প্রেম [গল্প/সংলাপ]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:২১:৫০ রাত
বিকালে নদীর ধারে বসে থাকার মজাই আলাদা। তবে এটা নদীর ধার নয়। এটা লেকের ধার। যে লেকটি নোংরা পানিতে ভরা। পানি দেখলেই গা শির শির করে ওঠবে যে কারোর। সাধারণত এই লেকে শালীন-অশালীন প্রেমিক জুটিদের আনাগোনা থাকলেও অনেক একাকী মানুষের বিরহ কাটানোর স্থান এটি।
রবীন্দ্র সরবোর পেরিয়ে ডানে নয় বামে দু’জন বসে আছে। একটি গাছের গোড়ায়। একজনের নাম অহনা আর একজনের নাম কিসব। আশে পাশের চলমান চোখরাশি তাদেরকে জুটি হিসেবে দেখলেও তারা জুটি নয়। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু যদিও প্রেম তবুও তারা অন্য জুটিদের মত জুটি নয়।
-অহনা, তুমি কি ভাবছ আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাবো। তুমি শিক্ষিতা, তুমি ভদ্র, তুমি অসাধারণ তবু তুমি ভাবছো কিভাবে আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাব।
-দ্যাখো কিসব, তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি আমাকে পছন্দ করো। এখন কথা ঘুরাচ্ছো তুমি। আমি একরকম তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।
-ঠিক আছে, আমি মানছি আমি তোমাকে পছন্দ করি। আমিতো আমাদের মাথার উপরের গাছটাকে তোমাকে পছন্দ করার আগ থেকেই পছন্দ করি, তাই বলে কি আমি এই গাছটিকে ভালোবাসি। তাই যদি হয়, তাহলে তোমাকে ভালোবাসার প্রশ্নই ওঠে না। এই গাছের সাথে সম্পর্ক আমার অনেক দিনের।
-তোমার কি মনে হয় আমি গাছ?
-তোমার নাক আছে, মুখমন্ডল আছে, ঠোঁট আছে, চুল আছে যা এই গাছের নেই। আবার এই গাছের পাতা আছে, বাঁকল আছে, শিকড় আছে যা তোমার নেই। এই গাছ আর তুমি এক নও তবু ভিন্নও নও। একবার ভাবো এই গাছটি যদি আমাকে ভালোবাসে আর আমি যদি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করি তাহলে এই গাছটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে নয় কি?
-তোমাকে বুঝতে হবে একটি গাছকে ভালোবাসা আর একজন নারীকে ভালোবাসা এক নয়। গাছ তোমাকে অনেক কিছুই দিতে পারবে না যা আমি দিতে পারবো। আমি তোমার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে পারবো, তোমার এ গাছটি কি তা পারবে?
-অসহায়! বড্ড অসহায় এই গাছ। অসহায়দের সম্পর্কে সবাই এরকম কথাই বলে থাকে।
-আমাকে ভালোবাসলে তুমি কি পাবে না বলো? আমার রূপ-যৌবন, আমার হৃদয়-মন আমার সবকিছু পাবে তুমি। তবু তুমি আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর কেন?
-কেননা আমি যদি তোমাকে পায়, তাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলবো। আমি আর আমি থাকব না। আমি আর মুক্ত আকাশকে ভালোবাসতে পারবো না। তুমি তো আমাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাস, তোমার তো বোঝা উচিৎ। খেয়াল করো, আজকে সকাল থেকে এ পর্যন্ত সময় তুমি কি করেছ?
-কি আবার? ঘুম থেকে উঠেছি, নাস্তা করেছি। আর কি?
-তোমার মন কি করেছে ভেবেছো? আমাকে ভেবেছে। শুধু আজকে নয়, অনেক দিন-রাত তুমি শুধু আমাকে ভেবে কাটিয়েছ। কিন্তু কেন? তোমার মস্তিষ্ক কি নষ্ট হয়ে গেছে নাকি অকেজো? ঘন্টার পর ঘন্টা একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরা। এটা যেমন বিরিক্তিকর তেমনি ভয়ঙ্কর খারাপ।
-আমি তোমাকে ভাবি কেননা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার প্রতি মূহুর্ত তোমার জন্য। আমার মূহুর্তগুলোর উপর আর কারো অধিকার নেই।
-অবাস্তব কথা বলছো তুমি। তুমি কি মনে করো তুমি সুস্থ আছো? এসব আবেগী কথা মনের জন্য ক্ষতিকর। তোমাকে দেখতে হবে অনেককিছু। আশেপাশের সবকিছু। তুমি আজ আমাতে এতটা আবিষ্ট হয়ে পড়েছ যে তোমার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। তোমার কোন দোষ নেই, সব প্রেমিকরাই এমন হয়। তাদের মন সাধারণ কাজকর্ম ছেড়ে একজনকে বৃত্ত করে ঘুরতে থাকে। এতে করে সমাজের জীবনীশক্তি কমে যায়। তরুণদের সময় অপচয় বৃদ্ধি পায়। তরুণদের মস্তিষ্ক এতটা আবিষ্ট হয় যে, তারা তাদের সম্ভাবনাময় চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে।
-কিসব, তুমি প্রেমিকদের পাগল বলতে পারো না। প্রেমিকদের মন হয় নরম এবং আবেদনময়ী। অন্যদিকে তুমি ইট-পাথরের মতো। তোমার মনে একটা বড় রকমের সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয়। তুমি আর সবার মত হও। তুমি আমাকে ভালোবাস।
-আমি যেদিন থেকে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করবো সেদিন থেকে তুমি আর আমাকে পছন্দ করবে না। কেননা আমি আর এমন থাকবো না। তুমি আমাকে পরিবর্তিত হতে বলতে পারো না।
-ঠিক আছে। আর কখনো বলব না। তুমি কি মনে করো সব ছেলে মেয়েরা ভুলের ভিতর আছে। তারা অযথা সময় অপচয়ে ব্যস্ত।
-অহনা! তুমি কি মনে করো ওরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে? আজকাল সবাই সবাইকে ব্যবহার করে বিশ্বাস নয়। প্রতিটা ছেলে প্রতিটা মেয়েকে অবিশ্বাসী ভাবে, আবার প্রতিটা মেয়ে ছেলেকে। তবে অবাক ব্যাপার সবাই বিশ্বাসী একজনকে চাই। তারা বোঝে না নিজে অবিশ্বাসী হয়ে বিশ্বাসী কাউকে পাওয়া যায় না। ভেবে দেখো, অবিশ্বাস কিভাবে দানা বেঁধেছে সমাজে। সবাই যদি পরিষ্কার মানসিকতার হতো তাহলে এ সমস্যা হতো না। সবাই সবাইকে বিশ্বাস করলে একটা বিশ্বাসের সমাজ গঠিত হতো। এখন এদেশে একটা ছেলে একটা মেয়েকে কেন চুম্বন করে, স্পর্শ করে জানো? কেননা ছেলেটি মেয়েটিকে বিশ্বাস করে না। ছেলেটি ভাবে, এগুলো করলে হয়তো মেয়েটি তার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না। তাও কি আটকিয়ে রাখা যায়! অবিশ্বাসের শক্তি এখানে প্রবল।
-তুমি সবসময় সঠিক কথা বলো, এজন্যই তোমাকে আমার ভালো লাগে। তবে আমার মনে সংশয় জাগে, তুমি কি সঙ্গীহীন থাকবে চিরদিন?
-তা কেন? আমিতো বৈরাগী হতে চাই না। আমি শুধু একটা নারী নামক বিন্দুতে আবদ্ধ থাকতে চাই না। কোন নারী যদি এটা মেনে নিতে পারে তবেই আমি তার সাথে থাকব। যদি এজনমে তাকে খুঁজে পায়, তাহলেই আমার সংসার হবে।
-আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, এই বিশ্বাসহীনতার কারণ কি?
-মানুষ বেশির ভাগ সময় মনের কথাকে চেপে যায়। প্রকাশের সময় বিকৃত করে বলে। এছাড়া একটি বাজে উদাহরণ দশজনের উপর প্রভাব ফেলে। এভাবেই অবিশ্বাসের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে। এটা দূর করা অতি জরুরী।
-আমি যদি তোমার সঙ্গী হতে চাই, তবে...
-সেটা তোমার জন্য দুরূহ কাজ হবে। তুমি কি ভাবতে পারো, আমি তোমার খোঁজ নিচ্ছি না তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার মনকে প্রসারিত করতে হবে আরো। তোমাকে ভাবতে হবে তুমি একটা মানুষ। তোমাকে ভাবতে হবে, পথের না খেয়ে থাকা শিশুটির কথা। তোমাকে ভাবতে হবে অনেক কিছু। তুমি শুধু চুলার তত্ত্ব আর রান্না তত্ত্ব নিয়ে পড়ে থাকতে পারবে না। অথবা টেলিভিশনের পোকা হয়ে পড়ে থাকতে পারবে না। তুমি কি ভাবতে পারো? এমন একটা দুঃসহ জীবনের কথা? জানি, তুমি ভাবতে পারো না, অথচ এটাই হওয়া উচিৎ।
-তুমি আমার প্রেমকে খাট করতে পারবে না, তুমি যা বলবে আমি তাই মেনে নিতে পারবো। তবু তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আচ্ছা, তুমি কি আবেগী হতে পারো না?
-সেটা হতে পারলে আমি অবিশ্বাসীও হতে পারতাম। আবেগ মানুষকে অবিশ্বাসী করে তোলে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তুমি যদি তোমার চেষ্টা করো, তবে তুমি পারবে। আমার ব্যস্ততাকে তুমি যদি মেনে নিতে পারো। আমার বহুমুখী স্বচ্ছ ভালোবাসাকে যদি তুমি মেনে নিতে পারো। আমাকে তুমি যদি বিশ্বাস করতে পারো, তাহলে তুমি পারবে।
তারপর কি হয়েছিল জানা নেই। অহনা তার বিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছিল কিনা জানা নেই। নাকি কিসবকে একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে ছুটে পালিয়েছিল! নাকি কিসব আবেগী হয়ে চুটিয়ে প্রেম করেছিল অহনার সাথে! সে যাই হোক না কেন, সেদিনের সেই শরতের বিকালটুকু এমনই ছিল।
বিষয়: সাহিত্য
১৬০৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুবই শক্তিশালী লিখনির সাবলিল বিন্যাসে ডায়ালগগুলো বেশ পুর্ণতা পেয়েছে। শরতের এক বিকেল দুজনের হৃদয়ে যেমনই কাটুক না কেন, পাঠক হিসেবে নিজের কাছে ভালো লাগার অনুভূতিটুকু বেশ উপভোগ করলুম।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন