যাত্রাপথের অতীত [উপন্যাস- প্রথম অধ্যায়]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:০৬:২৫ দুপুর
ট্রেন কত লেট জানি না, তাই প্লাটফর্মে পাইচারী করছি। ষ্টেশন মাস্টার বলেছে ট্রেন আসতে আরো দু’ঘণ্টা লেট হবে। এটাই এদেশের রীতি। এ বিষয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, যা হাসির খোরাক যোগায় মানুষের। একদিন যাত্রীরা সঠিক সময়ে ট্রেন আসতে দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরে জানা যায়, আসলে ট্রেনটা তার আগের দিনের। মানে তার আগের দিন ট্রেনটা আসেই নি। এতে অবাক হবার কিছু নেই। এই শুধু ট্রেন নিয়েই একটা মন্ত্রানালয় আছে এদেশে, তবে এর কোন উন্নতি নেই। কেন নেই তা কারো অজানা নয়। মাঠের চাষী থেকে শুরু করে সবাই জানে এদেশের সমস্যাগুলো কি কি। তবে কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই এ নিয়ে। এসব অনিয়মের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে এদেশের মানুষ এবং প্রমাণ করেছে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা কত প্রবল। বরং কোন বিষয়ে অনিয়ম না হলেই দৃষ্টি চড়াকগাছ হয় এদেশের মানুষের।
ষ্টেশনে আসলেই কিছু ছেলেদের দিকে আমার নজর যায় বরাবরই। ছেলেগুলো সাধারনত ময়লা হাফ প্যান্ট আর সেন্ডো গেঞ্জি পরে থাকে। কেউ ঘোরে যাত্রীদের লাগেজ বহন করে পেট ভরার জন্য, কেউ আবার যাত্রীদের কাছে টাকা চাই পেট ভরার জন্য। আর কেউ কেউ আবার পত্রিকা বিক্রি করে। এক হাত বোঝায় পেপার নিয়ে প্লাটফর্মে ঘোরে আর বলে, ‘এই পেপার, পেপার, পেপার। তাজা খবর, তাজা খবর।’ তবে সবাই ঐ পেট ভরার ধান্ধায় সব করে।
একটা ওরকম ছেলের কাছ থেকে একটা পেপার কিনে নিলাম আমি। আমি দাঁড়িয়ে পেপার হাতে পত্রিকার পাতা উল্টাতে থাকলাম। খবরগুলো সেই পরিচিত। প্রথমে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক কিছু হট কেক দিয়ে। তারপর পত্রিকা জুড়ে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন অনিয়ম। রাজনৈতিক এই সব হট কেক পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়েছি অনেক আগে, তাই ভিতরের পাতায় গেলাম। হঠাত চোখে পড়ল একটা খবর ‘দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে গত চার বছরে’, আমি মুচকি হাসলাম। পুঁজিবাদী এই সমাজে মাথাপিছু আয় বাড়া মানে যে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়া তা নয়।
তার একটু পরেই পাঁচ কি ছয় বছরের একটা ছেলে সামনে এসে আমার সামনে হাত পাতে। আমি তার দিকে তাকালাম। তার মুখে কথা নেই। তবে মুখের মলিনতা যেন বলে দিচ্ছে, সে কত অসহায়। কেউ কেউ তাদের মলিন এই মুখের দিকে তাকিয়ে টাকা দেয়, কেউ নেকি উপার্জনের জন্য। আর অন্যরা এদেরকে পাশ কাটিয়ে যায় বা যাচ্ছেতাই ভাবে গালিগালাজ করে। তাদের মতে, এটা এদের নিছক ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ওকে দুই টাকার একটা নোট দিলাম। ছেলেটি টাকাটা নিয়ে খুশী হয়ে এক লাফে আরেক যাত্রীর কাছে গেল। তার কাছে যেয়ে একি আবদার করে হাত পেতে। এই ভাষাহীন আবদার সবাই বোঝে। এ জগতে সব ফুরোয়, কিন্তু এদের আবদার যেন ফুরোয় না। হাতের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে।
পাইচারী করতে করতে হঠাত দেখি একটি মানুষ। তার দুটি হাত, দুটি পা আর পোশাক পরা সভ্যতা প্রকাশের জন্য। আরেকটু চোখ সরাতেই দেখি একজনকে। তারও দুই হাত, দুই পা। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে একদিন আমার ঘুম ভাঙত। তবে, সে মানুষ নয়, সে আমার বন্ধু, নাম তার তরু। কত বছর পর দেখলাম তরুকে? হাতের কর গুনে বের করলাম আট বছর। এই আট বছরে সে আমার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর তার আর দেখা পাই নি আমি। সে তার কাজে ব্যস্ত, আমি আমার। অনেকদিন আগে শুনেছিলাম একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকুরী করে সে। আজ সে আমার কাছে, খুব কাছে। এইতো কয়েক গজ দূরে।
বেশ অন্যমনস্কভাবে বসে বাদাম খাচ্ছে তরু। তার দৃষ্টি বাদামের দিকে। পৃথিবীর আর কোন দিকে নজর নেই তার। আমি ইতস্ততঃ, ভুল হচ্ছে না তো আমার, ও কি তরুই নাকি তরুর মত দেখতে অন্য কেউ। অন্য কেউও তো হতে পারে? ভার্সিটিতে পরার সময় একদিন আমিও বসে ছিলাম প্লাটফর্মে, হঠাত এক বৃদ্ধ লোক ট্রেন থেকে নেমে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, আমাকে অতিক্রম করে চলে যাবার পর আবার ফিরে আমার সামনে এসে বলে, ‘বাবা, তুমি দেখতে একদম আমার ছেলের মত। আমার ছেলের নাম রাশেদ। রাজশাহী ভার্সিটিতে বিবিএ-তে অনার্স পড়ে। আমিতো ভুল করে ভেবে বসেছিলাম তুমিই রাশেদ।’
আমি চকিত এই আলাপচারিতায় বললাম, ‘জি।’
লোকটি আমার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। আমি আপনমনে হাসলাম আর ভাবলাম, ভালো তো, আমার মত আরেকজনও আছে এ জগতে তাহলে।
আরো নিশ্চিত হবার জন্য তরুর আশ-পাশ ঘুরে দেখলাম। সেই পটলচেরা চোখ, মুখাবয়বে সেই পরিচিত ছাপ। তরুই তো, তরু ছাড়া আর কে হবে সে। এতদিন পর দেখায় কি বলব ওকে। কতবছর হল একটিবার খোঁজও নিই নি। আবার মনে হল, আমি মিছি মিছি নিজেকে দোষারোপ করছি। তরুওতো আমার খোঁজ নেই নি একদিনও। মনের নানা ভাবনাকে ছুটি দিয়ে তরুর সামনে গেলাম, বললাম, ‘তরু!’
তরু বাদামের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দু’চার সেকেন্ড সময় নেয় আমাকে চিনতে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলে, ‘দোস্ত। কত বছর পর দেখা।’ তারপর আমার সাথে কুলাকুলি করে। দু’জনের মুখেই হাসি। আমার বুকটাও আনন্দে ভরে উঠলো। মনে কেমন জানি সুবাতাস বইতে লাগল। কিন্তু খটকা লাগল হ্যান্ডসেক করে সে বুকে হাত দিল না দেখে। বরং আজ আমিই বুকে হাত দিলাম। এই পরিবর্তন আমার মনে নাড়া দিল।
এই আমরা দু’জন ভার্সিটিতে পড়ার সময় কত রাত চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে কাটিয়েছি তার কি কোন হিসেব আছে? চায়ের দোকানে বসলেই কত-শত গল্প হত তখন। দেশের গল্প, বিদেশের গল্প, রাজনীতির গল্প। তবে সবচেয়ে বেশী হত রহস্যময়ী নারীদের নিয়ে গল্প। নারীদের বিভিন্ন আচার-আচরনের অসঙ্গতি বের করাই তখন বুঝি আমাদের কাজ ছিল। তবে তবু নারী ছাড়া যে পুরুষ চলতে পারে না তা অস্বীকার করতে পারতাম না আমরা। তরুতো সবসময় নতুন নতুন মেয়েদের পিছনেই পড়ে থাকত। তার আশা কেউ না কেউ তার মনের কথা বুঝবে। কত জনের পিছনে যে তরু ঘুরত তার ঠিক নেই। তবে তার মানুসিকতার সাথে কারো মানুসিকতাই বেশীদিন একসাথে থাকত না। মানুসিকতার এই সংযোগ খুঁজে বের করা মনে হয় পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ। তবে মন যে মানে না, মনের সঙ্গী খুঁজতে মন ব্যাকুল থেকে যায় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। যতক্ষণ না মন খুঁজে পায় তার সঙ্গী, ততক্ষণ মনের এই ব্যাকুলতার শেষ নেই।
হয়তো একদিন তরু রুমে ফিরে বলেছিল, ‘লাবণী মেয়েটার সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। দেখ বন্ধু আমি সব সময় তার জন্য বিসর্জন দিতে চেয়েছি। কিন্তু সে কি করল? তরিকের সাথে ডেটিং শুরু করেছে। এটা কি করে মানি?’
রুমমেট বড় ভাই শরিফ বলে, ‘তুমি তো এমন এক মানুষ যে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাক। মেয়েটাকে ঠিক মত সময় দিতে পারো নি। তাই আরেকজনের দ্বারে মেয়েটি। মেয়েদের চাহিদা নিবারণ সহজ নয় বৎস্য।’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তরিকের বাবা কি করে বলত?’
তরু বলে, ‘ঢাকাতেই থাকে তরিকরা। আর কিছু জানি না তেমন। ৩২৯ এ থাকে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে কি হল? প্রেমনং অর্থনং তপ। ছেলে ধলা হোক বা কালো হোক। খাক না সিগারেট বা হিরোইন। মেয়েদের সেটাতে নো প্রবলেম।’
শরীফ ভাই সব সময় বলত, এযুগে মেয়েরা তিনটি জিনিস দেখে প্রেম করে। এক-চেহারার সৌন্দর্য, দুই- কথা বলার স্টাইল আর তিন- টাকা। আর বাকী সবাইকে মেয়েরা বোকা আবুল মনে করে। তারা মনে করে এই তিনটা জিনিসই পুরুষের মনকে প্রকাশ করে। কিন্তু মন অত সহজ জিনিস না। মন এক রহস্যময় জিনিস। মেয়েদের মন অনেকে মনে করে অনেক জটিল মন, অনেক রহস্যময়। তবে তা ঠিক নয়, কারণ মেয়েদের সাথে কয়েকদিন মিশলেই তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। আর ছেলেদের মনের টিকিটিও এই ক’দিনে মেয়েরা বুঝতে পারে না। কারণ, ছেলেদের মন সুপ্ত অবস্থায় থাকতেই বেশী পছন্দ করে।
আমি শরিফ ভাইয়ের এই কথার সাথে একমত না হয়ে পারতাম না।
তরু আমার কথা শুনে হাসে আর বলে, ‘কারে যে বিশ্বাস করি। বিশ্বাসকেই অবিশ্বাস করতে মন চাই।’
শরিফ ভাই পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে, ‘আরেকটা শুরু করে দাও, নয়তো ভুলতে পারবে না।’
একথায় তরুর উত্তর নেই। তবে তার মনের গাড়ি যে আবার যাত্রা শুরু করবে তা আমার অজানা ছিল না। আমার জানাটা কয়েকদিন পরই ফলে গিয়েছিল এবং খুব ভালোভাবে।
এরকম কত মুহূর্ত পার করেছি তরুর সাথে। আজকে হঠাত দেখায় সে সব কথা মনের ইন্দ্রিয়গুলোতে ধাক্কা দিয়ে যায়। আমি অবাক হলাম। এভাবে আর কখনো যে ধাক্কা দেয় নি এ স্মৃতিগুলো। তাহলে আমি কি নিষ্ঠুর হয়ে গেছি?
তরু আমাকে বলল, ‘তারপর কি খবর? কত দিন পরে। বস, গল্প করি।’
কি গল্প করব? আগের মত কি গল্প জমবে আজ! তরু কি আগের মত সেই সতেজ আছে! নাকি আমি আছি!
আমি তরুর দিকে তাকাতে তাকাতে তার পাশে বসলাম। আমি তরুকে বললাম, ‘তুই এমন হয়ে গেছিস কেন? চেহারা দেখে মনে হয় ছন্নছাড়া ভাব।’
তরু বলে, ‘আগের মতই মেয়েদের মত চেহারা বিশ্লেষণ। তুই একদমই পাল্টাস নি। সব ঠিক আছে। তুই তো পুরায় কবিদের মত লেবাস ধরেছিস। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ আর পাঞ্জাবী। ভালোই মানিয়েছে তোকে। ভালোই লিখিস এখন। গত বইমেলায় তোর একটা বই কিনেছিলাম। নাম কি ছিল যেন? মনে পড়ছে না।’
নামটা খোজার জন্য একটুখানি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘হুম মনে পড়েছে। দুর্দিনের সঙ্গী-সাথী, তাই না? বেশ ভালোয় লিখেছিস। ঐ যে লিখেছিলি,
মোর হৃদয়ের সন্ধানে
কে তুমি গন্ধা এসেছিলে
তাকিয়ে আমার পানে
কি তুমি বলেছিলে মনে মনে।’
এই মাথা ঝাঁকিয়ে মনে করার ধরন আমার একরকম মুখস্থ। আমি ওর দিকে এক পলকে চেয়ে বললাম, ‘ঠিকই বলেছিস। কিন্তু বইটার নাম ‘দুর্দিনের অভিযাত্রী’ ছিল।’
‘ওই আর কি? তারপর কি খবর? ভাবী কেমন আছে? তোর দুর্দিনের অভিযাত্রী কি নোঙর ফেলেছে তোর তীরে?’
‘ভাবী মানে? ভাবী হল কবে? তুই বল, রুমানার কি খবর?’
‘রুমানা। ও রুমানা। ভালো। খুব ভালো আছে। কোথায় যাবি?’
‘কোথায় আবার, সৈকতে। মন-মেজাজ ফুরফুরে করতে।’
‘সমুদ্র সৈকত কি শুধু মন মেজাজ ফুরফুরেই করে রে। সমুদ্র হচ্ছে উথাল-পাতাল রাগিনী। সেই রাগিনীকে দেখেই আমাদের মনের রাগ কেটে যায়। মন স্থবির হয়, শান্ত হয়।’
‘এই, তুই দার্শনিক হইলি কবে? দর্শন তো তোর চিরদিনের শত্রু ছিল। প্রকৃতির সাথে মৈত্রী গড়তে সৈকতে যাওয়া। তুই তো জানিস, প্রকৃতি কত প্রিয় আমার। আমার জীবন তো প্রকৃতিই।’
‘সংসার চলে কিভাবে তোর?’
‘আমি তো নিজেই এক সংসার। আমার সংসারে আমিই একমাত্র সদস্য। বাবা-মা তো চলে গেলেন কয়েক বছর আগে। চলে যায়, ঊনি চালিয়ে দেন। তুই কি করিস এখন? ব্যাংকে চাকরী।’
‘ওরকমই কিছু একটা’ একটু থেমে বলে, ‘তুই সৈকতে ঘুরে কি পাবি। প্রকৃতি নাকি অনামিকাকে! আমার মনে সংশয় আছে।’
আমার মনটা কেমন জানি চমকে উঠল। কতদিন পর আমি কারো মুখে এই শব্দটা শুনলাম। অনামিকা! শব্দটাই যেন রহস্যে ভরা।
দু’জন নানা গল্পে মজে উঠলাম। বর্তমান দেশে নিজেরা কিভাবে জীবন যাপন করছি তাই ছিল বিষয়বস্তু। আমরা একদম পাল্টে যায় নি। একদম আগের মত আছি। আলাপচারিতার ঢঙটাও আগের মত। আমি ভাবতেও পারি নি এভাবে মিশে যেতে পারব তরুর সাথে হঠাত দেখায়। সম্পর্কের টানাপোড়নে কোন সম্পর্ক মানে অটুট রাখা খুব কঠিন কাজ। এ কাজ যারা করতে পারে তারা উঁচুমাপের সামাজিক প্রাণী। আমরা কথা বলছিলাম আর পাশে যাত্রীদের আনাগোনা। সকালের পাখির মত তাদের কিচিরমিচির। এক চা বিক্রেতা মামার কাছ থেকে চা নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম।
আট বছর আগে। আমরা এমনভাবে ক্যাম্পাসে এক বটতলায় বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাত তরু আমার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে বলে, ‘দেখেছিস মেয়েটাকে, কত সুন্দর, দেখতে রাজকন্যার মত। আমি এই মেয়ের সাথে প্রেম করবই।’
তরুর মন কখন কেমন হয় তা বলা মুশকিল। হঠাৎ কখন কি করে বসে বলা মুশকিল। ও যা বলে, তা করায় খুব মনযোগী হয়। এটা ওর একটা বড় গুণ।
বলেই চা টা আমার পাশে রেখে তরু চলে যায় মেয়েটার সামনে। মেয়েটিকে গিয়ে চঞ্চলভাবে বলে, ‘হাই, আমি তরু। তোমার নামটা কি জানতে পারি?’
তারপর হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তরু। মেয়েটি উত্তরে বলে, ‘আপনি কে?’
ভাবখানা এমন করল যে এরকম উত্তর যেন আশা ছিল না তরুর।
তরুতো বলল সে তরু, তবু তার প্রশ্নে মেয়েটি আবার একই কথা বলল।
মেয়েটি এবার বলে, ‘আমি তো আপনাকে চিনি না। দুঃখিত।’
একথা বলে মেয়েটি তার বান্ধবীর হাত ধরে মাথা নিচু করে চলে গেল। তরু পিছন দিক থেকে তাকে দেখল যতক্ষণ না তার চোখের আড়াল হয়। তাকাতে তাকাতেই আমার পাশে এসে বসে আবার তরু। ঠাণ্ডা চা এক ঢোকে সাবাড় করে।
আসলেই মেয়েটি ছিল অনিন্দ্য সুন্দর। দুধে আলতা দেওয়া গায়ের বরন, চোখ দু’টি চঞ্চল, মুখাবয়বে এক অকৃত্রিম মায়ারছাপ। যে মায়া যে কোন ছেলেকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট। তবে আমাকে নয়, কেননা, সে অনামিকা নয়।
পরদিন ভোর সাতটায় আমাকে ডাকে তরু, ‘এই ওঠ। সকাল হয়েছে। ওঠ।’
আমি ঘড়ি দেখে আবার চোখ বুঝলাম, কিন্তু আর ঘুম আসল না। বিছানায় শুয়েই তাকিয়ে দেখলাম তরু সাজগোজ করছে। হলে সাধারণত সকাল হয় দশটায়। কিন্তু তরুর সকাল আজ অনেক তাড়াতাড়ি হয়েছে কেন? আমি তরুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথাও যাবি নাকি?’
কনভারসের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে তরু বলে, ‘ক্যাম্পাসে একটু কাজ আছে।’
সেদিন আমাদের কোন ক্লাস ছিল না। তাই আমি ক্যাম্পাসে যায় নি। তরু সেদিন সন্ধ্যায় ফিরল। বিকালে ঘুমানোর পর ওর ডাকেই ঘুম ভাঙল। কনভারসের ফিতা খুলতে খুলতে ওকে বলতে শুনলাম, ‘মেয়েটাকে তন্ন তন্ন করে খুজলাম। লাইব্রেরী, সব ডিপার্টমেন্ট, কেন্টিন কোন কিছুই বাদ রাখি নি।’
আমি হাসি থামাতে পারলাম না। তরু যে ভোর থেকে সেই মেয়ের সন্ধানে ক্যাম্পাসে বিচরণ করেছে বুঝতে বাকী থাকল না আমার। চিত হওয়া থেকে সটান বসে আমি জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। তরু আমার হাসি দেখে বোঝে কেন আমার এই হাসি, ও বলে, ‘আর বলিস না রে। আজ পায় নিতো কি হবে? কাল ঠিক পাব।’
পরের দিন পরের দিন, তার পরের দিনও মেয়েটার খোঁজ পেল না তরু। তবে তার পরের দিন আমরা আবার সেই বটতলাতে বসে ছিলাম। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, তরু মন খারাপ করে মাথা নিচু করে চা পান করছে। আমি তরুর মাথাটা ঝাঁকিয়ে হাত ইশারা করলাম। তরুর মুখে মুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল। সে তার ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। আমি বললাম, ‘কি খুঁজিস? চলে যাচ্ছে কিন্তু।’
একথা শুনতেই তরু তার ব্যাগের সব জিনিস ঢেলে ফেলল তারপর বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে কি যেন খুঁজতে লাগল।‘
‘চলে গেল কিন্তু, রিক্সায় উঠছে।’
আমি তরুর দিকে তাকিয়েই দেখি তরুর হাতে একটা সুন্দর খাম। ততক্ষণে রিক্সা ছেড়ে দিয়েছে। তরু দৌড়ে গিয়ে রিক্সা থামায়। মেয়েটির হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমার জন্য।’
রিক্সাওয়ালা মামাকে বলে, ‘এই মামা যাও।’
তরুর সাহসের তারিফ করতে হয়। তবে চিঠিটা লিখল কখন পাগলটা। কোন রাতে যে না ঘুমিয়ে লেখেছে তা আমি জানতাম না। তরু ফিরে আসে হাসি মুখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মিশন কমপ্লিট। তুই যদি না দেখতিস, তাহলে কিছুই হত না। থ্যাংকস দোস্ত।’
আমি মনে হয় এই অভিবাদনের আশা করছিলাম না। তাই অপ্রত্যাশিত এই অভিবাদনের জন্য পর আমি বললাম, ‘কি খাওয়াবি?’
তরুর উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে আমার মনটা ভরে উঠল। সে তার উচ্ছ্বসিত ভাব বজায় রাখে। আমি সবসময় তরুর মুখটাকে এমনই দেখতে চাইতাম।
তরু বলে, ‘যা চাবি তাই।’
ব্যাগে জিনিসপত্র ঢোকাতে থাকে তরু।
হঠাত ঘোর ভাঙে তরুর কথায়। ট্রেন এসেছে, চল। আমি আমার পাশে রাখা ব্যাগটা বাম কাঁদে ঝুলিয়ে নিলাম।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন