::রোজিনা:: ]]]][[[ছোটগল্প]]][[[
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২১ জুলাই, ২০১৩, ১০:৪৬:৩৯ রাত
১.
ঢিপ! ঢিপ! ঢিপ!
রোজিনার বুকের ধড় ফড় শব্দ বাড়তেই থাকে। অপরিচিত পুরুষটি তার বিছানায় বসে। তার সাথে কোন কথাও বলে না। যারা এরকম স্বভাবের হয় তারা যে বেশী আগ্রাসী হয় তা রোজিনা জানে। পুরুষটি কিছুক্ষণ রোজিনার আপাদমস্তক রাক্ষসের মত দৃষ্টিতে দেখে। রোজিনা এক দৃষ্টিতে টিনের চালের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের দেওয়াল চাটাইয়ের, আশে-পাশের সব ঘরই এরকম।
হঠাৎ-ই পুরুষটি রোজিনাকে জাপটে ধরে। তার পরের কিছু সময় কালবৈশাখী ঝড়ের মত। ঝড় থেমে গেলে রোজিনা নিরব-নিথরভাবে পড়ে থাকে। পুরুষটি নিজেকে ছিম-ছাম করে দরজার পর্দা সরিয়ে বাইরে আসে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার রশীদ, রোজিনার স্বামী। পুরুষটি তার হাতে একটা নোট গুঁজে দেয়। রশীদ এতে খুশি হয় না, বলে, 'এত কম রেটে হবে না। জিনিসটা খাসা।'
পুরুষটিও মনে মনে ভাবে আসলেই খাসা মাল এটা। তাই আরেকটা নোট দেয় রশীদের হাতে। রশীদ খুশী হয় এবং হাসিমুখেই বিদায় দেয় পুরুষটিকে।
২.
আগের জীবন এমন ছিল না তার। শহরে আসার পরই পাল্টে যায় সব কিছু। বেশীদিন আগের কথাও না, এইতো পাঁচ বছর আগেও রোজিনা থাকত তার মায়ের সাথে। বাবা আগেই এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল, মাও সে পথ ধরে। প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল মায়ের, হাতুড়ে ডাক্তার আফজার বলেছিল, 'টাইফয়েড হয়েছে, দামী ওষুধ লাগবে।'
মা একথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, 'কিছুই হয় নি মা। সামান্য জ্বর। ক'দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।'
একদিন সকালে উঠে রোজিনা মাকে ডাকতে থাকে। বারবার ডেকেও সাড়া পায় না। অজানা শঙ্কায় ভীত হয় সে। পাশের বাড়ির সবেদা চাচীকে ডেকে আনে। সবেদা চাচীই তাকে বলে, 'তোর মা আর নেই।'
তিনদিন তিনরাত সে শুধু কেঁদেছিলই। চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়ে যায় তার। তার এই শোকের দিনে তার পাশে শুধু ছিল সখিনা খালা। সখিনা খালার বাড়ি তাদের গ্রামেই। সে শহরে কাজ করে; চাকরানীর কাজ। বিধবা-নিঃসন্তানা সখিনা তাকে নানাভাবে বুঝ দেয়। বলে, 'চল, আমার সাথে শহরে চল, সব ঠিক হয়ে যাবে।'
রোজিনাও তার সামনে কোন পথ দেখতে পায় না। সখিনা খালাই তার একমাত্র পথ।
শহরে এসে এত লোক দেখে বিস্মিত হয় সে। শত শত দালান কোঠা শহরে। তবে কোনটিতেই স্থান হয় না তার। তার স্থান হয় নোংরা বস্তীতে। প্রথম মাস শোকেই কাটে তার। তারপর এক সন্ধ্যায় খালা এসে বলে, ‘তোর কাজ ঠিক হয়েছে আজ। ভালো ফ্যামিলি। মাইনাও ভালোই দেবে। কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবি।’
এছাড়া অনেক উপদেশ দেয় খালা। বাসার লোকজনের সাথে কিভাবে আচরন করতে হবে, কত সাবধানে কাজ করতে হবে, এইসব আর কি!
রোজিনা সব মনোযোগ দিয়ে শোনে।
পরদিন সকালেই খালা তাকে রেখে আসে মালিকের বাসায়। ছয় তলার অট্টালিকার চার তলায় বাসা মালিকের। মালিকের পরিবার ছাড়াও অনেক পরিবার আছে এই অট্টালিকায়। খালা তাকে এটা আগেই বলেছিল। তাকে এও বলেছিল, অন্য পরিবারের কারো সাথে কথা না বলতে, এতে নাকি মালিকেরা অখুশী হয়।
রোজিনার মূল কাজ ছিল রুম ঝাড়ু দেওয়া আর রান্নায় মেমসাহেবকে সাহায্য করা। বাসায় সাহেব, মেমসাহেব সহ মেমসাহেবের দুই ছেলে থাকে। বড় ছেলে কলেজে পড়ে, তার নাম সাজ্জাদ, আর ছোট ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ক’দিনেই সব কাজ বুঝে নেয় রোজিনা। গ্রামে থাকায় আগে থেকেই এসব কাজে পটু ছিল সে। সবকিছু ঠিক মতই চলছিল। কিন্তু অঘটনটা ঘটল এক দুপুরে। সেদিন দুপুরে বাসায় শুধু সাজ্জাদই ছিল। সাজ্জাদ তাকে চা আনতে বললে সে চা আনে। সে দুপুরে সাজ্জাদের রুমের দরজা বন্ধ হয়েছিল।
সন্ধ্যায় বস্তিতে ফিরে রোজিনা খালাকে বলে, সে আর কাজে যাবে না।
খালা হঠাৎ আজ রগচটা হয়ে গেল। বলল, ‘কেন রে? কেন যাবি না? কি ঝামেলা করেছিস?’
রোজিনা কিছু বলতে পারে না, সে কথা যে বলার মত নয়। সে বলে, ‘ওদের আচরণ ভালো নয়।’
‘তুই কি আমার চেয়ে বেশি মানুষ চিনিস! আমি আগের বুয়ার কাছে শুনেছি ওরা কত ভালো। তোকে ওখানেই কাজ করতে হবে। না করলে খাবি কি? না গেলে বের হয়ে যাবি এ ঘর থেকে।’ ইত্যাদি নানা কথা শুনতে হয় রোজিনাকে।
ঘর থেকে বের হলে রোজিনা থাকবে কোথায়? সে যে এ শহরের কিছুই চেনে না। মায়ের কথা মনে পড়ে বড্ড তার। সারা রাত কেঁদে যায় তার মন, চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরে।
৩.
‘আমি পারব না খালা! আমি পারব না!’
‘পারবি, পারবি। পারবি না কেন? ছোট সাহেবের সাথে তো ঠিকই পারিস।’
সত্য কথা বলায় নিশ্চুপ থাকে রোজিনা। আর এটাই সখিনার কাছে নীরব সম্মতি।
রোজিনার মনে সংশয়। কেমন জানি এক অস্বস্তি ভাব, যা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ।
৪.
‘দেড় লাখের কমে তো হবেই না।’
‘দেড় তো বেশী হয়ে যায়।’
‘বেশী কই? আগেরটা পঁচাত্তরে নিয়েছিলি। কিন্তু ভেবে দেখ, রোজিনার গড়নের কথা। একেবারে টইটুম্বুর। ট্রেনিংও ঠিক মত দেওয়া আছে।’
‘আমি একটা শেষ কথা বলি?’
‘বল?’
‘এক পর্যন্ত আছি, পারলে দিয়ে দে।’
সখিনা কি যেন ভাবে, তারপর রশীদকে বলে, ‘তাহলে কালকেই। টাকা নিয়ে আসিস।’
‘কোন চিন্তা করিস না। বিয়ের সব ব্যবস্থা আমিই করব এবার।’, রশীদ বলে।
বিয়ের সংবাদে খুশি হয় রোজিনা। সে ভাবে এবার বুঝি তার কষ্ট কমবে। স্বামীর ঘরই নিজের ঘর, তাই তার একটা ঘরও হবে। সেজন্য অসম্মতি জানায় না সে।
পরদিন সকালেই লাল শাড়ি আর কসমেটিকস পৌঁছে যায়। রোজিনার মনে আনন্দ ধরে না। বিকালে তিন জন বন্ধু নিয়ে বরের সাজে বিয়ে করতে আসে রশীদ। বরকে আগে কখনো দেখে নি রোজিনা। তার সুপুরুষোচিত চেহারা দেখে তার তার মন ভরে যায়। অবশেষে সন্ধ্যায় খালা তাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দেয়। রোজিনাও কাঁদে, এই এক বছরে এই সতের বচ্ছুরী কিশোরীর মনে খালার জন্য জন্মেছে অকৃত্রিম মায়া। যত খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, সেই যে এ জগতে তার একমাত্র অবিভাবক।
কয়েকমাস স্বামী সোহাগেই তার দিন কাটে। বাসা বাড়িতে কাজেও যায় না সে এখন। এতে সে বেশ খুশী। তবে তার দিন যে এভাবে চলার জন্য নয়। এক রাতে মাতাল সেই তিন বন্ধুকে নিয়ে ঘরে আসে তার স্বামী। তারপর আর তাকে ছাড় দেয় নি রশীদ। কিছু করতে অস্বীকার করলে স্যান্ডেল দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে।
খালা যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে একথাও জানতে বাকী থাকে না তার।
৫.
ভোর রাত। রোজিনা জেগে আছে, পাশে স্বামী রশীদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রোজিনা আস্তে আস্তে চৌকি থেকে ওঠে। চৌকির নিচ থেকে ধারালো বটি বের করে। কাঁপা কাঁপা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। দর দর করে ঘাম ঝরতে থাকে তার। তবু মনকে শক্ত করে রক্ত মাখিয়ে নেয় বটিতে। রশীদ ছটফট করতে করতে শান্ত হয়।
সে রাতেই ঘর ছাড়ে রোজিনা। আতঙ্ক বা আশঙ্কা তার মনে নেই, তার মনে আছে শুধু পরিতৃপ্তি আর পরিতৃপ্তি।
কয়েকদিন আত্মগোপনের পর এক সন্ধ্যায় তাকে দেখা যায় শহরের এক ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে। আকর্ষণীয় পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। রোড লাইটের আলোতে তার রূপ স্পষ্ট বোঝা যায়।
বেশী সময় লাগে না তার, সে যে রূপসী। হঠাৎ একজন পিছন থেকে এসে তার হাত ধরে বলে, ‘কত?’
বিষয়: সাহিত্য
৩১৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন