মহাসেন ::ছোট্ট গল্প::
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২০ মে, ২০১৩, ০৫:১৮:৩৫ বিকাল
১.
শহরের এক মোড়ে একটি চায়ের দোকান, টিন আর কাঠ দিয়ে তৈরী দোকানটি। এখানে খাঁটি গরুর দুধের তৈরী চা পাওয়া যায়। তবে দুধ কতটুকু খাঁটি তা কেউই জানে না, তবে এলুমিনিয়ামের পাত্র বোঝায় দুধ শরে ঢাকা থাকে। অনেক মানুষ আসে এখানে চা খেতে। পাশের বড় বড় দালানে বসবাসকারী সাহেবরাই এখানে বেশী চা খায়।
সেদিন বিকালে বেশ কয়েকজন সাহেব একত্রিত হয়েছে, নানাবিধ কথা চলে বেঞ্চের উপর বসে সাহেবদের। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই সমসাময়িক আলোচনা হয়।
আসিফ সাহেব- কত জন মারা গেছে মহাসেনে?
মিজান সাহেব- এইতো বেশী না, ২০-৩০ জন।
রাজিব সাহেব- আরে না, আমিতো দুপুরে টেলিভিশনে দেখলাম ৩৭ জন। মনে হয় ৫০ মত মারা যাবে।
আসিফ সাহেব- যে ভাবে আসল, মনে হল পৃথিবী উল্টে যাবে। সেজন্যই কথায় আছে, যত গর্জে তত বর্ষে না।
শফিক সাহেব- আসলেই, শুনেছিলাম কয়েক হাজার লোক মারা যাবে। সবই গুজব!
আসিফ সাহেব- শাপলা চত্বরেই তো এর চেয়ে বেশী মারা গেছে।
রাজিব সাহেব- আপনি আছেন শাপলা চত্বর নিয়ে, এই যে রানা প্লাজার ঘটনাতেই তো হাজারের বেশী মারা গেল।
মিজান সাহেব- ঠাট্টা করতে এসেছিল মহাসেন। অনেকটা মিরাক্কেলের জোকসের মত। আবার নাকি ভারী বর্ষণই মহাসেনকে দুর্বল করেছে।
আসিফ সাহেব- উপমাটা এভাবে দেওয়া যায়, শ্রীলঙ্কার অত্যাচারী রাজা বঙ্গদেশে এসে বিতারিত হলেন।
মিজান সাহেব- ব্রিলিয়ান্ট, আপনি সবসময়ই বিশেষ উপমা দেন।
এভাবেই সাহেবদের আলোচনা এগিয়ে চলে।
২.
- তোর ফোনেইতো আসলাম আমি। মহাসেন না আসলেতো ঢাকায় যাওয়াই হত না। অনেকদিন পর গেলাম ঢাকায়, নন্দন পার্ক ঘুরে দেখেছি এবার। বেশ সুন্দর পার্কটা। পলিটিক্স করলেতো আর ঘোরার সুযোগ পাওয়া যায় না, তবে এবার ঢাকায় গিয়ে খুব মজা হয়েছে রে। এলাকার অবস্থা কি? ত্রাণ কি আসা শুরু হয়েছে? সব জায়গায় লোক ফিট কর, আমার হাতের উপর না এসে যেন কোন ত্রাণ কোথাও না যায়। নজির আর শরিফকে জানিয়ে দিস।
- ওকে বস। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
৩.
নাম তার রহমত আলী, বাসা ভোলা। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বউকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল দুদিন আগেও।
আজ নিজের ভিটে দেখতে এসেছে সে। দুইটি লাশের শোক তার হৃদয়ে। তবু আবার গড়তে হবে ঘর, ঘর যে লন্ড ভন্ড। চারপাশে তাকিয়ে দেখে রহমত আলী, যতদূর দেখে তত দূরই বিধ্বস্ত ঘর। আক্কাস, রহিম, সাফায়েত, লাল্টু সবার ঘরই মাটির সাথে মিশে আছে। এখনো পানি নেমে যায় নি, তাই নতুন ভাবে ঘর তোলা যাচ্ছে না।
একটু পরেই ভিডিও ক্যামেরা হাতে এক সাংবাদিক আসে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুঁটিয়ে। সে আগেই শুনেছে রহমতের কথা, তাই তার দিকেই আসে। এসে রহমতকে বলে, তারা টেলিভিশন থেকে এসেছে তার সাথে কথা বলার জন্য। সাংবাদিক ভিডিও ক্যামেরা সেট করে তাকে জিজ্ঞাসা করে, "আমরা শুনেছি আপনার দুই ছেলে মারা গেছে এই মহাসেনের কবলে পড়ে। এখন কি আপনি বলবেন, সেই প্রলয়ংকারী ঝড়ের কথা। আসলে কি হচ্ছিল ঝড়ের সময়?"
দুদিনের অভুক্ত রহমত আলী স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখে কথা সরে না।
সাংবাদিক বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে, কিন্তু ফল আসে না। তারপর অন্য প্রশ্ন করে।
"আপনি কি পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন ঝড়ের পর থেকে?"
রহমত আলী তবুও নীরব। কি বলবে সে, বলার আছেই বা কি? যা বলার তা সবাই জানে।
সংবাদটি টেলিভিশনে প্রচার হয় নি। কারণ সে কথা বলে নি।
তার কাছে চেয়ারম্যান এসে ত্রাণ দেয় নি। তিলে তিলে স্বযতনে তাকেই গড়তে হবে তার ঘর। এতে তার ক্ষোভ নেই। কারো প্রতি অভিযোগ আনার সময় বা অধিকার কোথায় তার, আজ বুঝি সে নিজেই দেশের এক অভিযোগ!
******
[ঘটনা প্রবাহ কারো বাস্তবিকতার সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়]
বিষয়: সাহিত্য
৩১৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন