::আলেয়ার কথা:: [[[দ্বিতীয় অধ্যায়]]] ::
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৬ জুলাই, ২০১৩, ০৮:৫৬:৪৮ রাত
‘কি? কি হয়েছে আপুর?’ বলেই কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে আলেয়া।
তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সালেহা বেগম বলেন, ‘আল্লার কাছে দোয়া কর।’ সালেহা বেগমের চোখেও জল।
সেদিন বিকালে স্কুল থেকে বাসাতে ফিরেই আলেয়া দেখে বাড়িটা কেমন জানি খালি খালি। বাড়ির কাজের লোকের কাছেই জানতে পারে সে ঘটনা। সে বলে, তার বোন আবেদার সন্তান হবে তাই ক্লিনিকে গেছে সবাই। ওখানে নাকি আবেদার সিজার হবে। এ সংবাদ শুনে আবেদার মন আশঙ্কায় ভরে ওঠে। ক্লিনিকটা তাদের বাসা থেকে বেশী দূরে নয়, এইতো তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে ডানে গিয়ে যে মোড়টা আছে ওখান থেকে মেইনরোড ধরে সোজা কিছুদূর গেলেই ইমরান মেডিক্যাল ক্লিনিক। সে সময় নষ্ট না করে ক্লিনিকের দিকে যেতে থাকে। সে চলছে তো চলছেই। এই সীমিত পথই ফুরোতে চাচ্ছে না তার কাছে। আশে পাশে কিছু হচ্ছে কিনা তাও বলতে পারবে না সে। অথচ রাস্তার দুই পাশে ব্যস্ত দোকানপাট, আর রাস্তায় রিক্সা-ভ্যান এবং সাইকেল চলাফেরা করছেই। আজ রাস্তা দিয়ে ট্রাক বা ট্র্যাক্টরও চলে যায়, তবু আলেয়া কিছুই বুঝতে পারে না। আসলে ব্যক্তি বিশেষে কখনো কখনো সময় থমকে দাঁড়ায়। তখন বাইরের জগত বলতে কিছুই থাকে না তার। তার পৃথিবী তখন তার চিন্তা-ভাবনা, আশা-নিরাশা অথবা দুঃখ-কষ্ট। সময়ের প্রসারণ বা আইনস্টানীয় তত্ত্ব এ সময় সে ব্যক্তিতে ভর করে।
আলেয়া যখন ক্লিনিকে পৌঁছায়, আবেদা তখন অপারেশন থিয়েটারে। ওয়েটিং রুমে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আরমান সাহেব, সালেহা বেগম, মখলেছ (আবেদার স্বামী), আলেয়ার দু’ভাই সহ আবেদার শ্বশুর বাড়ির লোকজন।
আলেয়া যাবার কিছুসময় পরই অপেরাশন থিয়েটার থেকে এক ডাক্তার বের হয়ে আসেন। তিনি আরমান সাহেবকে চুপি চুপি কি যেন বলে গেলেন। এরপর আরমান সাহেব আরো পেরেশান হয়ে ওঠেন।
সালেহা বেগম আরমান সাহেবের মুখের অবস্থা দেখে তার কাছে গিয়ে হাতে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডাক্তার কি বললেন?’
আরমান সাহেব যেন স্তব্ধ, কিছুই বলেন না তিনি। কিই বা বলবেন তিনি। তাকে যে জানিয়ে যাওয়া হল এক আগাম শোক বার্তা। ডাক্তার তাকে গোপনে বলে গেলেন, ‘যে কোন একজনকে বাঁচানো যাবে। তবে কাকে তা বলা যাচ্ছে না।’
আরমান সাহেব ডাক্তারকে অনুরোধ করেন যাতে তার মেয়েটাকে বাঁচানো হয়। ডাক্তার তাকে আশ্বাস দেয়।
ডাক্তাররা এত নিশ্চিতভাবে কোন অপারেশন শেষ হবার আগেই এরকম ভবিষৎবাণী কিভাবে করেন তা অনেকের কাছেই অজানা। আসলে ভিতরের ঘটনা হচ্ছে ঐ একজন মারা যাবার পরই এই বার্তা বাইরে পাঠানো হয় যে, একজনকে বাঁচানো যাবে। বেশীর ভাগ সময়ই মৃত্যুর কারণ হয় অদক্ষ সার্জন। একজন এম,বি,বি,এস পাশ করা ডাক্তারের হাতেই যে কত লাশের দাগ লেগে থাকে তা শুধু সেই ডাক্তারই জানেন।
সালেহা বেগমের বার বার জিজ্ঞাসায়, আরমান সাহেব তাকে সান্ত্বনা সূচক এক বাক্য বলেন, ‘তেমন কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তার কথার রেষ সালেহা বেগমের মাথায় থাকতে থাকতেই খবরটা বাইরে আসে। কথা রাখতে পারে নি ডাক্তার। তার মেয়ে যে আজ নিশ্চল, শ্বাস নিতে তার মানা আজ থেকে। মুহূর্তে শোকপুরীতে পরিনত হয় ওয়েটিং রুম।
ক্লিনিকের পাশের চায়ের দোকান থেকেও শোনা যায় সে শোকের আর্তনাদ। চায়ের দোকানে বসা একজন বলে,
‘মনে হয় কেউ মারা গেছে।’
‘তাই হবে, গত বৃহস্পতিবারও একজন মারা গিয়েছিল।’, আরেকজন বলে।
‘অনভিজ্ঞ ডাক্তার, আন্দাজে চিকিৎসা করে। সেদিন আমার বউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম তো চার রকমের ওষুধ দিল। গতকাল নিয়ে যেতেই সব ওষুধ পাল্টে অন্য ওষুধ দিল।’, গোফওয়ালা এক বয়স্ক লোক বলে।
‘বুঝলেন, সব একদম ভুয়া। শুধু প্রেস্ক্রিপশন লেখে আর টাকা নেয়।’, চায়ের দোকানওয়ালা তাদের সমর্থন করে বলে।
সাধারনের এসব কথা থেকেই বোঝা যায় তারা কিভাবে ডাক্তারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। বোধহয় এসব কারণেই, ভন্ড কবিরাজদেরকে কেউ কেউ বিশ্বাস করে বসে, অথবা ভন্ড পীরের মুরিদ হয়।
চায়ের দোকানের কেউ আবার যেয়ে নিশ্চিত হয়ে আসে কি হয়েছে। তারপর এসে বলে, ‘আরমান হাজীর মেয়েটা মারা গেছে সন্তান প্রসবের সময়। ভিতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’
এ বার্তায় সবাই দুঃখিত হয়। কারো কারো চোখে জল টলমল করে।
এরপরের ঘটনা সবার জানা। একটু পরেই সশব্দে পুলিশের একটা জীপ এসে দাঁড়ায় ক্লিনিকের সামনে। ওসি সহ তিনজন ক্লিনিকের ভিতরে ঢোকে। ওসি আরমান সাহেবকে ডেকে বলেন, তিনি খুবই দুঃখিত। আরমান সাহেব শুধু ওসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই শোকের মুহূর্তে কিভাবে যে এরকম নিষ্ঠুর হয় এরা ভেবেই অবাক হয় আরমান সাহেব। তিনি চান না তার মেয়ের মরদেহটাকে কেটে ছিন্নভিন্ন করা হোক। তাই সিক্ত হাত পকেটে ঢুকিয়ে বের করে দেয় এক বান্ডিল কাগজ।
এই কাগজের মূল্য এই পৃথিবীতে অনেক। এরি জন্য মানুষের জীবনের লড়াই চলতেই থাকে বছরের পর বছর। এই কাগজের জন্যই একজন আরেকজনকে হত্যা করে। এই কাগজের ক্ষমতাই বর্তমান পৃথিবীর ক্ষমতা। আজব এই কাগজ! সত্যিই আজব!
আরমান সাহেব যাবার পরই ডাক্তারদের চেম্বারে হামলা করে ওসি। কড়া গলায় বলেন, ‘কি সব ডাক্তার রাখেন আপনি ক্লিনিকে? এরকম করলে তো আপনাকে গ্রেফতার করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
ক্লিনিকের মালিক ড. ইমরান বলেন, ‘স্যার, এটা ইমারজেন্সি কেস ছিল। কোনভাবেই বাঁচানো সম্ভব ছিল না উনাকে।’
‘এসব বললে কি আর হবে, গত সপ্তাহেও একজনকে মারলেন। আমাদের তো জবাবদিহি করতে হয়।’, ওসি আরো চড়া গলায় বলেন।
‘স্যার, সন্ধ্যায় থানায় আপনার সাথে দেখা করব। আপনি এখন লাশটাকে বাইরে বের করার ব্যবস্থা করুন। ক্লিনিকে অনেক রুগী আছে, এরকম চিল্লা-চিল্লি হলে রুগীদের ক্ষতি হতে পারে।’, ড. ইমরান বলেন।
এই দেখা করার অর্থ ওসি ভালোমতই বোঝেন, তাই তিনি বলেন, ‘ওকে! ঠিক আছে। ভবিষ্যতে সাবধানে করবেন সবকিছু। সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।’
নীরব-নিথর দেহটাকে বের করা হয় ক্লিনিক থেকে। পিছন পিছন বের হয় একদল শোকার্ত মানুষ; একদল আর্তনাদ। আশ-পাশের দোকানপাট হতে কেউ কেউ ছুটে আসে মরদেহ দেখার জন্য। তাদের মনেও শোক হয়, চোখ টলমল করে ওঠে। কেউ কেউ আল্লাহর কাছে তার বেহেশত নসীবের জন্য দোয়া করে।
এশার নামাজের আগেই আম-কাঁঠালের বাগানে স্থান হয় মরদেহের। নির্জন সে জায়গাই তার নিবাস এখন থেকে।
তারপর হাজী বাড়ির উঠোনে দেখা যায় আরিফ ভাইয়ের সাথে তার কিছু বন্ধু লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফ ভাইয়ের এক বন্ধু বলে, ‘ঐ ডাক্তারই আবেদা আপুকে মেরেছে। চল আজ উড়িয়ে দেব ক্লিনিক।’
আর সবাই তার কথায় সাঁই দেয়। তারা ক্লিনিকে ভাংচুরের পরিকল্পনা করে। তবে আরমান সাহেবের কানে কথাটা যেতেই তিনি তাদের বাঁধা দেন। তিনি জানেন এই রক্ত গরম ছেলেদের থামানো সহজ নয়। নানা রকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, ‘যে গেছে, যা গেছে তা তো আমারই গেছে। তোরা যা করবি তাতে কি তাকে ফিরে পাব?’
এসব কথায় ছেলেদের মন শান্ত হয় না। তবু হয়তো আরমান সাহেবের কথার প্রতি সম্মান জানাতেই তারা এ কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়।
এদিকে আবেদার সন্তানের পরিচর্যায় ব্যস্ত তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। মাতৃহারা এই ছেলে সন্তান যে আবেদার একমাত্র স্মৃতি। তাই সালেহা বেগমও তার শোককে দমন করে তার কাছে যায়, তার পরিচর্যা করে।
আলেয়াতো সেই কখন থেকে চোখের জল ফেলেই যাচ্ছে। শাহানাজ তাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যে আপু আসলেই তার জন্য নিয়ে আসত নানান রকম চকলেট অথবা উপহার দিত রং-বেরং এর পোশাক, তার কথা সে কিভাবে ভুলবে? তার হাসি, তার কথা যেন বার বার এই রাতে তার সামনে-পিছন, ডান-বাম থেকে তার শুভ্র হৃদয়ের চারপাশে চলে আসে। একেকটা স্মৃতি তার কান্নার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই পার হয় রাত।
সকালে রান্না ঘরে আগুন জ্বলে নি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে কতজন মারা গেল সে খবরও রাখে নি এ বাড়ির কেউ।
বিষয়: সাহিত্য
১১৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন