শুদ্র দ্য গংরিড: শ্বেতরাজ্য (প্রথমাংশ)
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৯:৩১:৫৫ রাত
ষষ্ঠ অধ্যায় অন্যান্য অধ্যায়ের চেয়ে বড় হওয়ায় দুটি পোস্টে দেওয়া হবে। আজকে ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথমাংশ প্রকাশ করা হলো।
-মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী
-------------------------------------
রাজকুমারী ইলি আর শুদ্র দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। তার একটু দূরে কয়েকটি কবুতর সবুজ ঘাসের উপর খেলা করছিল। শুদ্র রাজকুমারী ইলিকে বলে, ‘ইলি, দেখবে কি হয়?’
শুদ্র হাত ইশারা করে কবুতরের দিকে তাকিয়ে। আর মুখে শিশিসসসকক করে শব্দ করতে লাগল। কবুতরেরা উড়ে শুদ্রের চারপাশে উড়তে লাগলো। ইলিতো বলে ওঠে, ‘আশ্চর্য! তুমি এটা কি করে করলে? এটা অসাধারণ!’
কবুতরেরা তাদের সাদা পাখা ঝাপটে এক অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করলো। এমন সময় সোমান্দ্র আসে। সোমান্দ্র রাজকুমারী ইলিকে চলে যেতে বলে।
সোমান্দ্র বলে, ‘লুলু, তোমাকে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে হবে। সমুদ্রে যেতে হবে।’
শুদ্র উৎসাহী হয়ে বলে, ‘সমুদ্র? সমুদ্রযাত্রা?’
শুদ্র সমুদ্রের কথা শুনেছে তবে কখনো ভাবতেই পারে নি সে এত দ্রুত সমুদ্রযাত্রায় যাবার সুযোগ পাবে। তাই তার উৎসাহের মাত্রা খুব বেশি।
সোমান্দ্র বলে, ‘হ্যা। আমরা সমুদ্রযাত্রায় যাবো। উত্তরের শ্বেতদেশে।’
শুদ্র বলে, ‘শ্বেতদেশ? সেটা আবার কোন দেশ?’
শুদ্রকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমান্দ্র বলে, ‘সে এক আজব দেশ লিলু। আজব দেশ, সেই দেশ দেখতে সাদা। আমি জীবনে একবারই গিয়েছি শ্বেতদেশে।’
শুদ্র বলে, ‘শ্বেত দেশে কারা থাকে লিলু?’
সোমান্দ্র বলে, ‘সুন্দর সেই দেশ, ভয়ঙ্কর সেই দেশ। সব জানতে পারবে তুমি।’
শুদ্র বলে, ‘লিলু, আমরা কবে যাচ্ছি?’
সোমান্দ্র বলে, ‘কালকে সকালেই। রাজার নির্দেশে সব ব্যবস্থা করা শেষ। তোমার বাবা-মা আজকে তোমাকে বিদায় দিতে আসবে। আর সিদুও আমাদের সাথে যাচ্ছে।’
শুদ্র তটস্থ হয়ে পড়লো, সোমান্দ্রকে বলে, ‘লিলু, আমার বনের বন্ধুদের বিদায় দিবো না আমি?’
সোমান্দ্র বলে, ‘ঠিক আছে, তুমি বিদায় দিয়ে এসো। তবে দেরি করো না, দ্রুত ফিরে এসো।’
শুদ্র সিদুকে নিয়ে বনে চলে যায়। শিয়াল, বাঘ, হরিণ, কুমির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে। বনের প্রাণীরা তার শুভ কামনা করে তাকে বিদায় দেয়। বিদায় বেলায় বনের প্রাণীদের চোখ ছল ছল করে ওঠে।
রাজপ্রাসাদে ফিরে দেখে তার বাবা-মা তার জন্য অপেক্ষা করছে। শুদ্র অশ্রুসজল চোখে বাবা মাকে বিদায় দেবার পর তার সহপাঠী বন্ধুদের বিদায় দেয়। অবশেষে চাঁদনী সেই রাতে তাকে বিদায় দিতে আসে রাজকুমারী ইলি। বিদায়কালে ইলি শুদ্রকে একটা গোলাকার তামার চাকতি দেয়।
বলে, ‘এটা সবসময় কাছে রাখবে, তাহলে দেখবে কোন বিপদ তোমার ধারের কাছে ঘেঁষছে না।’
শুদ্র বলে, ‘কে বলেছে তোমাকে?’
ইলি বলে, ‘বাবা বলেছে। বাবা এটা আমাকে দেবার সময় বলেছিল এটা আশীর্বাদপুষ্ট এক চাকতি। নানান রকম বিপদ থেকে মুক্তি দেয় এই চাকতি।’
শুদ্র বলে, ‘সত্যি! ধন্যবাদ তোমাকে।’
ইলি শুদ্রকে বলে, ‘তোমার সমুদ্রযাত্রা শুভ হোক।’
শুদ্র রাজকুমারীকে বিদায় দেয়। সেদিন সমুদ্র যাত্রার উৎসাহে তার ঘুম হারাম হয়ে গেল। আবার অন্যদিকে তার মন খারাপ হয় এই ভেবে যে, তার বন্ধুদের সাথে তার দেখা হবে না। বনে ঘুরোঘুরি করা হবে না। আবার সে জানেও না এ যাত্রা কতদিনের।
সকালে দরজায় টোকা পড়তেই দরজা খুলে দেয় শুদ্র। সোমান্দ্র দেখে শুদ্র সম্পুর্ণ প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে এসে দেখে সব সন্নারা দাঁড়িয়ে আছে। সন্নারা একে একে তার কপালে হাত দিয়ে দ্রুত মুখ নাড়তে থাকে। শুদ্র বুঝতে পারে সন্নারা তাকে আশীর্বাদ করছে। সন্নাদের কাছ থেকে বিদায় নিল শুদ্র।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে শুদ্র, সোমান্দ্র আর সিদু বঙ্গের সমুদ্র বন্দরের দিকে রওনা দিল। শুদ্র চড়ল সোমান্দ্রের পিছনে। সমুদ্র বন্দর চিতলা শহরে অবস্থিত। চিতলা শহরে প্রবেশ করতে না করতে শুদ্র অবাক হয়ে গেল। শহরের মানুষগুলো একটু ব্যতিক্রমী। তাদের ভাষাও কিছুটা দুর্বোধ্য। একেকজনকে দেখলে মনে হয় ঠিকরে তাকিয়ে দেখছে তাদের। শুদ্র সোমান্দ্রকে বলে, ‘লিলু, এখানকার মানুষগুলো এভাবে তাকায় কেন?’
সোমান্দ্র বলে, ‘এ শহরের প্রায় সবাই নাবিক। সমুদ্রে থাকলে চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। তাই সমুদ্রে এদের আচরণ যেমন এখানেও। কোন মানুষকে দেখলে এরা তা ধরে তাকে দেখে। ভয়ের কিছু নেই, ওরা ভালো করেই জানে আমরা রাজার লোক।’
তারপর কিছুদুর যেতেই একদল লোক হাতে মোটা গাছের ডাল নিয়ে তাদের ঘিরে ধরে। সোমান্দ্র ওদের বলে, ‘তোমারা জানো যে আমরা রাজা আজাকার লোক।’
লোকগুলো মাতাল ছিল, চিৎকার করে বলে, ‘রাজা আজাকা! সে আবার কোথথাকার রাজাআআ! মাটির নাকি আকাশের?’
শুদ্র মুখ চেপে হাসে। সোমান্দ্র বলে, ‘লুলু, তুমি চোখ বোজ।’
সোমান্দ্রের কথামতো শুদ্র চোখ বোজে। একটু পর চোখ খুলে দেখে মাতালগুলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
শুদ্র সোমান্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, ‘লিলু, এটি হলো। ওরা কি মারা গেছে?’
সোমান্দ্র বলে, ‘না, অজ্ঞান হয়েছে। এদেরকে নিয়ে আমাদের ভাবলে চলবে না। চলো আমরা এগোই।’
শুদ্র বুঝতে পারে এটা সোমান্দ্রের কারসাজি। সে জানে, সন্নারা অনেক কারসাজি দেখাতে পারে, কিন্তু নিজে চোখে কখনো দেখে নি।
সন্ধ্যায় তারা জাহাজে পৌঁছে গেল। জাহাজ এত বড় হতে পারে শুদ্রের ধারণা ছিল না। সেতো জাহাজের উপর দৌড়া-দৌড়ি শুরু করে দিল। ৩৩ জন নাবিক আর ক্যাপ্টেন নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হলো সেই রাতে। নীল সমুদ্রের বুকে তাদের জাহাজ চলতে লাগলো। সমুদ্রতটের মিটমিটে আলো আস্তে আস্তে শুদ্রের চোখের আড়ালে চলে গেল। জাহাজের এখানে ওখানে অনেক বাতির ব্যবস্থা ছিল। জাহাজের উপর দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখতে থাকে শুদ্র। নীল সাগরে রাতের প্রকৃতি তাকে বিমোহিত করে ফেলে। তারা আকাশ এত স্পষ্ট দেখা যায় যে, তা তাকে পাগল করে ফেলে। জাহাজের এদিক থেকে ওদিক শুদ্র শুধু দেখে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং একসময় চোখ বুজে আসলে সে ডেকেই ঘুমিয়ে পড়লো। সোমান্দ্র তাকে জাহাজের কেবিনে নিয়ে শুইয়ে দিলো।
ভোরে সিদু তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, বলে, ‘চলো, সুর্যোদয় দেখি আমরা।’
শুদ্র একলাফে ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে ডেকে চলে যায়। ডেক থেকে পুব আকাশে তাকিয়ে দেখে, শুদ্রের কাছে এটা মনে হয় অন্য রকম কিছু, এ যেন এক নতুন সূর্যোদয়। সিদুও শুদ্রের পাশে এসে সূর্যোদয় দেখতে থাকে।
সিদু বলে, ‘এই সমুদ্র যাত্রার পর তোমার জীবন হবে এই সূর্যের মতো।’
শুদ্র’র একথার অর্থভেদ করার তাড়া নেই, সে সমুদ্র দেখতেই ব্যস্ত। এভাবে কয়েকমাস মাস চলে গেল। জাহাজ আস্তে আস্তে উত্তরের দিকে চলতে থাকে। বিভিন্ন বন্দরে বিভিন্ন রকমের মানুষ দেখে শুদ্র, বিভিন্ন দেশ দেখে, দেখে সমুদ্রের নানা মাছ, পাখি। ডলফিনের খেলা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। কয়েকদিনে ডলফিনের সাথে ভাব হয়ে যায় তার। ডলফিনেরা প্রতিদিন বিকালে আসতো।
একরাতে প্রতিদিনের মত ডেকে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছিল শুদ্র। সোমান্দ্র তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
শুদ্র বলে, ‘লিলু, শ্বেতদেশ আর কতদূর?’
সোমান্দ্র বলে, ‘অনেক দূর এখনো। মাত্র অর্ধেক পথ এসেছি আমরা।’
শুদ্রের বনের কথা, বাবা-মার কথা, রাজ প্রাসাদের কথা, রাজকুমারী ইলির কথা মনে পড়ে। এ দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় সে কিছুটা মুচড়ে পড়ে। তাই সোমান্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, ‘লিলু, চলো আমরা ফিরে যায়। শ্বেতদেশে গিয়ে আমরা কি করবো?’
সোমান্দ্র বলে, ‘এখন সময় হয়েছে তোমাকে বলার। তুমি কি জানো তুমি অন্যদের মত নও। আর দশ-পাঁচটা ছেলের মতো। তুমি প্রাণীদের ইশারায় নির্দেশ দিতে পারো। আর তোমার কি মন চাই না প্রাণীদের সাথে কথা বলতে?’
শুদ্র বলে, ‘হ্যাঁ মন চাই, আমি প্রাণীদের চোখে শত শত আবেগ ভেসে উঠতে দেখি। কিন্তু ওদের কথার ভাষাতো বুঝতে পারি না। কিন্তু লিলু, ওদের সাথে কথা বলতে হলে তো আমাকেও লিলু হতে হবে। তোমাদের মত সন্না হতে হবে। আর আমি সন্না হতে চাই না।’
সোমান্দ্র বলে, ‘সন্না হতে হবে না তোমাকে। তুমি লুলু হয়েই থাকবে। কিন্তু তুমি যদি বনের প্রাণীদের সাথে কথা বলতে পারো তাহলে এটা হবে আমাদের রাজ্যের জন্য ভালো।’
শুদ্র বলে, ‘কেন?’
সোমান্দ্র বলে, ‘কারণ বন পুরাণের ভবিষ্যৎবাণীর কথা কেউ জানে না। সেই ভবিষ্যৎবাণী উদ্ধার না করতে পারলে বঙ্গরাজ্যের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’
শুদ্র বলে, ‘তা ঠিক আছে, তো শ্বেতরাজ্যে যেয়ে কি হবে? শ্বেতরাজ্যে গেলে কি আমি প্রাণীদের সাথে কথা বলা শিখে যাবো।’
সোমান্দ্র বলে, ‘শ্বেতরাজ্য এক বিরাট রাজ্য। যেখানে শুধু বরফ আর বরফ। এই রাজ্যে থাকে এক সাদা ভাল্লুক। এই সাদা ভাল্লুকই হচ্ছে শ্বেতরাজ্যের রাজা। শ্বেতরাজ্যের প্রতিটি প্রাণীরা ভাল্লুকের কথা শোনে। সেই ভাল্লুকের কাছে আছে এক শক্তিদন্ড। যার শক্তিতে সে পুরো শ্বেতরাজ্য শাসন করে। শ্বেতরাজ্যের প্রজারা সব বরফের তৈরি। রাত হবার সাথে সাথে শ্বেতরাজ্য জাগ্রত হয়ে ওঠে। আর শক্তিদন্ডে শক্তির সঞ্চার হয়। এই শক্তিদন্ডে লুকায়িত আছে সকল প্রাণীর ভাষা। কেউ যদি ভাল্লুককে বধ করে একবার ওই দন্ড স্পর্শ করে আসতে পারে তবে সে সব ভাষা বুঝতে পারবে। তবে কাজটা সহজ নয়। শ্বেতরাজ্যের সব প্রজাদের ফাঁকি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হবে।’
(....................................ষষ্ঠ অধ্যায় চলমান..............................)
বিষয়: সাহিত্য
১১৭২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন