শুদ্র দ্য গংরিড: কচ্ছপের উপদেশ
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৮ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:০৯:৩০ দুপুর
ক্রিটিক্সের ভিতর প্রবেশ করতে যাচ্ছে কাহিনী। আজ-কালের ভিতর নবম অধ্যায়।
-মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী
------------------------------------------------------------
বনরাজ্যের সাথে চুক্তির পর বনরাজ্য আর বঙ্গরাজ্যের প্রজারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। এভাবে দশ বছর কেটে গেল, গাছপালা না কাটায় বনরাজ্য আরও সবুজ হয়ে উঠলো। অন্যদিকে বঙ্গরাজ্য আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো। প্রচুর শস্য উৎপাদন হতে লাগল বঙ্গরাজ্যে। রাজা আজাকা এবং বাঘ রাজা উভয়েই এতে খুশি ছিলেন। তবে সব সময় এভাবে যাবে না তা সবাই জানত। কারণ, বন পুরাণের সেই ভবিষ্যৎবাণী।
প্রশিক্ষণের ফলে তরবারী চালনায় শুদ্র খুব অভিজ্ঞ হয়ে উঠলো, তরুণদের মাঝে তলোয়ার বিদ্যায় সে সেরা হয়ে উঠলো। তবে এটাকে সেনাপতিপুত্র কেদুকি ভালো চোখে দেখতো না। সে জানে রাজকুমারী ইলি শুদ্রের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে, অথচ সে চাই রাজকুমারী ইলি তার হোক। তাই শক্তসমর্থ কিন্তু নাকবোচা কেদুকি শুদ্রের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে লাগল সব জায়গায়। শুদ্র কিন্তু অমনটা ভাবতো না, নিজের মত সব কিছু করে যেতে লাগলো। শুদ্র আরো শক্ত সমর্থ হয়ে উঠতে লাগলো। তার জ্ঞানের পথও প্রসারিত হতে লাগলো। পাঠশালার পাঠের পাশাপাশি, শিয়ালের পাঠ তার জ্ঞান বুদ্ধিকে আরো ধারালো করে তুলল। রাজ্যনীতি আর বননীতিতে পারদর্শিতা অর্জন করে উঠলো সে।
তবে দিনে দিনে রাজা আজাকার কটু দৃষ্টিতে পড়তে লাগল শুদ্র কেননা পুরাণের ভবিষ্যতবাণী উদ্ধার করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল শুদ্র। কেন ব্যর্থ হচ্ছিল সেটার ব্যাখ্যা সে দেয় নি রাজাকে। এটা রাজার কাছে বিরক্তিকর বিষয় ছিল। এছাড়া শুদ্র দিনে দিনে আরো বনমুখো হয়ে গেল। অনেক রাতে রাজপ্রাসাদে ফিরত শুদ্র। ফিরে দেখত রাজকুমারী ইলি তার সাথে কথা বলার জন্য জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্র দেয়ালের খাজ বেয়ে বেয়ে উঠে যেত রাজকুমারী ইলির জানালায়। দেওয়ালের খাজে পা রেখে জানালায় একরকম ঝুলে রাজকুমারীর সাথে কথা বলতো শুদ্র।
সেনাপতিপুত্র কেদুকি এ দৃশ্য একদিন দেখে রেগে গেল। সেনাপতিও এটা জেনে গেল। শেষ পর্যন্ত রাজার কানে কথাটা গেল। এ ঘটনা জানাজানিতে রাজা আজাকা রাজকুমারীর প্রতি বিধি নিষেধ আরোপ করলো। তারপর থেকে রাজকুমারীর সাথে শুদ্রের দেখা বন্ধ হলো। শুদ্র রাজকুমারীর অপেক্ষায় প্রতিদিন জানালার পাশে আসত, তবে রাজকুমারীর দেখা মিলত না। এ বিষয়টা যেমনি শুদ্রের মনকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলল, তেমনি রাজকুমারীরও। একসময় এমন অবস্থা হলো, শুদ্র আর রাজপ্রাসাদেই ফিরত না।
তবে শুদ্র শেষ পর্যন্ত তার পনের তম জন্মদিনে এক বার্তা নিয়ে আসলো রাজাকে। শুদ্র রাজাকে একান্তে ডেকে বললো, ‘এটা অবাক ব্যাপার। আমাদের শত্রু হয়ে উঠবে পতঙ্গরাজ্য।’
রাজা আজাকা যেন আকাশ থেকে পড়লো। বলে উঠলো, ‘পতঙ্গরাজ্য? এটা অসম্ভব! যদি পতঙ্গরাজ্যের কথা পুরাণে থেকে থাকে তাহলে পুরাণ হবে ভুল। তুমি নিজেই জানো, পতঙ্গরাজ আমাদের সবচেয়ে বন্ধু রাজ।’
এ সংবাদের পর রাজা আজাকার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। রাজা সন্না-সভাষদ নিয়ে বৈঠক বসালো, হিসাব-নিকাশ করা হলো পতঙ্গরাজ্যের সাথে কোন ভুল তারা করেছে কিনা, যার জন্য পতঙ্গরাজ তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। কোন ভুল বের করতে তারা সমর্থ হয় না।
তবে সন্নারা তাদের কথায় অটল। তাদের মতে, বনপুরাণের কথা ভুল হতে পারে না। তাই রাজ্যের সুরক্ষার জন্য যুদ্ধপ্রস্তুতি আবশ্যক।
রাজা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না।
কেন মেনে নিতে পারলো না রাজা? এর পিছনে কারণ ছিল। আসলে বঙ্গ রাজ্যের পাশে ছিল এক শক্তিশালী রাজ্য সে রাজ্যের নাম পতঙ্গ। পতঙ্গ রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা হরিদি। পতঙ্গ রাজ্যের সাথে বঙ্গ রাজ্যের সম্পর্ক ছিল অনেক ভালো। রাজা হরিদি আর আজাকার মধ্যে সম্পর্ক ছিল ভাইয়ের মতো। একে অন্যের প্রতি তারা ছিল সহনশীল। বাইরের কোন অন্য কোন রাজ্য এই দুই রাজ্যের প্রতি আক্রমণ করতে সাহস পেত না শুধুমাত্র একটি কারণে, সেটা হলো রাজা আজাকা আর হরিদির মধ্যে সম্পর্ক।
রাজা শুদ্রের কাছে বারবার জানতে চাইতো বনপুরাণের ভবিষ্যৎবাণীর কথা। কিন্তু শুদ্র তার কথায় অটল। শুদ্র স্পষ্ট রাজাকে জানিয়ে দেয় এ কথা। শুদ্র জানায়, ‘খারাপ মানুষেরা পতঙ্গরাজ হয়ে আসবে বঙ্গরাজ্যের দিকে।’
একথা রাজা আজাকাকে আরও পিড়া দেয়। পতঙ্গরাজ কি তাহলে খারাপ কোন শক্তির হাতে যেতে যাচ্ছে। রাজা আজাকা তার গুপ্তচর পাঠালো পতঙ্গরাজ্যে। তবে কিছু আঁচ করতে ব্যর্থ হয়ে গুপ্তচর ফিরে আসল। এক কথায় এই ভবিষ্যৎবাণী বঙ্গরাজ্যকে অস্থির করে তুলল। শেষ অবধি রাজা আজাকা পতঙ্গরাজ্যের সাথে যুদ্ধের গোপন প্রস্তুতি নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তবে কথা হলো, শুদ্র কি করে জানলো এ কথা, আবার বননীতি তার ভালো করেই জানা। বননীতিতে স্পষ্ট লেখা আছে, বন পুরাণের কথা মানুষেরা জানতে পারবে না। যেহেতু শুদ্র মানুষ তাই শুদ্রের কাছেও প্রাণীরা লুকিয়ে যেত বন পুরাণের কথা। এমনকি শিয়াল পন্ডিত যখন এ অধ্যায়ের উপর পাঠ দিয়েছিল, সে সময় শিয়াল পন্ডিত শুদ্রকে অনুরোধ করে না আসতে। এছাড়া শুদ্র অনেকভাবে চেষ্টা করতো বনের প্রাণীদের কাছ থেকে বনপুরানের কথা জানার জন্য, কেননা রাজ্যের ভবিষ্যত অনেকটা এই পুরাণের উপর নির্ভর করছে।
একদিন রাতে এসব ভেবে মন খারাপ করে শুদ্র নদীর ধারে বসে থাকে। নিস্তব্ধ এ রাতে আকাশের চাঁদ তার কাছে ম্লান মনে হয়। আসলে মন খারাপ থাকলে সবকিছুই ম্লান মনে হয়।
সে যাই হোক, সে সময় শুদ্রের পাশে এসে বৃদ্ধ কচ্ছপ বসে। শুদ্রের সেদিকে খেয়াল নেই। আস্তে করে শুদ্রকে বলে, ‘ভবিষ্যত বদলানো যায় না, ভবিষ্যত জেনে কিংবা না জেনেও।’
চকিত এ কথায় শুদ্র পিছনে পাশে তাকিয়ে দেখে কচ্ছপ। শুদ্র কিছুটা দূরে সরে যায়। কচ্ছপ বলে, ‘আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই বতস্য। আমি অন্য সব বনের প্রাণীর মতই। বন পুরাণের কিছুটা জানি মাত্র।’
শুদ্র কিছু না বলে শুনতে থাকে অবাক হয়ে।
কচ্ছপ বলে, ‘তোমার কি মনে আছে শ্বেতরাজ গুহায় ঢোকার পর প্রথম কি বলেছিল তোমাকে?’
শুদ্র বলে, ‘বলেছিল, খারাপ মানুষেরা আসে আমাকে গ্রাস করতে, ভালো মানুষেরা চুরি করতে।’
কচ্ছপ বলে, ‘তেমনি খারাপ মানুষেরা আসবে পতঙ্গরাজ হয়ে। খবরটা জানিয়ে দাও রাজাকে। রাজা আজাকা ভালো হয়েও বন পুরাণের কথা চুরির জন্য তোমাকে নিয়োগ করেছে। তবে বনপুরাণের ভবিষ্যৎবাণী জানার মত সময় তোমার হয় নি।’
শুদ্র বলে, ‘শ্বেতরাজা দ্বিতীয় কথা এটাই বলেছিল, অসময়ে সময়ের কাজ হয় না। আর তৃতীয় কথা ছিল...’
কচ্ছপ বলে, ‘থামো, তৃতীয় কথা বলার সময় তোমার আসে নি। তুমি ভালো করেই জানো শ্বেতরাজার সাথে কি ওয়াদা তুমি করেছ?’
শুদ্র অবাক হয়, কচ্ছপের জানার পরিধি দেখে সে অবাক হয়। আর কোন প্রশ্ন করার সাহস হয়ে ওঠে নি তার।
*************************
বিষয়: সাহিত্য
৯৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন