দাসত্ব বরণ [সংলাপ]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৭ আগস্ট, ২০১৪, ০১:৪৮:১৯ দুপুর
[দুইজন মুসলিম বাঙালী নারী ইন্দ্রিলা এবং নিলাদ্রীর মধ্যে কথা হচ্ছে। ইন্দ্রিলা একজন অবিবাহিতা নারী এবং নিলাদ্রী বিবাহিত নারী।]
-নিলাদ্রী, তাহলে ব্যাপারটা কি রকম হলো? আমার কাছে তো মনে হয় যাচ্ছেতাই। ডিভোর্স কবে নিচ্ছো?
-এখনো ভাবার অনেক কিছু আছে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো ভাবছি।
-তবুও? তবুও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করবে? আমি এটা মানতে পারছি না। তুমি কোন যুক্তিতে দেরি করবে বলো।
-তার সাথে আমার বোঝাপাড়া আছে, জীবনের অনেক বোঝাপাড়া।
-আমার দিকে তাকাও নিলাদ্রী, আমার জীবনটা কি জীবন নয়? পুরুষ ছাড়া কি আমি বাঁচছি না? আর তুমি যার কথা ভেবে দেরি করছো, সে একটা বিশ্বাসঘাতক।
-সে বিশ্বাসঘাতক? হ্যা, ঠিকই বলেছ তুমি। তা না হলে আরেকটা মেয়েকে সে ঘরে তুলতে পারে! তুমি ঠিকই বলেছ, সে বিশ্বাসঘাতক। আমার আত্মার সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
-তুমি কি তার আত্মায় ছিলে? থাকলে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটাতে পারে সে। যদি তুমি তার আত্মায় থেকে থাকতে তাহলে নিশ্চয় ব্যাপারটা ঘটার আগে জানতে। কি নেই তোমার, রূপ-গুণ সবকিছু। তবু কিসের নেশায় পুরুষটি তোমাকে ছেড়ে গেল। আজ তুমি একদমই বলতে পারো না যে, তুমি তার আত্মায় আছো, অথবা কোনদিন ছিলে। বরং আমার মনে হয় কি, সেই তোমার আত্মায় এখনো ভর করে আছে। তা না হলে ছাড়তে এত সঙ্কোচ কেন?
-হুমম... সে তো আমার আত্নাতে আছেই। আমিও ছিলাম তার আত্মায়, এখন আছি কিনা জানি না।
-মনে করো, তুমি তার আত্নায় আছো। ঠিক আগের মতই। তবু তুমি কি তার কাছে থাকতে পারবে? তার আত্মায় এখন অন্যজন আছে। ধরলাম, অংশীদার আছে। তবু কি তুমি পারবে?
-পারবো আবার পারবো না। সাত বছরের সংসার আমাদের। কত স্বপ্ন কত আশা আমার বুকে।
-পারলে কি হবে আর না পারলে কি হবে? তুমি কি ভেবে নিয়েছ ব্যাপারটা মাত্র কয়েকটা শব্দ?
-আমি কিছু জানি না। মাথায় কিছু খেলছে না।
-যদি পারো তাহলে তুমি হবে বঞ্চিত। কেননা নতুন নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ বেশী থাকে। তাই সে এখন তার নতুন পত্নীকেই ভালোবাসবে। সৎ হলে দু’একদিন তোমার দিকে তাকাতে পারে। আর একটু বদ হলে, তোমাকে দাসী হয়ে থাকতে হবে। বলি, এ দাসত্ব ছেড়ে মুক্ত করো নিজেকে।
-তবু সাত বছরের স্মৃতিকে এত সহজে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি কি আমি? অতি কষ্টের এটা। তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে বুঝতে। বাবা বলেছে, সবকিছু ছেড়ে তার কাছে চলে যেতে। তবু আমি পারছি না।
-এক খাঁচা থেকে মুক্তি নিয়ে আরেক খাঁচায় যাওয়া আর কি। বাবার বাড়িতে গেলে আশে-পাশের নানান গুঞ্জন তোমাকে আরো বিতৃষ্ণ করে তুলবে। কেন যে মেয়েরা খাঁচায় বন্দী হতে চাই আমি বুঝি না।
-জগতের সব খাঁচাতো মেয়েদের জন্যই। প্রতিটা ঘর একেকটি খাঁচা। যেখানে বসবাস মেয়েদের। ক’জনে খাঁচার বাইরে আসতে পারে বলো।
-ও বিষয়ে পরে কথা হবে, এখন একটিবার ভাবো, একজন পুরুষ যদি একাধিক বিয়ে করে তবে ক’জনে তাকে কটাক্ষ করে। কিছু কিছু বোকা নারীরাতো তাদের সুপুরুষ ভাবতে শুরু করে দেয়। আর তল্লাটে হয়তো রটে যায়, নারীটা পুরুষটিকে ঠিক মত দেখ-ভাল করতে পারে নি তাই আরেকটা বিয়ে করেছে, এতে দোষের কি! পুরুষদের কাছেতো সে হয়ে যায় স্বার্থক প্রেমিক, তাকে অনুসরণে কিছু কিছু দুশ্চরিত্র মগ্ন হয়।
-তুমি দেখো, আমার বেলায় এরকম হবে না। আমি আমার সংসারকে আগলে রেখেছি অতি যত্ম করে। আমি পারবো এই ঝড়-ঝাঁপটা সহ্য করতে।
-নারীদের দাসত্ব বরণ করে নেবার যে একটা নিত্য অভ্যাস তৈরী হয়েছে তা বুঝতে পারছি। তুমি কি মনে করেছ, সমাজ তোমাকে ছেড়ে দেবে। সমাজ নারীদের ছেড়ে দেয় না। পুরুষ ধর্ষণ করলে সে বীরপুরুষ আর নারী ধর্ষিতা হলে সে কলঙ্কিনী। ধর্ষিতাকে ঘরে তোলা দায়। তবে ধর্ষক সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলেও হয়তো মেয়ের বাবা তার যোগ্যতা বিচারে মনে করবে, তরুণ বয়সে ছেলেরা একটু দুষ্টু হয়েই থাকে।
-তুমি ঠিকই বলেছ ইন্দ্রিলা। তবু সমাজকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমার তিন বছরের ছেলেটি যখন বাবাকে খুঁজবে তখন কি উত্তর দিবো আমি।
-উত্তর। এই উত্তরের জন্যই তুমি আজ দ্বিধান্বিত। এই উত্তরের জন্যই নিজেকে দাসী করতে রাজী। সাবাস, তোমার প্রতি আমার ঘৃণা জাগে।
-ঘৃণা। কেন? কিসের ঘৃণা? তোমার কি আছে বলোতো? ঐ এক স্বাধীনতা ছাড়া। তোমার কি স্বপ্ন জাগে না একটা সংসার করার? আমি আমার জীবনে আছি। তুমি কি জীবিত থেকেও মৃত নও।
-বাঁচা আর মরার ভিতর যখন পার্থক্য থাকে না তখন মৃত থাকাই ভালো। যদি সমাজটা আজ ভেদাভেদপূর্ন না হতো। আমি যদি আমার পূর্ন অধিকার পেতাম। তবে ঠিকই আমি ঘর করতাম, সংসার করাতাম। তুমি জানো, পুরুষেরা আমাদের কুরে কুরে খায়। আর আমরা নির্বোধের মত স্থবির থাকি। সমাজের এ গতি আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। মনে করো তুমি ওই সংসারেই থাকলে তারপর কি হবে? কি নিয়ে বাঁচবে?
-আমার ছেলেটি বড় হবে। তাকে আমি বড্ড ভালো করে পড়াবো। ও একদিন অনেক বড় মাপের মানুষ হবে।
-আশা, আশা তোমাকে দাসী করে রাখবে। আর তুমি সেটা বরণ করে নিলে। তুমি না শিক্ষিত একজন।
-আশা, হ্যা, আমারতো আশা আছে। তোমার কি আশা আছে? তোমার কি ছেলে আছে, যে একদিন বড় হবে?
[স্তব্ধ হয়ে গেল সব। ইন্দ্রিলা কঠিন নারী। তার চোখে জল নেই। সে ভাবে সে কি সঠিক। অপরদিকে নিলাদ্রীর মনে বারবার ইন্দ্রিলার কথা ভাসে। তাহলে কি এখন থেকে তার বঞ্চনার জীবনের শুরু!]
***সমাপ্ত***
বিষয়: সাহিত্য
১০৯০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন