গল্পঃ “দ্বি-মুখী”

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ০২ মে, ২০১৩, ১১:৫৩:৫৬ সকাল



১.

আমি তখন অনার্সে পড়তাম। পড়াশুনা করার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াটাও অনেক মজার ছিল। কখনো কখনো তাস খেলতে খেলতেই রাত কেটে যেত। বেশ অগোছালো ছিল সময়গুলো। কখন কি করতাম না করতাম তা ভাববার ফুসরত ছিল না। ফেচবুকিং অথবা পার্কে গিয়ে জুটিদের চুম্বন ক্রিয়া দেখাটাও আনন্দ দিত। মনে হত এইতো জীবন। তবে এভাবেই সব সময় গেল না।

বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি হচ্ছে, রুমমেট বাইরে গেছে আর আমি এরিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব পড়ছিলাম (যদিও আমি বিজ্ঞানের ছাত্র তবে সাহিত্যে আমার অগাধ টান ছিল) ঠিক এরকম মুহূর্তেই একটি কল এসেছিল।

এটা বেশ আশ্চর্যজনক! সে ছিল মেয়ে আর খ্রিস্টান। বাঙ্গালীদের ফোনে অপরিচিতদের সাথে আলাপ খুবই আলাদা। এখানে অনেক ছেলে-মেয়েরা শুধু শুধু অপরিচিতদের কল করে এবং এটা বেশ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় কারণ তারা তাদের পরিচয় দেয় না। মেয়েরা এমনকি তাদের নামটি পর্যন্ত লুকাতে পছন্দ করে!

কিন্তু সে তা করেনি। আমি সেদিন বুঝেছিলাম, আমি যখন তার সাথে কথা বলছিলাম- আমি তাকে অধিক বিশ্বাস করছিলাম। আমি তাকে অধিক স্পষ্টভাষী ও পবিত্র মনে করতে লাগলাম। এটা আমাকে তার সাথে আরো কথা বলতে উৎসাহ দিত। ফোনে বেশ কয়েকদিন কথা বলার পর আমরা দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সে তখন মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেছে, তবে তার শারীরিক গড়ন বয়সের তুলনায় পরিপক্ক ছিল এবং তার নাম রিতু। প্রথম দর্শন ও আলাপচারিতায় ভালোমত ভালো লেগে গেল তাকে।

এদিকে আমার বন্ধুদেরও বাকী থাকল না বিষয়টা জানতে। আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝেই রিতুর কথা জানতে চেত আমার কাছে। ঠাট্টা-তামাশাও কম হত না বিষয়টা নিয়ে। প্রথম প্রথম ইতস্ততঃ বোধ করতাম এবং তাদের বলতাম - ও আমার বন্ধু ব্যতীত আর কিছুই নয়। ওরা রিতুকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার মনে একটা রহস্যময় আনন্দের সঞ্চার হত, আনন্দটা চাঞ্চল্যে ভরা ছিল।

তারপর আরো কয়েকবার দেখা করেছিলাম আমরা। আমরা কখনোই ধর্ম নিয়ে কথা বলতাম না। আমার মনে কখনোই আসে নি ওর সাথে এ বিষয়ে কথা বলি অথবা রিতুও কখনো আমাকে বলে নি। তাই ও এসে পড়ল আমার জীবনে এবং আমি ওর। খুব তড়িঘড়ি করেই।

জীবনের আসা-যাওয়াকে আমার এক বন্ধু খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করত। সে বলত মানুষের জীবনে তিন ধরনের মানুষের যাতায়াত।

থার্ড পার্সন- ‘এলো এবং গেলো। দেখা হলে হয়তো হাই-হ্যালো।’

সেকেন্ড পার্সন-‘দেখা হলে আলাপচারিতা এবং প্রস্থানে পুনরায় দেখা হবার আকাঙ্ক্ষা।’

ফার্স্ট পার্সন-‘হাসাতে হাসাতে আসবে, কাঁদাতে কাঁদাতে যাবে।’

তবে আমি তখনো বুঝিনি সে কি রূপে এসেছিল, বুঝেছিলাম অনেক পরে।

২.

হঠাৎ করেই তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। কোনভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমার মন এই অনিশ্চিত শোকে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। দিনের পর দিন শুধু তার কথা ভেবেই পার করতাম। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিত- এটা হবার ছিল না, হলে হয়তো আরো বিপত্তি ঘটত। সেসময় আমার কানে কথাগুলো ঢুকত না, কেননা আমি ওর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ওর অস্তিত্বের সাথে আমার অবস্থান বলে মনে করতাম।

সব শোক কেটে যায়। কিন্তু যারা আসে হাসাতে হাসাতে তাদের সৃষ্ট অনিশ্চয়তা সহজে কাটে না। তাই আমি আবার আমার আগের আমিকে আবিষ্কারের নেশায় মাতলাম। আবিষ্কার করতে গিয়ে বুঝলাম, আমি পরিবর্তিত হয়ে অন্য আমি হয়ে যাচ্ছি। এই আমি হবার যুদ্ধ করতে করতেই দেড়টি বছর পার করে দিলাম। তখনো প্রতিনিয়তই সে আমার হৃদয় পটে ভেসে উঠত। হঠাত হঠাতই স্মৃতিরা আমার দম বন্ধ করে দিত ক্ষণিকের জন্য। এরকম জটিল সমীকরণে যখন দিন চলছিল, সেসময়ই আবার আবির্ভাব ঘটল রিতুর। মাধ্যম সেই পুরনো।

দেখা করে জানতে পারলাম অনেক কিছু। তাকে চলে যেতে হয়েছিল নিউইয়র্কে। ওখানেই পড়াশুনা করছে সে। দেশ থেকে জাবার আগেই প্যারিস নামে একটি ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারা দুজনই একই এপার্টমেন্টে থাকে এবং একই বিছানায়। তারা দুজনই ছোটবেলা থেকে একই সাথে বড় হয়েছে। ভালো একটা জুটি হবার সব কিছুই দু’দিক থেকেই বিদ্যমান।

রিতু খুব সজাগভাবে বলছিল সব।

সে বলছিল, সে বিয়েতে রাজী ছিল না। যদিও প্যারিস তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, কিন্তু তার মন তাকে গ্রহন করতে পারে না। প্যারিস তাকে রোমাঞ্চকরভাবে জড়িয়ে ধরত এবং চুম্বন করত যা তার কাছে অস্বস্তির কারণ ছাড়া কিছুই ছিল না। প্যারিসের আরেকটি অভ্যাস ছিল, সে যখন যা চাইত তা তখনই রিতুকে করতে হত। এটা স্বভাবতই একজন একবিংশ শতাব্দীর খ্রিস্টান নারী মেনে নিবে না।

রিতু আমাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছে, সে হয়তো তার সাথে থাকতে পারবে না।

আমি তার কথা শুনেছিলাম এবং তা আমাকে আবেগী করেছিল।

এই আবেগ বেশি দিন থাকল না। এক মাস পর আবারো সে চলে গেল। হারানো জিনিস হারানোর পর অস্বস্তি যে বৃদ্ধি পায়, আর হতাশা পায় লোপ তা ভালোমত বুঝলাম।

এই অস্বস্তিও বেশী দিন থাকল না। আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম, সে যে অপরের, তার প্রতি কিই বা অধিকার আছে আমার?

ফাইনাল ইয়ারের শেষের দিকে আবার রিতু দেশে আসলো। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো আমাকে ভুলে গেছে। তার সাথে দেখা হবার মুহূর্তে আমি মুচকি হেসেছিলাম এবং মনে মনে ভেবেছিলাম ‘মনে আছে তাহলে’। সেবার সে আমাকে বলেছিল, প্যারিসের ছেলেমানুষী, পাগলামি ও নিজের মত তার উপর চাপিয়ে দেওয়া চরম পর্যায়ে। সে তার কাছে থাকতে অস্বস্তি বোধ করে। অবস্থা এরকম যে, প্যারিস যদি তাকে কিছু করতে বলত আর রিতু তা করত না- তাহলে প্যারিস তার হাত কেটে ফেলত।

রিতু আমাকে আরো বলেছিল, সে হয়তো আমার সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। সে আকুতি করেনি, আবেগী হয় নি, সে শুধু আমাকে বলেছিল।

তবে এটা ভেবে দেখার পর্যায়ে আমি ছিলাম না। আমি অনেক বাস্তবিকতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শিখেছিলাম এবং পরিবারের কথাও আমার মাথায় এসেছিল। আমি তার অথবা আমার পরিবারকে কষ্ট দিতে পারি না। ভেবে-চিন্তে কিছু জানাবার প্রয়োজনও মনে করি নি। বরং আমি তাকে বলেছিলাম, সে যেন প্যারিসের সাথে সব বিষয়ে সমঝোতা এনে চলে। সেদিন আমি ভাবি নি, সমঝোতার মাধ্যমে একটি স্বাভাবিক জীবন চালানো যায় না।

৩.

আট বছর পর বিশেষ একটি কাজে নিউইয়র্ক এসেছি। কাজের মাঝে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সে এখন একা থাকে। মাঝে মাঝে বড় অংকের ডলার খরচ করে মানুষ ভাড়া করে সময় কাটানোর জন্য। প্যারিসের সাথে অনেক আগেই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তার।

আমি এখনো অবিবাহিত। আমি বিশ্বাস করি সে আমাকে প্রতারক মনে করে নি কখনো। আমি যখন তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সে ফুলের বাগানে পানি দিচ্ছিল। আমাকে দেখে সে আতকে ওঠেনি, খুবই স্বাভাবিক ছিল তার আচরন। মনে হচ্ছিল, সে হয়তো আগে থেকেই আমার আগমনের কথা জানে। আমি তার সাথে করমর্দন করেছিলাম এবং সামনাসামনি বসেছিলাম। ছয়মাস নিউইয়র্কে থাকার অনেক সন্ধ্যা অথবা সকাল তার সাথে কেটেছে। সে কখনোই আমার কাছে কোন অভিযোগ অথবা আবেদন করে নি।

বিদায় মুহূর্তটা বেদনা বিধূর ছিল। আমার প্রতি তার কোন ক্ষোভ ছিল না, কেননা সে এখন জানে আমার কাছে একটি বিদায় মুহূর্ত আছে যা আরো বেদনার। সে জানে- সে আমাকে কেনার আগেই আমি কাউকে কিনেছিলাম। আর আমি জানি আমি তাকে সঠিক মূল্য দিতে পারি নি। আমি তাকে গ্রহণও করতে পারি নি অথবা বর্জনও করতে পারি নি।

আজ এ সত্য আমাকে গভীর বেদনা দেয়, এ বেদনা ছিল খাদহীন, এতে অস্বস্তির কোন স্থান ছিল না।

(সম্পূর্ণ কল্পিত লেখা)

বিষয়: সাহিত্য

২১৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File