শুদ্র দ্য গংরিড: দুঃখপক্ষ
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ৩১ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:১৬:৪৩ সন্ধ্যা
যারা ধৈর্য সহকারে ফিকশন উপন্যাসটি পড়ছেন তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। আবার যারা শেষ হবার পর এক নিঃশ্বাসে পড়ার অপেক্ষায় আছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ।
- মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী
---------------------------------
‘না, শুদ্র বন্দীশালায় থাকতে পারে না। রাজা আজাকা এবার একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিল।’, পিরু বলে ওঠে।
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘ওরকম নয়। একটা কৃষকের ছেলের সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দিতে চাইলে সবাই কি তা মেনে নেবে? রাজার মান আছে সম্মান আছে, কিন্তু তা রক্ষার কবচ নিজেকে তৈরি করতে হয়।’
বাঘ বলে, ‘তুই যাই বলিস ভাগ্নে, শুদ্রের প্রতি এ বনের সব প্রাণীর মায়া আছে, সবার ভালোবাসা আছে, আর শুদ্রের এই কঠিন দিনে আমাদের কিছু করা উচিৎ।’
শিয়াল পন্ডিত বলে ‘চুক্তির কথা মনে নেই। মানুষদের কোন ভিতরের ব্যাপারে আমাদের নাক গলানোর অধিকার নেই।’
বাঘ বলে, ‘সেটা ঠিক। কিন্তু এটা শুধু মানুষের ব্যাপার নয়। এটা বনের ব্যাপারও। তুই কি দেখছিস না, বনের পাখিরা গান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বনের সব প্রাণীরা শোকে কাতর। আমাকে রাজা আজাকার কাছে যেতেই হবে।’
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘মামা, যদি যেতে হয় আমাকে নিয়ে যাও। যা বলার আমিই বলব।’
পিরু বলে, ‘আমাকেও যেতে হবে। শুদ্রকে ওরা অন্ধকার এক বন্দীশালায় রেখেছে বলে শুনেছি।’
ওদিকে রাজকুমারী ইলি চোখের জল কেউ থামাতে পারছিল না। রাণী তাকে নানা রকম বুঝ দেয়, তবে কোন বুঝেই কাজ হয় না। রাজা আজাকা নিজেও শুদ্রকে বন্দীশালায় রেখে খুশি নয়, কেননা রাজা জানে সে কতটা চঞ্চল প্রকৃতির। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না, সভাসদদের যুক্তি খন্ডন করার মত ছিল না। শুদ্র বীর হতে পারে, তবে সে তো কৃষকের ছেলে। এ কথা স্পষ্ট যে শুধু কৃষকের ছেলে হওয়ায় তাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে, আজ যদি সে কোন সভাসদের ছেলে হত, তাহলে সভাসদেরা পরমর্শ দিত শুদ্রের সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দেবার। তবে তা হবার নয়।
বাঘ এবং শিয়াল রাজপ্রাসাদে আসল। রাজা তাদের সম্মান দেখিয়ে স্বাগত জানাল। তারপর তাদের সাথে আলোচনায় বসল।
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘আমরা এসেছি একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে আলোচনা করতে।’
বনরাজা বাঘ বলে, ‘আমরা শুদ্রের বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।’
দোভাষী সন্নার সহায়তায় সব বুঝতে পারে রাজা আজাকা। রাজা আজাকা তাদের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। বনের পাখিদের গান থামাবার কথা, বনের প্রাণীদের শোকের কথাও শোনে। শেষে রাজা নির্দেশ দেয় শুদ্রকে ডেকে আনতে। শুদ্রকে ডেকে আনা হলে, রাজা শুদ্রকে বলে, ‘সিদ্ধান্তটা নিষ্ঠুর মনে হতে পারে তোমার কাছে। কিন্তু আমার আর কিছু করার নেই। তুমি আর কখনো রাজপ্রাসাদে এসো না। অথবা সেনাবাহিনীতেও। তোমার স্থান এখন থেকে বন। বনেই বসবাস করতে থাকো।’
সন্না সোমান্দ্র রাজা আজাকার কানে কানে বলে, ‘শুদ্রকে যুদ্ধে প্রয়োজন। আপনার জানা আছে শুদ্রের মত শক্তিশালী কোন যোদ্ধা আমাদের নেই।’
রাজা সোমান্দ্রকে বলে, ‘ও যদি রাজ্যের জন্য ভাবে তাহলে অবশ্যই সে তার ভুল স্বীকার করে ফিরে আসবে।’
সোমান্দ্র বলে, ‘প্রেমকে অস্বীকার কোন তরুণ করেছে বলে জানি না। তাহলে আর ওকে ফিরে আসতে হবে না।’
রাজা আজাকা বনরাজা বাঘকে সবিনয়ে বলল, ‘শুদ্রকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।’
শুদ্রকে নিয়ে বাঘ এবং শিয়াল রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেল। রাজকুমারী ইলি অশ্রুসজল চোখে এ দৃশ্য দেখতে লাগল। বনের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও এই রাজপ্রাসাদের প্রতি, রাজকুমারীর প্রতি যে শুদ্রের ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে, তা সে বুঝতে পারে।
তাই শুদ্রও বার বার পিছন ফিরে তাকায়। একসময় রাজপ্রাসাদ শুদ্রের চোখের আড়ালে চলে গেল, আড়ালে চলে গেল রাজকুমারী ইলির রুমের জানালাও।
সেনাপতিপুত্র কেদুকি এ ঘটনায় খুব আনন্দিত হল, সে স্বপ্ন দেখতে লাগল রাজকুমারী ইলিকে নিয়ে। তার লক্ষ হয়ে দাঁড়াল একটাই, খাবলুশের সাথে যুদ্ধে বীরের বেশে জয়ী হয়ে ফেরা। তখন রাজকুমারীর মন জয় করা তার কাছে সহজ ব্যাপার হয়ে যাবে। রাজাও তার প্রতি খুশী থাকবে। কিন্তু রাজকুমারী নাকবোচা কেদুকিকে কখনো পছন্দ করত না। বরং তাকে দেখলে এড়িয়ে চলত। কেদুকি রাজকুমারীকে পাওয়ার জন্য সব যুদ্ধকৌশল অনুশীলন করে।
এদিকে শুদ্র খালি হাতে বনের ভিতর মন খারাপ করে বসে থাকে। এমন সময় কচ্ছপ তার পাশে এসে বলে, ‘সব দুঃসময় একসময় কেটে যায়, ভাগ্য কেউ বদলাতে পারে না। এই যে দেখছ আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি, খুব দ্রুতই আমি মারা যেতে যাচ্ছি। এটা আমার ভাগ্য। মৃত্যু যেমন নিশ্চিত তেমনি মানুষের প্রতিটি ভাগ্য নিশ্চিত। একে পরিবর্তন করার কিছু নেই। তবে স্রষ্টা দুঃসময়ের পর সুসময় দিয়ে থাকেন। এটাই স্রষ্টার মহত্ব।’
শুদ্র বলে, ‘তবে খাবলুশের সাথে যুদ্ধের কথা ভাবছি আমি। তোমার কি জানা আছে খাবলুশ কতটা ভয়ঙ্কর?’
কচ্ছপ বলে, ‘তার শক্তি দিনে দিনে বাড়ছে। সে অমরত্ব লাভ করতে চাই, এজন্য তার দরকার গাছ। গাছ থেকে শক্তি নিয়ে, সেই শক্তিকে কালো শক্তিতে রুপান্তরিত করে নিজের ভিতর নিয়ে নেয়।’
শুদ্র চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, ‘এটা ভয়ঙ্কর। খাবলুশকে না থামাতে পারলে আমাদের এই বনটাকেও নিঃশেষ করে খাবলুশ। খাবলুশকে যেভাবেই হোক হটাতে হবে।’
তারপর আবার বসে পড়ে অবসন্ন মনে। বলে, ‘তবে যুদ্ধে আমি কিছুই করতে পারবো না। এর মত যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু কি থাকতে পারে?’
এসব চিন্তা ছাড়াও রাজকুমারীর চিন্তা তার মনকে গ্রাস করে বেড়াল। তার মনে হতো বনের ভিতর রাজকুমারী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে সে তাকালেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আগের মত আনন্দ উচ্ছলতায় তার দিন কাটল না, বরং পিরুর সাথে গাছের ডালে শুয়ে গল্প করতে করতেই তার দিন কাটল।
নদীর ধারে কুমির এসে ডাকাডাকি করে শুদ্রকে নিয়ে জলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য, তবু শুদ্র যায় না। তার ঘোড়া হাফা মনমরা হয়ে যায়।
দু’একবার বাবা মাকে দেখতে বঙ্গরাজ্যে যায় শুদ্র। তখন দূর থেকে রাজপ্রাসাদ তাকিয়ে দেখে ফিরে আসে। তার মনে হয় এই বুঝি রাজকুমারী ঘোড়া ছুটিয়ে বনের দিকে আসছে। তবে একদিনও রাজকুমারী আসে না। আসবেই বা কি করে? রাজকুমারীকে যে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে। এমনিতেই যুদ্ধপ্রস্তুতির চিন্তা তার উপর শুদ্র-ইলির ব্যাপারটা রাজা আজাকাকে কঠোর করে তোলে।
রাজা আজাকা প্রতিদিন যুদ্ধপ্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করতে যায়, আর কেদুকি রাজার চামচামিতে ব্যস্ত থাকে। রাজাকে খুশি করতে সর্বপ্রকার চেষ্টা করত। এমন কি রাজকুমারী ইলিকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে চিঠি পাঠায় কেদুকি।
কেদুকি চিঠিতে লেখে, ‘আমি জানি তুমি শুদ্র নামক জংলীটাকে ভালবাসতে। তবে এ ভালোবাসার আর অর্থ নেই। কেননা শুদ্র আর কখনো লোকালয়ে ফিরে আসবে না। তাই জংলীটার কথা চিন্তা করে আর চোখের জল ফেল না। তোমার জন্য মহাবীর কেদুকি সবসময় প্রস্তুত। কেদুকি তোমার ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দেবার জন্যও প্রস্তুত। দয়া করে তুমি আমার প্রেম নিবেদন গ্রহণ করো।’
প্রথম চিঠি পড়ার পর আর একটা চিঠিও পড়ত না রাজকুমারী। অথচ কেদুকি প্রতিদিন চিঠি লিখত, যেগুলো রাজকুমারী ইলি আগুনে জ্বালিয়ে দিত। মোটকথা রাজকুমারী ইলির শোক কোন কিছু থামাতে পারল না।
***************************************
বিষয়: সাহিত্য
৯৯২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন