গল্পঃ নজির আলী (উৎসাহ- ব্লগার প্যারিস থেকে আমি ভাই)
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৪৫:৩৬ রাত
১.
সূর্যের আলো তখনো ওঠেনি, তবে পুব আকাশ তার লালচে আভা ছড়িয়ে বলে দিচ্ছে কাজের সময় হয়েছে। নজির আলী এক হাতে বদনা নিয়ে আরেক হাত দিয়ে মুখে পানি পুরছে আর কুলি করছে। দেখেই বোঝা যায় তার তাড়া আছে। উঠোনের এক কোণে, যে ধারে একটা নোংরা ডোবা আছে সেখানে কালো রং-এর পানি কুলি করে ফেলছে নজির আলী।
কিন্তু পানি কালো কেন? তার কি কোন মরণ ব্যধি হয়েছে। না, তার কোন অসুখ করে নি। কয়লা দিয়ে দাঁত মাজার কারনেই এই কালো পানি। দাঁত মাজা শেষ করে, হাত-মুখ ভালো করে ধুয়ে খেজুর পাতা বিছানো পিঁড়ির উপর বসে নজির আলী।
নজির আলীর বউ রহিমা একটা কাঁসার প্লেটে করে পান্তা মরিচ নিয়ে আসে। তারপর পিছন থেকে ছোট একটা পানির ঘড়াতে করে পানি নিয়ে আসে নজিরের ছোট মেয়ে সখিনা।
সখিনা ক্লাস সিক্সে পড়ে, বয়স ১৪-১৫ হবে। আরো দু’টি মেয়ে আছে তার, তবে এ বাড়িতে থাকে না। কারণ বিয়ে হয়ে গেছে। নজির আলী কোন কথা না বলে আপনমনে খেতে থাকে। আজকে বউ অথবা মেয়ের সাথে কোন কথা বলে না নজির আলী। কারণ তার মনে শান্তি নেই। তবে নজির আলী এরকম লোক নয়। মানুষকে আনন্দ দিতে তার জুড়ি নেই। মজার মজার কথা বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পটু সে।
অথচ আজ সে বড় ক্লান্ত। তার ক্লান্তির রেখা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তা খেতে খেতে হঠাৎ একটা খড় তার পাতের উপর পড়ে। এর আগে কখনো এমনটি হয় নি তা নয়। যেখানে ঘরটা মাটির আর ছাউনি খড়ের সেখানে এটা হতেই পারে।
তবে আজ মেজাজ বিগড়ে যায় নজির আলীর। ভাতের থালাটা একটু উপরে তুলে ঝাঁকিয়ে মাদুরের উপর রাখে। পান্তার পানি আর ভাত ছড়িয়ে পড়ে মাদুরের উপর। তারপর খড়কে হাজার শত গালি দিতে দিতে ঘরে ঢুকে নিড়ানি নিয়ে বাইরে বের হয় নজির আলী। বের হবার সময় একটা গামছা মাজায় বেঁধে নেয়।
রহিমা উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে এ দৃশ্য দেখে বলে, ‘যত রাগ ভাতের সাথে, পালতে পারবা না তো জন্মায়ছিলে কেন?’
নজির আলী বলে, ‘জন্মাইছে তোর প্যাটে।’
বলেই গর গর করতে করতে নজির আলী বাড়ি থেকে বের হয়। সখিনা বাবা-মায়ের এ কথা শুনে বুঝতে পারে, তাকে নিয়ে কতই না ঝামেলায় আছে তাকে নিয়ে। সখিনা নীরবে কাঁদে, তবে সজোরে কাঁদার অধিকার মনে হয় তার ছিল না।
---------------------
২.
ধানের ভুঁই নিড়াচ্ছে নজির আলী, সাথে করিম আর মুনসুর। তারাও তার মত দিন-মজুর। তারা এর আগে একসাথে অনেক জন খেটেছে, তাই একরকম অলিখিত বন্ধুত্ব তাদের ভিতর। তারা বোঝে না বন্ধুত্ব কি, তবে বোঝে পাশের কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করতে হয়।
করিম বলে, ‘নজির ভাই, সখিনার বিয়েটা ঐ ছেলেটার সাথেই দিয়ে দে। শুনলাম ছেলেটা নাকি ভালোই।’
নজির বলে, ‘আমি তো দিতেই চাই, তবে টাকায় তো আর কুলায় না। দুটাকে বিদায় করতে দুই বিঘা গেছে, এইটা ক্যামনে সামলাবো উপায় পায় না।’
মুনসুর বলে, ‘তাই বলে কি মেয়েকে সারাজনম ঘরেই রাখবি। টাকার ব্যবস্থা দেখ করতে পারিস কিনা!’
করিম বলে, ‘মীর বাড়িতে গিয়ে বলতে পারিস। মীর সাহেবের মন ভালো থাকলে ধার দিয়ে দেবে।’
নজির বলে, ‘দেবে না রে পাগল, ওরা কেবল বড়লোকদেরই ধার দেয়। আগের বারও ধার চাইছিলাম, বলে কি জানিস? জমি থাকতে ধার করবি কেন? জমিটা আমার কাছে বেঁচে দে। কি আর করব, শেষে জমিই বেচতে হল।’
করিম বলে, ‘তো কি করবি এখন?’
নজির বলে, ‘আমিতো ভিটা বেচা ছাড়া আর পথ পায় নি। বুঝলি করিম, আমি খালি আল্লাহর কাছে দুয়া করি গরীবকে যেন মেয়ে না দেয়।’
মুনসুর বলে, ‘ছেলেপক্ষ চাই কত?’
নজির বলে, ‘পঞ্চাশ হাজার। তবে দাম-দর করে অনেক কষ্টে তিরিশ-এ নামাইছি। শালার ঘটক বলে কিনা, মেয়ে দেখতে বেশী ভালো না তাই বেশী টাকা লাগবে। তোরাই বল, আমার সখিনার মত সুন্দর মেয়ে এ পাড়ায় আর আছে?’
করিম আর নজির তার কথায় সম্মতি জানায়।
------------------------
৩.
যে বিয়ে বরপক্ষের লোকদের কাছে একটা জমকালো ভোজসভা অথবা একটা আনন্দ আয়োজন সে বিয়ে অপরপক্ষের কাছে যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা শহরের দালানওয়ালা মানুষরা না বুঝুক, তা ঠিকই এদেশের হত দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত মানুষেরা বোঝে।
যাই হোক, সেদিন বিকালেই বিয়ের দিন-তারিখ ধার্য করা হল। হাতে সময় বেশি নেই। সাতদিন পরেই বিয়ে।
রাতে নজির আলী আর তার বউ রহিমা পিঁড়ির উপর বসে আছে। আকাশের চাঁদ পিঁড়ির উপর পড়ে এক অন্য রকম সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সখিনা রাতে খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে তার বরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। আর মা রহিমা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। রহিমার অনেক কথা মনে হয় আজ, যেমন মাস্টার মশাই বলেছিল, ‘সখিনা পড়াশুনায় বেশ ভালো। ওকে পড়াশুনা করালে অনেক বড় হতে পারবে।’
সেজন্য বিনা টাকায় হাইস্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল মাস্টার মশাই।
একথা মনে আসতেই ভাবে, কি দরকার ছিল বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি হওয়ার? কিন্তু পরের মুহূর্তেই মনে হয়, বিয়ের কথা তো পাকা-পাকি হয়ে গেছে। তার মনটাও চুপসে গেল।
তারপরই তার মনে শঙ্কা জাগে, যে শঙ্কা কালবৈশাখীর শঙ্কার চেয়েই ভয়ঙ্কর। হঠাৎ ব্যাপারটা মনের ভিতর আসতেই ভয় পেয়ে স্বামীকে নরম সুরে বলে, ‘টাকা কোথায় পাবা তুমি?’
নজির আলী দায়িত্ববান একজন স্বামীর মত বলে, ‘উপায় একটা হয়ে যাবে, তুমার চিন্তা করা লাগবে না। তুমি মেয়েকে সব বুঝিয়ে-শুনিয়ে দাও।’
-------------
৪.
এদের বিয়েতে মেয়ের মত বলে কিছু নেই, তাই সখিনারও মতের তোয়াক্কা নেই। হয়তো তার পড়ালেখা শেখার ইচ্ছা শুকিয়ে যায় তার চোখের জলের মত।
যাই হোক, বিয়েটা হয়েও গেল শেষ পর্যন্ত।
বিয়ের পরে চিরায়ত এক শোকাবহ গ্রাম্য বিচ্ছেদ পর্ব। রহিমা তার মেয়ের মাথায় হাত বুলায় আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, সখিনাও কাঁদতে থাকে। এ শোকের দিনে নজিরের কাঁদার সময় নেই।
মীর সাহেবের কাছে ভিটা বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে এসেছে। করিম আর মুনসুর তাকে দিয়েছে সাত হাজার টাকা। কোন বড়লোক দানবীর যদি এই ক্ষীণ দানের কথা জানে, তবে অট্টহাসি দিয়ে বলবে, আমি তো প্রতি সকালেই এর পাঁচগুণ টাকা দান করি। কিন্তু এ যে শুধু দান নয়, কোন বিশেষ্য বা বিশেষণ দিয়ে একে প্রকাশ করতে পারবে না।
তবে নজিরের চোখও টলমল করে।
--------------------
৫.
মেয়েকে ফিরিয়েই আনতে হল শেষ পর্যন্ত। আর কতই বা সহ্য করা যায়। যৌতুকের পর যৌতুক! জামাইয়ের টাকা আত্মসাদের সাথে সাথে সখিনার পিঠেও দাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই উপায়ও ছিল না।
এখন নজির আলী থাকে করিমের ভিটেয়। ছোট একটা খড়ের ঘরে। আগের মত বড় উঠোন কিংবা পিঁড়ি তার ঘরের নেই।
সখিনা যায় প্রতিদিন মীর সাহেবের বাসায় কাজ করতে। রহিমা বেগম হয়তো কোন রাতে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। আর নিজেকে দোষারোপ করে বিয়েটা দেবার জন্য।
তবে নজির আলী কাঁদতে পারে না। তার রুটিনেরও পরিবর্তন নেই, আগের মতই ভোরে উঠে সে ছুটে চলে কাজে।
এখন শুধু বানের সময় নজির আলীর মন খুব খারাপ হয়, খরার সময়ও হয়। নিজের জন্য নয়, মাঠের জন্য। ধানে ভরা মাঠকে সে খুব ভালোবাসে।
***সমাপ্ত***
বিষয়: সাহিত্য
১৬০০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর লিখেছেন, ধন্যবাদ
নিরেট সত্য কথাটাই বলেছেন। এটাই বাস্তবতা। ধন্যবাদ জীবন থেকে তুলে আনা কষ্টের কথা গুলো লিখার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন