শুদ্র দ্য গংরিড: নদীপাড়ের মহাসভা

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২১ অক্টোবর, ২০১৪, ০৯:১১:০৪ রাত



শুদ্র চরিত্রের বিস্তার পরের অধ্যায় থেকে বিকশিত হবে। আশা করছি, উপন্যাসটি ধীরে ধীরে নতুন মাত্রা পাবে।

-লেখক, মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী

---------------------------------------


বঙ্গ রাজ্যের পাশে বিরাট এক বন, তারপর বিশাল জলরাশির সমুদ্র, সেই সমুদ্রেই লুকায়িত আছে বন রাজ্যের পুরাণ। বন রাজ্যের পুরাণের ভবিষ্যৎবাণীর উপর ভিত্তি করেই হতে যাচ্ছে এক চুক্তিসভা। যাকে মহাসভা বলাও দোষের নয়। বঙ্গ রাজ্যের রাজা প্রজারা এই মহাসভাতে উপস্থিত হবে, আবার বন রাজ্যের সব প্রাণীরা উপস্থিত হবে। এই মহাসভার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে বনরাজ্য আর বঙ্গরাজ্যের মাঝামাঝি একটি জায়গা। নদীর পাশে এক বিরাট ময়দানে হবে এই সভা।

সময় গুনতে গুনতে সেই মহাসভার দিন চলে আসল। আজাকা তার দল নিয়ে মহাসভার ময়দানে আসলো। চেয়ার পেতে সভাষদ আর সন্নাদের নিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। পিছনে রাজ্যের প্রজারা। প্রজাদের ভিতর শুদ্র এক এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন সন্না দ্রুত বনের মাঝে গিয়ে খবর দিয়ে আসলো রাজা আজাকার পৌঁছানোর কথা। বাঘ তার প্রজাদের নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই বাঘ তার প্রজাদের নিয়ে সেই বিশাল ময়দানে হাজির হলো। শত শত বাঘ, শিয়াল, খরগোশ, হাতি, কুমির, বানর, ব্যাঙ ইত্যাদি প্রাণীরা আসলো স্থলপথে। পাখিরা আসলো ঝাঁক বেধে। জলের প্রাণীরা এলো নদীপথে। রাজা আজাকা এ দৃশ্য দেখে আপ্লুত হয়ে পড়লো। রাজা আজাকা তাদের সম্মান ও অভিনন্দন জানালো। খুব সুসংগতভাবে এসে তারাও একসাথে রাজা আজাকাকে সম্মান জানালো। শুদ্র বনের প্রাণীদের আসতে দেখে খুব খুশী হলো। ইশারায় খরগোশ, কুমিরের সাথে ভাব বিনিময়ও করে নিল শুদ্র।

রাজা আজাকা আগে থেকেই বাঘ রাজাকে বসার জন্য একটা উঁচু সুসজ্জিত জায়গা প্রস্তুত করে রেখেছিল। এই সভায় সন্না সোমান্দ্রকে দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ করলো। সোমান্দ্র রাজা আজাকার নির্দেশে বাঘ রাজাকে অনুরোধ করলো, সুসজ্জিত আসন গ্রহণ করতে। শিয়াল পন্ডিত বাঘের কানে কানে কিছু কথা বলে দিলো।

বাঘ বলে, ‘এই মহাসভাতে আমার রাজ্যের সবাই সমান। তাই এই উঁচু স্থানে আমি বসতে পারছি না, এজন্য রাজা আজাকার কাছে আমি সবিনয়ে দুঃখ প্রকাশ করছি।’

রাজা আজাকা সোমান্দ্রর কাছে কথাটা শুনে খুব অবাক হলো। রাজা-প্রজার সমতা নীতি কোন মানুষদের রাজ্যে আছে কিনা রাজার জানা নেই। তারপর সভা শুরু হলো। বনরাজ্যের প্রথম সারিতে বাঘ, শিয়াল, কচ্ছপ, তৃণভোজীদের দূত হরিণ, জলের দূত কুমির আর পক্ষীকূলের দূত টিয়া।

প্রথমেই বাঘ কথা বলতে শুরু করলো, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় আপনজনকে নিয়ে আসতে পারি নি। আসলে তারাই হচ্ছে আমাদের জীবন। এজন্য আমি রাজার কাছে অনুরোধ জানায়, তাদের প্রতি যেন কোন অবিচার করা না হয়। কেননা, তাদের প্রতি কোন অবিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আমরা চুক্তি করতে রাজী নই।’

রাজা আজাকা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের সেই বন্ধুর নাম কি?’

বাঘ বলে, ‘গাছ। ওরাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাই গাছের জীবনের সাথে আমাদের জীবন মিশে আছে। আপনাদের প্রথমত কথা দিতে হবে, বনের গাছ কাটা আরো সীমিত করতে হবে। এজন্য শিয়াল আপনাদের কিছু পরামর্শ দিতে চাই।’

শিয়াল পন্ডিত বলতে থাকে, ‘হা, আমাদের মহারাজা যা বলেছেন সেটা সত্য। গাছ যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে তেমনি মানুষদেরও বিভিন্ন কাজে লাগে। তাই আমরা আশা করবো আমাদের বনরাজ্য রক্ষায় আপনারা সাহায্য করবেন। আপনারা আপনাদের রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় আরো বেশি করে গাছ রোপণ করতে পারেন। এতে করে গাছের কাঠের যে চাহিদা তা আপনাদের রাজ্যের ভিতর থেকেই নিবারণ হবে।’

রাজা আজাকা বলা শুরু করে, ‘আসলে আমরা আজকে এখানে মিলিত হয়েছি একটা শান্তির পথ খুঁজতে। আপনারা সবাই জানেন, আমি রাজ্যের অধিপতি হবার পর বনের গাছ কাটা সীমিত করেছি। আর শিয়ালের পরামর্শ প্রশংসার দাবিদার। আমরা শিয়ালের পরামর্শ গ্রহণ করে বনের গাছ কাটা আরো সীমিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’

রাজা আজাকা আরো বলেন, ‘আর আমার প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, বনের প্রাণীরা যেন অকারণে, শুধু নিজেদের আহারের জন্য আমার প্রজাদের উপর আক্রমণ না করে।’

বাঘ বলে, ‘আমাদেরও একি ধরনের প্রস্তাব। আমার প্রজাদের যেন অকারণে মানুষেরা আহারের পন্য না বানায়।’

এমন সময় কুমির বলে ওঠে, ‘যদি মানুষেরা আমাদের খাদ্য দ্রব্য বানায়, তাহলে কি শাস্তি হবে? আর আমরা মানুষদের খাদ্য দ্রব্য বানালে কি হবে?’

এ নিয়ে চিন্তা ভাবনার শেষ নেই। রাজা আজাকা বলেন, ‘আসলে হিংসা বিদ্বেষ দিয়ে কোন কিছু হয় না। হত্যার বদলা যদি হত্যা হয়, তাহলে আমাদের এ যুদ্ধ কোনদিন থামবে না। আমাদের এমন একটা মীমাংসায় আসতে হবে যাতে এমন কিছু যদি ঘটে তাহলে সুষ্ঠ সমাধান করা যায়। সবাই ভাবতে থাকো, কি করা যায়।’

সবাই যে যার মতো ভাবতে থাকে



শিয়াল পন্ডিত বলে ওঠে, ‘আমি একটা সমাধান দিচ্ছি, সবার যদি মনঃপুত হয় তাহলে জানাও। যদি কোন মানুষ বনের প্রাণীদের হত্যা করে, তাহলে মানুষ রাজাকে দিতে হবে তার ক্ষতিপূরণ। এই ক্ষতিপূরণ সন্নাদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। আর কোন মানুষকে যদি কোনভাবে কোন প্রাণী কারণ ছাড়া হত্যা করে, তাহলে সেই পরিবারকে প্রাণী হত্যা ও গাছ কাটা বাদে বনের সকল সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে।’

শিয়াল পন্ডিতের বুদ্ধিমত্তা দেখে রাজা আজাকা অবাক হয়ে যায়। এত জটিল সমস্যার সমাধান শিয়ালের মাথা থেকে আশায়, বাঘও নিজের রাজ্য নিয়ে গর্ববোধ করে।

অন্য কোন পথ না খুঁজে পেয়ে, শেষে শিয়ালের প্রস্তাব গৃহীত হলো। এভাবে আস্তে আস্তে চলতে থাকে মহাসভা। জলের প্রাণীদের নিরাপত্তা বিধান করার চুক্তি হলো, এছাড়া বিভিন্ন প্রাণীদের নিরাপত্তার বিষয়ে চুক্তি হলো। পাখিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো, বনে এসে বন্য পাখি শিকার করা যাবে না, কিন্তু লোকালয়ে যদি বন্য পাখিরা যায় তাহলে শিকার করা যাবে। তবে সব দফা-রফা হলেও শেষে দেখা গেল এক বিপত্তি। শিয়াল পন্ডিতের কি হবে? শিয়াল পন্ডিত তো মনে মনে জপঃ করতে লাগলো, তার বিষয়ে যেন কথা না ওঠে।

বাঘ তাকে বার বার কানে কানে বিষয়টা বলে, ‘ভাগ্নে, তোমার বিষয়ে কিছু বলো। তোমার কি হবে? তুমি যখন মুরগী চুরি করতে যাবে?’

শিয়াল পন্ডিত না শোনার ভান করে থাকে। তবে শেষ রক্ষা হলো না, হঠাৎ, বাঘ চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমাদের শিয়াল পন্ডিতের বিধান কিন্তু এখনো হলো না।’

রাজা আজাকা কথাটা শুনে মুখ চেপে হাসতে লাগলো। কেননা, এতক্ষণ বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান শিয়াল পন্ডিতই বের করেছে। রাজা আজাকা তো শিয়ালের বুদ্ধি দেখে অবাক। আর সেই শিয়াল পন্ডিত কত চতুরভাবে নিজের বিধান এড়িয়ে যাচ্ছিল! একবার যদি এড়িয়ে যেত, তাহলেই হতো। কেননা, শুধু শিয়ালের বিধানের জন্য তো আর একটা মহাসভা করা সম্ভব নয়। রাজা আজাকা হাসতে হাসতে বলে, ‘শিয়ালের বিধান এখন শিয়াল পন্ডিত নিজেই ঘোষণা করবেন।’

শিয়াল পন্ডিত বাঘ মামার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়, বাঘ হাসতে হাসতে শিয়ালের কানে কানে বলে, ‘বলে দে ভাগ্নে। তোর বুদ্ধির দৌড় দেখি। কিভাবে তুই নিজেকে বাঁচাস দেখি।’

শিয়াল পন্ডিত মন খারাপ করে বাঘ মামার কানে কানে বলে, ‘মামা, জীবনে একবারই আমাকে ঠকালে। আমি কি করে এতগুলো সঠিক বুদ্ধি দেবার পর নিজেকে বাঁচানোর জন্য খারাপ বুদ্ধি দিই। তাহলে সবাই আমাকে মূর্খ বলবে মামা।’

শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘সম্মানিত সুধী, আমি এখন আমার বিষয়ে বিধান বলছি। তার আগে কিছু সত্য কথা বলে নিই। আমি এই ক’দিনে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক পথ খুঁজেছি। কিন্তু পায় নি। আসলে আমরা শিয়াল গোত্র এবং বনবিড়াল গোত্ররা মাঝে মাঝেই লোকালয় থেকে শিকার বা চুরি করে থাকি। যদিও আমরা বনে থাকি, তবু জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের লোকালয়ে যেতে হয়। বনে আমাদের খাদ্য অনেক সময় ব্যাপকভাবে কমে যায়। তাই আপনাদের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, আমাদের লোকালয়ে শিকার করার অনুমতি দেওয়া হোক। আমরা যদি শিকার করতে যেয়ে ধরা খাই, গৃহস্থ আমাদের উত্তম-মধ্যম দিতে পারবে। তবে আমাদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হলো।’

রাজা আজাকা যেহেতু আগে থেকেই শিয়াল পন্ডিতের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল তাই শিয়াল পন্ডিতের আর্জি মেনে শিয়াল গোত্রকে লোকালয়ে চুরির অনুমতি দেওয়া হলো। তবে একি গৃহস্থের বাড়িতে প্রতিনিয়ত চুরি থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হলো।

অবশেষে সন্ধ্যার দিকে মহাসভা শেষ ঘোষণা করা হলো। মহাসভা শেষ ঘোষণা করার সাথে সাথে শুদ্র ছুটে প্রাণীদের দিকে যেতে থাকলো। রাজা আজাকা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। কেউ কেউ চিৎকার করতে লাগলো, ‘ওকে ধরো? ওকে ফিরিয়ে আনো?’

রাজা আজাকা সন্না সোমান্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ছেলেটা কে?’

সন্না সোমান্দ্র বলে, ‘শুদ্র, সেই কৃষকের ছেলে। যাকে বনের প্রাণীদের কাছ থেকে বাঁচিয়েছিলাম। শুনেছি ছেলেটি সবসময় বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।’

শুদ্র দৌড়ে বাঘের দিকে যেতে থাকে। পিছনে প্রজারা বলে, ‘ওকে বাঘ খেয়ে ফেলবে, ওকে বাঁচাও।’

রাজা আজাকা হাত ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বললো।

শুদ্র বাঘের কাছে গিয়ে বাঘের গলা জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগলো, বাঘ মামাও শুদ্রকে আদর করতে লাগল বিভিন্ন কসরতে।

সবাই এ দৃশ্য দেখে অবাক হলো। রাজা আজাকা সন্না সোমান্দ্রকে নির্দেশ দিলো, ‘ছেলেটাকে প্রাসাদে নিয়ে এসো।’

*********************************

বিষয়: সাহিত্য

১২১৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

276883
২১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:২৭
জহুরুল লিখেছেন : পড়ে ফেললাম ভাই
276974
২২ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৩৯
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ছোট হলেও ভালো লাগোলো
277114
২২ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৮
মামুন আব্দুল্লাহ লিখেছেন : অনেক সুন্দর লিখেছেন । অনেক ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File