গল্পঃ প্রতীক্ষায়
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩১:৪৯ দুপুর
কাঠের চেয়ারে বসা। পাশে আরো দু’জন। সবার মুখের চামড়া জড় জড়। দাঁড়ি-গোফ, চুল পেকে সাদা। দাঁড়িতে মেহেদী দিতে মন চাই আকবর আলীর, কিন্তু কে দেবে তাকে? বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরের জগত দেখতে থাকে আকবর আলী। তার চোখে ভেসে ওঠে নানা অতীত স্মৃতি।
পাশে বসা লিয়াকত সরদার পান চিবুচ্ছে। ইদানীং পান চিবুতে তার সমস্যা হয়। দাঁতের মাড়িগুলোতে প্রচন্ড ব্যথা, সামনের কয়েকটি দাঁত তো আগেই গেছে। যুবক কালে পুরো দুস্তর কুস্তিবিদ ছিল লিয়াকত সরদার। তবে আজ আর তার সেই সরদারী তেজ নেই।
তার পরের জন মীর তাহির। কয়েকদিন আগে তার ছেলে তাকে পাজেরো গাড়িতে করে দিয়ে গেছে। পাঁচদিন ধরে প্রচন্ড ঠাণ্ডা-জ্বর তার। মাঝে মাঝেই খক খক করে কেশে ওঠে।
আকবর আলী অনেক কষ্ট করে মীর তাহিরের ছেলের কাছে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা, তোমার আব্বার তো দু’দিন ধরে ঠাণ্ডা-জ্বর।’
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, ‘জ্বর? বাবার তো মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। ঊনাকে গোসল করতে দিবেন না। দু’দিনেই ভালো হয়ে যাবে।’
দু’দিন পার হয়ে চার-পাঁচ দিন হয়ে গেছে, তবু জ্বর যায় নি। মীর তাহিরের ছেলেও কোন খোঁজ নেয় নি। এই ক’দিনে ওষুধ বলতে নাপা ছাড়া কিছুই জোটে নি তার। আজকে মীর তাহিরের অবস্থা খুব একটা ভালো না।
আকবর আলী ভাবে, ‘আমার ছেলেই তো ভালো। প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর একবার এসে দেখে যায়। আমাকে আব্বা! আব্বা! বলে বার বার ডাকে। কিন্তু আমাকে এখানে আসতে হল কেন? কিসের জন্য?’
হঠাত প্রশ্নটা মাথায় আসে আকবর আলীর। তার ছেলে যে তাকে এখানে আসতে বলবে তা কখনো ভাবতে পারি নি। তার স্ত্রী সালেহা বেগম মারা যাবার দু’মাস যেতে না যেতেই তোড়-জোড় শুরু হয়। বৌমাকে একদিন বলতে শোনে আকবর আলী, ‘তোমার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো। ঊনার দেখ-ভাল করার মানুষ কই বাড়িতে?’
কথাটা শুনে আকবর আলী যেন থ’ বনে যায়।
তার ছেলে কিছু বলে না। তবে ছ’মাসে এসে আর বৌমার কথা ফেলতে পারে নি সাহেদ।
প্রথম প্রথম আকবর আলী ভেবেছিল, ‘এ কি নিষ্ঠুর দুনিয়া! আমাকে দূরে ঠেলে দেবার এই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কি আমার ছেলে?’
আকবর আলীর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য মন পরিবর্তন হয়।
‘ঠিকই তো বলেছে বৌমা। আমাকে দেখার লোক কই! সাহেদ তো তার চাকরী নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আর বৌমা দুই নাতি নিয়েই থাকে সারাদিন। সামান্য কথা বলার লোকও নেই তো। মাঝে মাঝে কাজের বুয়ার সাথে দু’একটা কথা হয়। তার চেয়ে বরং নতুন আবাসে যাওয়ায় ভালো। ওখানে তো দু’দন্ড কথা বলার লোক পাওয়া যাবে।’
এগুলো ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আকবর আলী।
ভালোয় লাগছিল এখানে আসার পরের ক’দিন। তবে সে একদিন আবিষ্কার করল সে আছে কিছু মৃত্যু ব্যক্তির মাঝে খাঁচার প্রানীর মত। জীবনের রস-স্বাদ এখানকার মানুষদের নেই। তাই এখন আশা-নিরাশা কিছুই ছুঁয়ে যায় না তাকে।
পরদিন সকাল হতে না হতেই একটা খাটিয়া এসে থামে এই মৃত্যুপুরীতে। মারা যাবার সময় মীর তাহির বারবার বলছিল, ‘আমার ছেলেকে একটু খবর পাঠাবেন কি কেউ? আমি তাকে শেষবারের মত দেখতে চাই।’
দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে মীর তাহিরের ছেলে। তার কান্না আকবর আলীর কাছে মেকি মনে হয়। এই শোকের দিনেও আকবর আলী এ পরিহাস দেখে বিষণ্ণ এক হাসি দেয়। কত শত পিতা যে তার সন্তানকে না দেখার বেদনা নিয়ে চলে যায়, তা ক’জনে জানে?
আজ বড্ড নিজের ছেলেকে দেখতে মন চাই আকবর আলীর। একবার, এক মিনিটের জন্য। সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে দৃষ্টি দিয়ে তার ছেলের আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে আকবর আলী। সে প্রতীক্ষায় থাকে পরের দিন, পরের দিন এবং পরের দিন...।
*****
বিষয়: সাহিত্য
১৭৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন