে বলে, ‘তার পরপারে যাওয়া প্রয়োজন। তাকে দেশের দরকার নেই। সমাজের দরকার নেই। আমার কথার প্রতি আস্থা আছে তো? থাকলে দ্বিতীয় আর কোনো কথা নয়।’

আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কাজ! বড্ড বেশি কাজে জড়িয়ে পড়েছি। তিনদিন পরে আমাকে ফিরতে হবে।’

আমি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু অনুভব করলাম, একজন খুনীর সাথে হাঁটছি।

*********************************************

বিষয়: সাহিত্য

৯৫৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

284130
১৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:২০
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : আমি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু অনুভব করলাম, একজন খুনীর সাথে হাঁটছি।
Yawn Yawn Yawn
১৪ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪
227280
মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File