উপন্যাস: দ্য প্রাইম মিনিস্টার [পর্ব-৩]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১১ নভেম্বর, ২০১৪, ০৩:১২:৫৬ দুপুর
সেদিন থেকে সপ্তাহখানেক তাঁর দেখা আমি পায় নি, মনে হয় স্কুলে আসতো না। আমি তাঁকে খুঁজতাম। অকারণেই খুঁজতাম। কারণ আর অকারণ দু’টি আলাদা বিষয়। মানুষ কারণের খোঁজে অকারণে সময় অপচয় করে। আর আমি অকারণে কিসের খোঁজ করতাম তা এখন বুঝি, এই বয়সে এসে বুঝি। এখন বুঝি অনেক কারণের কোন সংজ্ঞা নেই, আকৃতি নেই, প্রকৃতি নেই।
সপ্তাহখানেক পরে তাঁর দেখা মিললো। টিচার্স রুমের দিকে হট্টগোলের শব্দ শুনে আমরা সবাই বাইরে বের হয়েছিলাম। দেখলাম, হন হন করে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। চোখে মুখে একটা তৃপ্তির ছাপ। আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যে আমি ভয় পাবো কিনা ভাবছিলাম। স্কুলের গেট পেরিয়ে তিনি চলে গেলেন। গেট পেরোনোর সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় দিলো।
একটু পরেই ঘটনাটা জানাজানি হলো, আহসান স্যারের পেটে ছুরিকাঘাত করেছিলেন তিনি। এটা ছিলো একটা দুঃসাহসিক কাজ। আমি বলবো, তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজ, এই ঘটনাটা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। তিনি নতুন এক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন শুধু এই ঘটনার জন্য। তাঁর জীবনের সব অপরাধ, সব প্রাপ্তি এই ছোট ব্যাপারটার ভিতর লুকায়িত ছিলো। এই ঘটনার গভীরতা এতোই বেশি।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়-জোড় চলছে আহসান স্যারকে। অথচ আমার সেদিকে নজর ছিলো না, আমার মনে তখন তাঁর সেই মহান চোখ। ঠাণ্ডা-শীতল সেই চোখে স্পষ্ট প্রতিশোধের ছাপ।
তিনি আমাকে পরে একদিন বলেছিলেন, ‘প্রতিশোধ নিতে কখনো দেরি করতে হয় না, কেননা সবাই প্রতিশোধ নিতে ভালোবাসে।’
আমিও কথাটা নিয়ে এক হেমন্তে ভেবেছিলাম। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, আসলে কেন তিনি আহসান স্যারকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন? হেমন্ত পার হয়ে বসন্ত আসলেও উত্তর খুঁজে পেলাম না, অথচ এক রুক্ষ গ্রীষ্মে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর পেলাম। আসলেই তো, আহসান স্যার কি তাঁর উপর প্রতিশোধ নেন নি? তাঁর টেরোরিস্ট হবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি প্রতিশোধ নেন নি? তাঁকে স্কুল থেকে বের করেছেন, তাঁর মহান শরীরে আঘাত করেছেন, ইংরেজিতে ভুল না থাকলেও ইংরেজিতে ফেল করিয়েছেন। এগুলো কি প্রতিশোধ ছিলো না?
এগুলো তাঁর কাছে প্রতিশোধের মতোই ছিলো। তাই প্রতিশোধের বদলা তিনি প্রতিশোধ দিয়েই নিয়েছিলেন। বাজার থেকে একটা চকচকে ছুরি কিনে এনে সেটা চালান করে দিয়েছিলেন আহসান স্যারের পেটে।
তবে আহসান স্যারের ভাগ্য ভালো তিনি সেবারে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এই আহসান স্যারই একদিন তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন, তাঁর সাহসিকতার সুনাম করতেন। আমাকে তো একবার চা বিস্কুটের দাওয়াত দিয়ে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ ছেলে। তুমি যে তার সেক্রেটারি এটা তোমার ভাগ্য।’
আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম। তাঁর সম্পর্কে কোন শব্দ উচ্চারণ করা আমার জন্য ছিলো নিষিদ্ধ। আজ আমাকে নিষেধ করার কেউ নেই, তাই তাঁর সম্পর্কে বলতে বাঁধা নেই। একটুখানি টেবিলের উপর তাকিয়ে দেখি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বড়ো মলিন তাঁর চোখ, বড় কঠোর তাঁর চোখ। তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই বাইরে গুলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। তড়িঘড়ি করে আব্দুল বাড়িতে ঢুকলো, আমাকে এসে বলতে থাকে, ‘বজ্জাতগুলো এবারে শায়েস্তা হবে।’
আমি বললাম, ‘কোন বজ্জাত?’
-কারা আবার? যারা বেআইনি অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর মানুষদের হত্যা করে।
-ভালো তো। সামনে পেলে পুলিশদের বাহবা দিয়ে এসো। কিন্তু মনে রেখো, সকল অকারণের কিছু না কিছু কারণ থাকে।
-এসব শক্ত কথা বুঝি না। ক্লাসের পড়া বুঝতে বুঝতেই অবস্থা শেষ প্রায়।
আমি বারবার ভুলে যায় আব্দুল কোন ক্লাসে পড়ে, তাই ওকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন ক্লাসে পড়ছো যেনো?’
- আর কতোবার বলবো আপনাকে? ক্লাস সেভেনে।
আমি মুচকি হাসলাম।
-যাই, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করি। আপনি আপনার কলম নিয়েই থাকেন।
বাইরের গুলাগুলির শব্দ থেমে গেলো, একটুও ভয় পায় নি আমি। অন্য কেউ হলে গুলির শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে পারতো, অথবা নানান রকম কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু আমার কাছে গুলির শব্দ কিছুই নয়, একদমই স্বাভাবিক, একদমই সামান্য।
*********************************************************
বিষয়: সাহিত্য
১০৯৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন