::আলেয়ার কথা [প্রথম অধ্যায়]::বড় গল্প:: উৎসর্গ- নীরবে সামাজিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীদেরকে

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৫ জুলাই, ২০১৩, ১০:৩২:৫৫ রাত



আলেয়া তখন মাধ্যমিকে পড়ে, বয়স সবে ষোল।

বিংশ শতাব্দীর এই শেষ ভাগে শিক্ষা-দীক্ষায় মেয়েরা অনেক এগিয়ে, স্বাধীনতার দিক দিয়েও ছেলেদের ছুঁই ছুঁই। আলেয়া ক্লাসে মনযোগী এবং ভালো ছাত্রী। তার বাবা আরমান খান একজন নামী মানুষ, হজ করায় লোকেরা তাঁকে আরমান হাজী বলে ডাকে, আর অতি পরিচিতরা "হাজী সাহেব" সম্বোধন করেই ডাকে। তিনি বেশ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। ছোট্ট মফস্বল শহরের বেশীর ভাগ মানুষই তাঁকে এক নামে চেনে। গ্রামে তাঁর আছে বিঘার পর বিঘা জমি, শহরে বাংলো ধাঁচের বাড়ি। শহরের বাড়ির সাথেই একটি বড় শান বাঁধা পুকুর আর আম-কাঁঠালের বাগান। দুপুরে আশে-পাশের মেয়ে-মহিলারা গোসলে আসে পুকুরে। বেশ এলো মেলো ভাবেই গোসল করে তারা, কারণ তাদের দিকে বদ নজরে তাকাতে লজ্জাবোধ করে পুরুষেরা। এখানকার পুরুষের এই লজ্জা এবং শালীনতা সব সমাজকে হার মানায়।

আলেয়া প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। মা সালেহা বেগমের সাথে নামাজ পড়ে কুরআন তেলওয়াত করতে বসে। তারপর মা এবং ভাবীকে রান্না-বাড়াই সাহায্য করে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয় আর রান্না করা দেখে এক নজরে। এভাবেই সে একদিন হয়ে উঠবে একজন পাকা রাঁধুনি। রান্নার সময় আরমান সাহেব দু'একবার রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন রান্না হয়েছে কিনা। সকালে সাধারনত উঠোনে বসে বেতারে খবর শোনেন তিনি। খবরের যে অংশটা জন্য তিনি উদগ্রীব থাকেন, তা হল ইরাক-ইরান যুদ্ধের খবর। এই খবরের সময় পাশে বসা কেউ ভুলে কোন কথা বললেও তাকে ধমক খেতে হবে নিশ্চিত।

রান্না-বাড়া শেষ হলে সবাই একসাথে খেতে বসে। আলেয়া এবং সালেহা বেগমই খাবারের আয়োজন করে। আলেয়ার দুই ভাই সোহান এবং আরিফও থাকে ভোজসভায়। সোহান আলেয়ার চেয়ে ছোট। আলেয়া তাকে অনেক আদর করে এবং খাবার সময় ভালো খাবারগুলো সোহানের পাতে তুলে দেয়। আর আরিফ ভাই বিবাহিত। আরিফ ভাইয়ের বউকেই ভাবী বলে ডাকে আলেয়া। ভাবী খুব সরল প্রকৃতির মানুষ। এছাড়া আলেয়ার এক বড় বোন আছে যার নাম আবেদা। তার বিয়ে হয়ে গেছে তিন বছর আগেই। তাই সে এখন শ্বশুর বাড়িতে থাকে, সংসার করে।

খাওয়া শেষ হলে স্কুলে যাবার জন্য আলেয়া বই-পত্র গোছায়। তারপর চুল বেঁধে, কালো বোরকা পরে (যাতে তার শুধু তার চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না) সে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয়। যাবার সময় মাকে বলে বের হয়, মা মনে মনে তার শুভকামনা করে বলে, ‘সাবধানে যাস। মন দিয়ে ক্লাস করিস।’

তাদের বাড়ির দু'বাড়ি পরই শাহানাজদের বাড়ি। শাহানাজকে ডেকে নিয়ে দু'জনে গল্প করতে করতে স্কুলের দিকে যায়। শাহানাজ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। স্কুলটি বেশী দূরে নয়, তাই কয়েক মিনিটেই তারা স্কুলে পৌঁছে যায়। স্কুলটি ছিল শুধু মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত, মানে বালিকা বিদ্যালয়। নারী শিক্ষার জন্য এরকম অনেক বিদ্যালয় আছে এখন দেশে। ক্লাসে সবসময় আলেয়া আর শাহানাজ এক বেঞ্চে বসে। আলেয়া মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। শিক্ষকদের সব উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করে। ভালো ছাত্রী হওয়ায় স্যার-ম্যাডামেরা তাকে অনেক পছন্দ করত। রাবেয়া ম্যাডাম তাকে অনেক বেশী পছন্দ করত এবং তাকে মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে ডেকে বিশেষ উপদেশ দিত। তিনি তাকে পড়াশুনা করে বড় হবার জন্য উৎসাহ দিত। সে সব কথা আলেয়া শুনত আর স্বপ্ন দেখত বড় হবার।

ক্লাস শেষ হলে তারা বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাসায় পৌঁছে গোসলে যায়। একজন আগে আসলেও আরেকজন শান বাঁধা পুকুরের সিঁড়িতে বসে থাকে আরেকজনের অপেক্ষায়। তারপর পানকৌড়ির মত ডুব সাঁতারে শেষ হয় তাদের গোসল।

বিকেলে শাহানাজ আসে তাদের বাড়িতে। তারা গল্প-গুজব করে, মাঝে মাঝে আবার পাশে প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। কে কি করছে তা দেখা আর জ্বালাতন করায় তাদের কাজ। কোন ভাবী অথবা খালামনি রান্না করলে, তারা যেয়ে তাকে একের পর এক প্রশ্ন করত। বলত, ভাবী এক কেজি চালে কতটুকু পানি দিতে হয়? কোন সময়ের ঝালে ঝাঁঝ বেশী? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন।

এরপর মাগরিবের আজান হলে শাহানাজ তার বাড়িতে চলে যায়। আলেয়া মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়তে বসে। এশার আজান হলে পড়া ছেড়ে উঠে নামাজ পড়ে সবাই একসাথে রাতের খাবার খায়। তারপর আবার পড়তে বসে আলেয়া।

হারিকেনের টিমটিমে আলোতে পড়তে পড়তে তার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে বৈদ্যুতিক বাতির কথা। একবার বড়মামার বাসায় বেড়াতে গিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি দেখেছিল সে। কত সুন্দর আলো! সারা ঘরময় বিস্তৃত সেই আলো। স্পস্ট দেখা যায় সবকিছু, মনে হয় দিনের আলো। তার কাছে, বৈদ্যুতিক আলো মানে ‘রাতের সূর্য’। তার বান্ধবীরা বইতে বৈদ্যুতিক বাতি সম্পর্কে পড়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা কেমন তা কেউই জানত না। তাই স্কুলে গেলে কোন আলাপচারিতায় বিদ্যুতের কথা আসলেই, সবাই আগ্রহ ভরে তার কাছে জানতে চেত বৈদ্যুতিক বাতির কথা। তারা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করত, আলোর রং কি? আলোতে শরীরের লোম দেখা যায় কিনা? ইত্যাদি। আলেয়া তাদের বলত, ‘রং হলুদ মত, একদম দিনের আলোর মত আলো দেয়। সব কিছু দিনের মত পরিষ্কার দেখা যায়।’ তার বান্ধবীরা তার কথায় অবাক হত।

পড়া শেষ করে রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে সাড়ে দশটা-এগারটা বেজে যায়। চাঁদনী রাতে আরো বেশী বাজে। কারণ চাঁদনী রাতে সে তার রুমের জানালা খুলে চাঁদের সৌন্দর্য দেখে। ছোটবেলায় কত কথা শুনেছে দাদীর কাছে এই চাঁদ নিয়ে। দাদী বলত, ‘ঐ যে দেখছিস চাঁদ, ভালো করে দেখ, চোখ সরাবি না, ঐখানে বসে আছে চাঁদের বুড়ি, বুড়ি দুধ দোয়াচ্ছে এক গাভীর, আর ঐ দেখ বুড়ির মাথার উপরেই বটগাছ।’

আলেয়া তাকিয়ে থাকত চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে। সত্যি সত্যি ওরকম আবয়ব দেখে অবাক হত আলেয়া। তার বয়স যখন দশ সে বছরই দাদা-দাদী দু’জনই মারা যান। দাদীর কথা মনে পড়লে অনেক কষ্ট পায় আলেয়া। তাকে অনেক ভালোবাসত তার দাদী। অনেক রাতেই সে তার দাদীর কোলে মাথা রেখে ঘুমাত, শুনত নানা রকম রূপকথা। সে সব রূপকথার ভিতর বেশীর ভাগই ছিল রাজা-রানী অথবা রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প। দাদী তাকে বলত, তোর বিয়ে দেব রাজকুমারের মত এক ছেলের সাথে। দাদী তাকে ভূত-প্রেত্নীর গল্পও শোনাত। ভূতের গল্প শুনে আলেয়া ভয়ে কাঁপত, দাদীকে জড়িয়ে ধরত। গল্প শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত তার ঠিক ছিল না।

এখন তাকে কেউ আর গল্প শোনায় না, তবু সে ঘুমায়। ভোরে প্রতিদিনের মত মায়ের ডাক শুনতে পায় ‘আলেয়া! আলেয়া! উঠে পড়। আজান হয়ে গেছে। উঠে পর। আলেয়া! আলেয়া! নামাজ পড়তে হবে।...'

[প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত, চলবে...]

বিষয়: সাহিত্য

২৪৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File