::আলেয়ার কথা::]]]][[[[[চতুর্থ অধ্যায়]]]]][[[::
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৬ জুলাই, ২০১৩, ০৪:২৮:৪৩ বিকাল
কোমল বরণ এ কিশোরী লাল বেনারসি পরে। কানে দুল, কপালে টাইরা, চোখে মাশকারা, গলায় হার, হাতে মেহেদী অথবা পায়ে আলতা দেওয়া হয়নি তার। শুধু হাতে আংটি ছিল। ভাবী বলেছিল, ‘পরে নে সব গয়না।’ তবে আলেয়া সে গয়না পরতে পারে নি। তাতে যে আবেদার দাগ লেগে আছে। তার চল্লিশার এ দিনে কেমন করে সে ঐ গয়না পরবে। তবু ক্ষীণ এ সাজেও আলেয়া সুন্দরী এবং আবেদনময়ী।
সকালে ভাবী আর শাহানাজ মুখে হাসি নিয়ে তার সামনে হাজির হয়। তার হাতটা নিয়ে আঙ্গুলের মাপ নেয় ভাবী। আলেয়া বলে, ‘কি হবে মাপ নিয়ে?’
ভাবী কোন কথা বলে না, নিখুঁতভাবে মাপ নিতে ব্যস্ত। শাহানাজ বলে, ‘তোর তো আজকে বিয়ে।’
এ ষড়যন্ত্র বুঝতে বাকী থাকে না আলেয়ার। চল্লিশা উপলক্ষে এমনিতেই বাড়িতে আত্মীয় সজনের সরব উপস্থিতি। এক ঢিলে যে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা হয়েছে তাও বোঝে সে। তবু কিছু বলে না, কারণ যা তার কাছে ষড়যন্ত্র তাই সবার কাছে আনন্দ এবং পরিতৃপ্তি।
সেদিন দুপুরে ভাবী তাকে বলেছিল, ‘কোন সাগরে যাচ্ছিস জানি না, দোয়া করি সুখে থাকিস।’
শোক পালনের সন্ধ্যাতেই কাবিন নামা খোলা হল। কবুল বলার সময় আসলে, আলেয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মা, ভাবী এবং অনেকে তার কাছে অনুরোধ করে ‘কবুল’ বলতে। তবে আলেয়ার মুখ সরে না। অবশেষে যখন হাজী সাহেব এসে বলেন, ‘মা, কবুল বল।’
আলেয়া একবার মাত্র অস্পষ্ট স্বরে ‘কবুল’ বলেই ভাবীর বাহুতে ঢলে পড়ে। জ্ঞান হারায় সে, তার সিক্ত কপোল ভাবীর হাত ভিজিয়ে দেয়।
জ্ঞান ফিরে পেলে, আলেয়া দেখে সে তখন বাসর ঘরে। বিয়ে রাতে হওয়ায় বাসরের ব্যবস্থা আলেয়াদের বাড়িতেই হয়েছিল। তার ঘরই এখন বাসর ঘর। জ্ঞান ফিরে আসতেই সে টের পায় তার মাথায় কে যেন হাত বুলাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে দেখে মা বসে আছে।
স্বাভাবিক হতে বেশী সময় লাগে না তার। শাহানাজ তার জন্য শরবত নিয়ে আসলে, আলেয়া শাহানাজের দিকে তাকায়, বলে, ‘তুই এখনো যাস নি!’ শাহানাজ অপরাধীর মত মাথা নিচু করে। কিছুসময় পরই ভাবী তাদের ডেকে নিয়ে যায়।
আলেয়া একা বসে থাকে তার ঘরে; তার বাসর ঘরে। বিছানায় বসেই ঘরটাতে চোখ বুলায় সে। আয়নার দিকে তাকাতেই তার মন কেঁপে ওঠে, এইতো সেদিনও স্কুল যাবার আগে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চুল বাঁধত, বোরকা ঠিক-ঠাক করত। পাশের বইয়ের তাকগুলো যেন তাকে বলছে, আমাকে ছেঁড়ে যেও না, তুমি ছাড়া যে আমি একা হয়ে যাব। তার ঘরের জানালাও তাকে অনুনয় বিনয় করে, তুমি ছাড়া চাঁদনী রাতে কে খুলবে আমায়? আমাকে চাঁদের আলো মাখাবে কে?
সব কল্পনার শব্দ ছাড়িয়ে পায়ের শব্দ শুনতে পায় আলেয়া। ঘরে প্রবেশ করে মোঃ মোখলেছুর রাহমান মখলেছ, একজন এনজিও কর্মী, আলেয়ার সদ্য বিবাহিতা স্বামী।
আজ স্বামী মখলেছের দিকে তাকিয়েই আলেয়া বোঝে, এ পুরুষ তার প্রতি নির্মম হবে। তার মুখাবয়ব, চোখ যেন দৈত্য-দানোর মত।
আলেয়ার ভাবনার ব্যতিক্রমও হয় না। প্রথম আলাপচারিতায় মখলেছ তাকে বলে, ‘আমরা কিন্তু আগামী আট বছর কোন সন্তান নিচ্ছি না।’
এছাড়াও নানা বিধি আরোপ করে মখলেছ। যেমন তার অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না। তাকে না বলে বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
এসব নিয়ম আলেয়ার কাছে জেলখানার নিয়ম মনে হয়। সে শুধু তার কথা পাথরের মত শোনে। কোন অভিযোগ করে না। নিউটনের পরম স্থিতি যে তার মনে, কি করে সে তার অসার মনকে আজ জাগাবে।
অবস্থা বুঝতে পেরে এ রাতে বেশী দূর এগোয় না মখলেছ। তবু ভোর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আলেয়ার। তার পাশে শোয়া স্বামীকে তেলাপোকা অথবা সাপের চেয়ে বেশী ভয় পায়। সাবধানে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে আসে। মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয় সে। মা সালেহা বেগম তখনও জেগেই ছিলেন, তিনি ঘরের দরজা খুলে দেন। আলেয়া ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মাকে জড়িয়ে ধরে। সালেহা বেগম বলেন, ‘কি হয়েছে মা? কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’
আলেয়া শুধু কাঁদতেই থাকে। সালেহা বেগমও বোঝে তার মেয়ের মনের কষ্ট, মেয়ের অমতেই তো বিয়েটা হল। তবু কিছুই করার ছিল না তার। সালেহা বেগমও মেয়ের এ শোকের সঙ্গী হয়। দুই শোক তার বুকটাকে হাহাকার করে দেয়। আরমান সাহেব উঠে পড়েন ঘুম থেকে। বিরক্ত হবার মত মন তার আজ নেই। চুপিচুপি উঠে উঠোনে চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসেন তিনি। অন্ধকারের সাথে শোক বিনিময় করলেন কিনা তা জানা গেল না। পুরুষের শোক অন্যরকম। নিঃশব্দে কত পুরুষ কত শোকের ঋতু পার করে তা কেউই জানতে পারে না। তাই অনেক নারীরাই পুরুষকে ভুলে নিষ্ঠুর ভাবে। ফজরের আজান পর্যন্ত হাজী বাড়িতে শোক চলে।
সেদিন সকালেই আলেয়াকে যেতে হয় শ্বশুর বাড়ি। সালেহা বেগম আলেয়াকে একান্তে ডেকে অশ্রুসজল চোখে হাতজোড় করে বলেন, ‘মা, আমি তোর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। তুই শুধু ঐ দুধের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে সংসার করবি। আর কোন সমস্যা হলে জানাবি। এদিকে তো আমরা সবাই আছি।’
আলেয়া মনে মনে ভাবে, সব ভাবনা তো দুধের বাচ্চাকে নিয়েই, আমাকে ভেবে হবে কি? মুখে বলে, ‘ঠিক আছে, আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করা লাগবে না।’
কি ক্ষোভে, কি দুঃখে আলেয়া তা বলল, সালেহা বেগম তা বোঝে। তবু সে যে ‘ঠিক আছে’ বলেছে, এটাই তার মনের সান্ত্বনা। তিনি আলেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দেন, সে তার লক্ষ্মী মেয়ে।
বিদায় মুহূর্তটা বিদায় মুহূর্তের মতই ছিল। তবে গ্রহণটাতে যে আগ্রহের কমতি ছিল, সে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছেই বুঝেছে। সেখানে খুব কম জনই তার প্রতি আন্তরিক ছিল।
সে রাতে মখলেছের সাথে তার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ ছিল। এমনিতেই তার মন শোকে পূর্ণ ছিল। সে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে একদমই প্রস্তুত ছিল না।
অনুমতির তোয়াক্কা মখলেছ করে নি, পুরো পাষণ্ডের মত সে আলেয়াকে ভোগ করেছে সে রাতে।
(চলবে)
বিষয়: সাহিত্য
২৪৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন